বাংলাদেশে পর্তুগিজ প্রভাব
বাংলাদেশে পর্তুগিজ প্রভাব - ছবি সংগৃহীত
অতীতে অনেক ঔপনিবেশিক শক্তি এই ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে। তারা এসেছিল ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদী’ পাড়ি দিয়ে সুদূর ইউরোপ থেকে। তাদের মধ্যে ব্রিটিশদের কথা আমরা সবাই জানি। ওরা প্রধানত ইংরেজ এবং সেই মোগল আমল থেকে একেবারে শেষে, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তাদের হাত থেকে আমরা স্বাধীন হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা বিশ্বের এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সেই ইংরেজরা ছাড়াও ফরাসি, ডাচ, দিনেমার, পর্তুগিজ প্রমুখ জাতি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এ উপমহাদেশে। জানা যায়, তাদের মধ্যে সবার আগে এসেছিল পর্তুগিজ জাতি। তবে তারা পশ্চিম ভারতীয় উপকূলে গোয়া ছাড়া আর কোথাও উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে পারেনি, বলা যায়। গোয়া এখন ভারত রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য বা প্রদেশ। পানাজি ও মার্মাগাঁওসহ গোয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক ও পর্যটন ঐতিহ্য সুবিদিত। পর্তুগিজরা দৃশ্যত কোথাও নেই দীর্ঘকাল, কিন্তু আমাদের ভাষায়, সমাজে, ধর্ম ও সংস্কৃতিতে আজো তাদের প্রভাব ব্যাপক, যা অনেক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর। বিশেষত আমাদের এ বাংলাদেশে পর্তুগিজদের দ্বারা ধর্মান্তরিত মানুষ বেশি না থাকলেও পর্তুগিজ ভাষার ও সংস্কৃতির প্রভাব আজো রয়ে গেছে দৈনন্দিন জীবনের নানা পর্বে। অবশ্য তাদের মাঝে বর্ণবৈষম্য ছিলো প্রচ-ভাবে। শাসন ব্যবস্থার উঁচু পদে সাধারণত পর্তুগিজ শ্বেতাঙ্গরাই অধিষ্ঠিত হতো। তবে তাদের অনেকে স্থানীয় নারীকে বিয়ে করেছিল প্রথম থেকেই।
শৈশব থেকে দেখেছি, ফেনী শহরে আমাদের বাসার পাশে একটি মুসলমান ধোপা পরিবারকে। তাদের মূল নিবাস নোয়াখালী সদরে, পুরনো শহর এলাকায়। ওরা ‘পেয়ারা’কে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতো ‘গইয়ম’ না বলে ‘গইভা’ বলে থাকে। তেমনি, পেঁপেকে স্থানীয় ভাষার ‘কাঁইয়া’ না বলে অভিহিত করে ‘পপইয়া’ বা ‘হাকইয়া’ হিসেবে। এ কথা দুটি এসেছে যথাক্রমে এঁধাধ এবং চধঢ়ধুধ থেকে। এগুলো আমাদের কাছে ‘ইংরেজি ভাষা থেকে আগত’ বলে পরিচিত। শব্দদ্বয়ের উৎস পর্তুগিজ ভাষা। প্রশ্ন হচ্ছে, নোয়াখালীর সেই অশিক্ষিত মুসলিম পরিবারে পর্তুগিজ প্রভাব আজও কিভাবে বজায় রয়েছে? হতে পারে ওদের পূর্বপুরুষ পর্তুগিজ সান্নিধ্যে এসেছিল কোনো এক সময়ে। অবাক করা বিষয়, সাধারণত দেশীয় খ্রিষ্টানদের ছাড়া অন্যদের ওপর খ্রিষ্টান পর্তুগিজদের প্রভাব বেশি বহাল নেই। বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে রোমান ক্যাথলিকরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর একটা বড় কারণ, এ দেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে অগ্রণী ছিলেন রোমান ক্যাথলিক পর্তুগিজরা। তারা বাংলাভাষার নানামুখী বিকাশেও অবদান রেখেছেন। লক্ষ করার বিষয়, ক্ষুদ্র পর্তুগাল এই সুদূর বাংলাদেশে যতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, তার প্রতিবেশী ও অপেক্ষাকৃত বৃহৎ দেশ, স্পেন তা পারেনি। এর মূল কারণ, স্পেনের লোকেরা ভারত আবিষ্কারে উঠেপড়ে লাগলেও শেষ পর্যন্ত তাদের উপনিবেশগুলো সাধারণত পশ্চিম গোলার্ধে। স্পেনীয়রা ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমূহ এবং লাতিন আমেরিকায় (ব্রাজিল বাদে) উপনিবেশ স্থাপনে জোর দিয়েছে এবং এতে সফল হয়েছে।
পর্তুগিজ জাতির লোকজন সম্পর্কে ‘বাংলা পিডিয়া’তে লিখেছেন অনিরুদ্ধ রায়। এশিয়াটিক সোসাইটির এই বিখ্যাত ‘জাতীয় জ্ঞানকোষ’-এর ৫ম খ-ে লেখাটি রয়েছে। এতে জানানো হয়, ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই সর্বপ্রথম বাংলায় আগমন করেছিল। তাদের দুঃসাহসিকতাপূর্ণ সামুদ্রিক অভিযাত্রার সূচনা পনেরো শতাব্দীর গোড়ায়।
আমাদের জানা আছে, পর্তুগালের নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে দক্ষিণ ভারতের কালিকটে এসে পৌঁছেছিলেন। ভারতের কেরালা রাজ্যের এ বন্দরটির বর্তমান নাম ‘কোঝিকোদে’। যা হোক, ভাস্কো-দা-গামার কয়েক দশক পরে বাংলা অঞ্চলে পর্তুগিজদের আগমন। জানা গেছে, এশিয়া মহাদেশের মসলা সংগ্রহের লক্ষ্যে ইতালির ভেনিস বন্দর এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী আরবদের এড়িয়ে বিকল্প রুট অবলম্বন করে পর্তুগিজরা। ফলে তারা বাংলায় আসতে সফল হয়। তাদের জাহাজগুলো হতো হালকা ও দ্রুতগামী এবং পরে তারা যন্ত্রব্যবহার করে অক্ষাংশ নির্ধারণেও সফল হয়। এতে সমুদ্রযাত্রা অনেক সহজ হয়েছিল। তাদের রাজা জোয়াও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। পর্তুগিজরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা পয়েন্ট অধিকার করে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। এ সময়ে তারা চাল ও কাপড়ের ব্যবসায়ে ছিল সফল। ১৫১২-১৩ সালে বাংলার সাথে পর্তুগিজ যোগাযোগ ঘটে। ‘রেনেলের ম্যাপ’ বিখ্যাত হলেও এতে এশিয়ার কেবল উপকূলের উল্লেখ ছিল; কোনো দ্বীপ বা বন্দরের নাম ছিল না। তাই পর্তুগিজরাও সম্যক ধারণা পায়নি এ ব্যাপারে। এর মধ্যে লোপো সুয়ারেজ নিয়োগ পান পর্তুগালের তৎপরতা পরিচালনার জন্য। তার সময়ে রাষ্ট্র আর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ না করায় বাংলায় পর্তুগিজরা আসার সুযোগ পেয়েছে।
কারভালহো নামের সাধারণ এক লোক পর্তুগিজ রাজার আনুকূল্যে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে বাংলায়। তারা আরাকানি মগদের একটি হামলার মোকাবিলা করলেও নিজেরাই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই পর্তুগিজরা আধা স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য শ্রীপুর বাকলা (দক্ষিণ উপকূলস্থ) ও যশোরে জায়গির লাভ করা ছাড়াও সেনা ও নৌবাহিনীতে চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা পেয়েছিল। এক পর্যায়ে কারভালহো মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমে আহত হন। তিনি আরোগ্য লাভ করেন যে হুগলিতে, সেখানে পর্তুগিজ দুর্গ ছিল বলে রেভারেল্ড লং ও কাফি খান মনে করেন। কারো মতে, কারভালহো একটি মোগল দুর্গ দখল করেছিলেন। অপর দিকে মগরা চাটগাঁতে দুর্গ বানিয়ে এর চারধারে আবাস গড়ার সুযোগ দিয়েছে পর্তুগিজদের। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার মহকুমা শহর ডায়মন্ড হার্বারসহ কোথাও কোথাও পর্তুগিজ দুর্গ ছিল। আমাদের অনেকে সাতক্ষীরার রাজা প্রতাপাদিত্যের কথা শুনেছেন। তিনি কয়েকজন পর্তুগিজসহ কারভালহোকে নাকি অন্তরীণ করে রেখেছিলেন। বর্তমান সাতক্ষীরা অঞ্চলেও তাদের বসতি গড়ার উল্লেখ রয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহ-অনাস্থার দরুন পুলিশ প্রধান (পর্তুগিজ) নিহত হয়েছিলেন।
পর্তুগিজদের কিছু নেতিবাচক দিকের উল্লেখ পাওয়া যায় নথিপত্রে। তাদের অনেকের জীবন-যাপন ছিল অসংযত। তারা অনেক সময়ে দাস ব্যবসায়ে নিয়োজিত হতো। মগদের সাথে মিলে ওরা জলদস্যুবৃত্তিও করে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মগদের নিয়ে দ্রুতগামী নৌযানে এসে হামলা চালিয়ে তারা বাংলা উপকূলের লোকজন ধরে নিয়ে দাস বানাত। এ অবস্থায় জনগণের ঘৃণাই ছিল তাদের স্বাভাবিক প্রাপ্তি। ইতিহাসবিদ শিহাবুদ্দীন তালিশও এর উল্লেখ করতে ভোলেননি।
কলকাতার সুলেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দক্ষিণবঙ্গের একজন দেশী খ্রিষ্টান শাসককে নিয়ে লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বহুলালোচিত গনজালভেসের কথা। অতীতের ইউরোপীয় পর্যটক বার্নিয়ের তার উল্লেখ করেছন। তার পুরো নাম সেবাস্টিয়ান গনজালেস টিবিউ। সে ছিল জলদস্যু বাহিনীর হোতা। প্রথমে তাদের স্বাগত জানিয়ে গির্জা তৈরি ও ধর্মান্তরিত করার সুযোগ দিলেও মোগল বাদশাহ আকবরের পরবর্তী সময়ে পর্তুগিজ ও জেসুইট খ্রিষ্টানদের প্রতি স্থানীয় জমিদারদের মনোভাব ছিল বিরোধিতার। আসলে ‘দস্যুতা ও দাসত্ব’ ছিল এর কারণ।
একসময়ে সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ভোলা, প্রভৃতি দ্বীপসহ বৃহত্তর নোয়াখালী ও বরিশালের বিরাট জনপদ ছিল পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে। তারা বৃহত্তর ফরিদপুর ও যশোরেও প্রভাব বিস্তার করে। লেখক সুনীল গাঙ্গুলির আদিবাস বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর অঞ্চলে। হয়তো তাই পর্তুগিজদের নিয়ে তার লেখা ছিল আকর্ষণীয়। এদিকে, দস্যু গনজালেস শাসক ফতেহ খানকে হত্যা করে সন্দ্বীপ পুনর্দখল করে নেন। তিনি সন্দ্বীপের স্থানীয় সব মুসলিম পুরুষকে হত্যা করারও অভিযোগ রয়েছে। স্মর্তব্য, ফতেহ খান পর্তুগিজ শাসক মানুয়েল দা মাত্তুর মৃত্যুর পর সন্দ্বীপ দখল করেছিলেন।
গনজালেস সন্দ্বীপকে প্রধানত লবণের ব্যবসা কেন্দ্র বানালে সুদূর দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ীরাও এখানে আসতে থাকেন। গনজালেস এক পর্যায়ে ভোলা দখল করে বরিশালের ভূস্বামীর নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটান। এদিকে, মোগল নওয়ারা (নৌবহর) তাকে দমনের জন্য এগোচ্ছিল। ধূর্ত গনজালেস তখন আরাকানের পলাতক মগরাজার মেয়েকে বিয়ে করেন এবং এ রাজার সাথে মিলে একযোগে হামলা চালিয়ে নোয়াখালী দখল করে নেন। মোগলরা সুকৌশলে পর্তুগিজ ও মগদের সাথে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে মগদের পরাস্ত করে। পর্তুগিজ দস্যু গনজালেস আরাকানের জাহাজ দখল করে নেয় এবং পর্তুগিজ অধ্যুষিত গোয়াকে অনুরোধ জানায় আরাকান দখলের জন্য। তবে পর্তুগালের মতো আরেক ইউরোপীয় শক্তি নেদারল্যান্ডসের ডাচরা আরাকানের পক্ষে নেমে গোয়ার ১৬টি জাহাজকে হারিয়ে দেয়। এ অবস্থায় গনজালেস সন্দ্বীপের দিকে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয় এবং ১৬১৬ সালে আরাকান বাহিনী তাকে পরাজিত করে।
ভারতের পূর্ব উপকূলের পর্তুগিজ বণিকরা তাদের নিজেদের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল এবং স্থানীয়ভাবে কর দিয়ে সুবিধা ভোগ করত। ১৫৮০ সালের দিকে কিছু পর্তুগিজ ঢাকা ও গাজীপুরে বসতি বানায়। তারা এখান থেকে সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র, তুলা ও সিল্ক রফতানি করত সুদূর ইউরোপেও। যা হোক, অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনা অবধি কোনো কোনো স্থানে পর্তুগিজ গির্জার পাশাপাশি তাদের বসতিও ভালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালী অঞ্চলে এটা দেখা গেছে, সপ্তদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় ছিলেন কোনো কোনো ধনাঢ্য পর্তুগিজ ব্যবসায়ী। নোয়াখালীর তখন নাম ছিল ‘ভুলুয়া পরগনা’। সেখানে পর্তুগিজ প্রভাবে প্রধানত হিন্দুদের অনেকেই ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হয়ে যান যার অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান।
আসলে পর্তুগিজদের প্রধান বসতি ছিল চাটগাঁতে। কিন্তু আরাকানের মগরা সে এলাকা দখল করে নিলে বসতি হয়ে ওঠে পঃবঙ্গের হুগলি। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ক্যারাল এর প্রশংসা করেছেন। মোগলদের সে সময়ের এক লাখ টাকা শুল্ক দেয়াই প্রমাণ করে, পর্তুগিজরা লবণের কারবারে কত বেশি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। হুগলিতে যখন পর্তুগিজদের রমরমা ব্যবসায় তখন পাশ্চাত্যে প্রতিবেশী স্পেনের দাপটে পর্তুগাল তার সাম্রাজ্য টিকাতে পারছে না। সেটা সতেরো শতকের তৃতীয় দশক। অপর দিকে সিংহল বা শ্রীলঙ্কা থেকেই পর্তুগিজদের গভর্নর পূর্বাঞ্চল শাসন করছিলেন। কিন্তু তারা ডাচদের কাছে ক্রমশ দখল হারাচ্ছিলেন। তবুও পর্তুগিজদের পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ কিংবা সুষ্ঠু নীতিমালা অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। পর্তুগিজ রাজার নিয়োজিত ‘ক্যাপ্টেন’ হুগলির বসতি পরিচালনা করতেন। ধনবান পর্তুগিজরা হুগলি ও গোয়াতে অসংযত জীবন কাটাতেন। অনেক পর্তুগিজ ভারতীয় শ্রমিকদের কাজ দেখাশুনা করত। অন্য দিকে, পর্তুগিজ যাজকগোষ্ঠী সমাজে ‘সর্বোচ্চ স্তরের লোক’ বলে বিবেচিত হওয়ায় তাদের কোনো অপরাধের বিচার হতো না। তবে তা একদা করা হয়েছে গোয়ায়। পর্তুগিজরা বাঙালি শ্রমজীবীদের বলত ‘গরিব’। এই বাঙালিরা পর্তুগিজদের বিষয়ে অনাগ্রহী ছিল।
এক সময়ে পর্তুগিজরা নৌবহর দিয়ে মোগল সম্রাটকে সাহায্য করত। পরে তারা সে পক্ষ ত্যাগ করে। মোগলরাও মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু বিতাড়নে ছিল মরিয়া। এ অবস্থায় তারা ১৬৩২ সালে হুগলির পর্তুগিজ এলাকা দখল করে নেয়। তখন কামান যুদ্ধে অনেক পর্তুগিজ নিহত হয়। তবে পরে তারা হুগলিতে ফিরে আসে। দাবি করা হয়, সম্রাট শাহজাহান তাদের ৭৭৭ বিঘা ভূমি দিয়েছিলেন। অবশ্য, অনেকের মতে, বাংলার সুবাদার সুজা পর্তুগিজদের আনুকূল্য দেন। আবার, বাংলার অগাস্টাইন এবং গোয়ার জেসুইট খ্রিষ্টানরা একই ধর্মের লোক হলেও এই পর্তুগিজদের নামে শান্তিচুক্তি সম্পাদনও উল্লেখ করার বিষয়।
ইতালীয় পর্যটক নিকোলা মানুচি ১৬৬০ সালে ধনী পর্তুগিজদের হুগলিতে একচেটিয়া লবণ ব্যবসায় করতে দেখেছিলেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর পরই ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার বাংলায় ৯ হাজার পর্তুগিজের আর্থিক দুর্গতি লক্ষ করছেন। ১৬৭০ সালে বাংলার ২০ হাজার পর্তুগিজের অর্ধেকই কাজ করত প্রধানত হুগলির জাহাজে। আর ধনী পর্তুগিজরা মোটা অনুদান দিত গির্জা বানাবার কাজে। ১৭৬১ সালে গির্জা পুনর্নির্মাণের কাজে একজন ধনীর অনুদান থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
আলোচিত গনজালেসের প্রস্তাব সত্ত্বেও চাটগাঁর উপকূল পর্তুগিজ দস্যুবৃত্তির জন্য ‘মুক্ত’ ছিল। এরা মূলত সন্দ্বীপকে ঘাঁটি বানিয়ে এবং মগদের সাথে নিয়ে, দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যায়। তবে তাদের এহেন মিত্রতা ছিল অস্থায়ী। তদুপরি, পর্তুগিজদের একটা বিরাট অংশ ১৬৬৬ সালের ২৬ জানুয়ারি মোগলদের সাহায্য করেছিল চট্টগ্রামের বিজয়ে। এমনকি ১৬৮১ সালে সন্দ্বীপকে আরকানি তথা মগদের হাত থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রেও তারা মোগলদের সহায়তা করে। তবে দাবি করা হয়, তদানীন্তন বঙ্গীয় সুবাদার এবং মোগল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শায়েস্তা খান পর্তুগিজদের একাংশকে হত্যা করেন এবং অন্য অংশকে ঢাকার দিকে পাঠিয়ে দেন। নিকোলা মানুচির এমন বক্তব্যকে লেখক অনিরুদ্ধ রায় ‘সমর্থনযোগ্য নয়’ বলে অভিহিত করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকেও পর্তুগিজদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। ওই শতকের গোড়ার দিক থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার দেয়াং এবং বন্দরনগরীর ফিরিঙ্গি বাজার ও জামালখানের মতো এলাকায় পর্তুগিজ বসতি ছিল বলে জানা যায়।
এক সময়ে পর্তুগিজরা বসতি গুটিয়ে ইংরেজ ও ফরাসিদের এলাকায় গিয়ে থাকতে শুরু করে। তবে কলকাতার ইংরেজরা তাদের কর্মচারীদের আদেশ করে যে, তারা পর্তুগিজদের সাথে লেনদেন করতে পারবে না। ১৭৫০ সালের দিকে পর্তুগিজরা স্থানীয় রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হয়তো এ জন্য অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য আর না থাকা একটা কারণ। তাদের কিছু শংকর লোক (মেস্তিজো বা মেস্তিকো নামে পরিচিত) নবাবদের সৈন্য হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়।
এসব মিলিয়ে বাংলাপিডিয়াতে পর্তুগিজ সম্প্রদায় সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন অনিরুদ্ধ রায়। এর একটা বড় অংশ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ের বাইরের এলাকার সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়।
বাংলা ভাষায় বহু শব্দ পর্তুগিজ ভাষা থেকে নেয়া হয়েছে এবং এগুলো আমাদের ভাষায় স্থায়ী হয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত বই তারাই ছাপিয়ে ছিল। বাংলাপিডিয়া জানায়, প্রথম বাংলা ব্যাকরণ এবং বাঙলা অভিধান জনৈক পর্তুগিজ দ্বারা প্রণীত। তাদের কেউ কেউ ধর্মপুস্তক বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এমনকি, যশোর অঞ্চলের বাঙালি রাজপুরুষ দোম আন্তনিও খ্রিষ্টান হয়ে ধর্মীয় পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। ‘মনিব’ রোজারিও ব্যাকরণ, অভিধান ও নাটক রচনা করেন বাংলা ভাষায়। নাটকটি ১৭৪৩ সালে সুদূর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ছাপা হয়েছিল। পর্তুগিজরা এ উপমহাদেশের প্রথম প্রেস প্রতিষ্ঠা করে গোয়াতে, ১৭৫৬ সালে।
উপরে উল্লিখিত অনিরুদ্ধ রায়ের ভাষায়, ‘পর্তুগিজরা বিদেশী ফল, ফুল এবং গাছের চারা নিয়ে এসেছিল যেগুলো বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। তাদের নিয়ে আসা ফলের মধ্যে রয়েছে গোল আলু, কাজু বাদাম, পেঁপে, আনারস, কামরাঙ্গা, পেয়ারা। এ সবই কৃষি উদ্যান পালনের প্রতি তাদের আগ্রহের পরিচয় বহন করে। তাদের নিয়ে আসা এসব ফল ও আলফন্সো আম বাঙালি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এমনকি, নানা রঙের কৃষ্ণকলির চারাও পর্তুগিজদেরই অবদান।’
আমার নিজের জন্ম নোয়াখালী শহরে যদিও বাড়ি ওখানে নয়। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে আমাদের পরিবার সেখানে থাকত। মায়ের কাছে শুনেছি, চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে আমার বড় বোনের গৃহশিক্ষিকা ছিলেন আগাথা গনজালেস। তিনি স্থানীয় খ্রিষ্টান এবং রোমান ক্যাথলিক। গনজালেস, গোমেজ ডি সুজা প্রভৃতি নাম পর্তুগিজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী।
আমার এক বোনের শ্বশুরবাড়ি নোয়াখালীর দক্ষিণাংশে। সেখানে আজও পর্তুগিজ প্রভাব এমনকি, গ্রামীণ মুসলিম সমাজেও অনুভূত হয়। যেমন, একবার সেখানকার এক মুসলমান কিশোরকে দেখলাম, সে বাতাবি লেবু বা জাম্বুরাকে বলছিল ‘সান্তারা’। এটা পর্তুগিজ শব্দ বলে জানা যায়।
ইউনিভার্সিটিতে সহপাঠীদের মধ্যে একজন ছিল নোয়াখালীর দক্ষিণাংশের। ধর্মে ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তারা নামই ইঙ্গিত দেয় যে, পর্তুগিজ সংস্কৃতির সাথে তারা কত বেশি ঘনিষ্ঠ। সেখানকার খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের পূর্ব পুরুষ যা-ই হোক, তাদের অনেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আজকাল সর্বাধুনিক যুগে বড় বড় শহরে কোনো কোনো মুসলিম মেয়েকে সাইকেল চালাতে দেখা যাচ্ছে। নোয়াখালীর মত মফঃস্বল শহরে ব্রিটিশ আমলেও খ্রিষ্টান মেয়েরা সাইকেল চালিয়েছে বলে জানা যায়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত বহু শব্দই মূলত পর্তুগিজ কিংবা সে ভাষা থেকে আগত। এটা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। যেমন, মাত্র শেষ হয়ে গেল যে শীতকাল, সে মৌসুমের অন্যতম প্রধান সবজি কপি (ফুলকপি, বাঁধাকপি কিংবা ওলকপি) এ শব্দটা এসেছে পর্তুগিজ ঈড়াব থেকে। আমরা পিরিচে করে চা-নাশতা করি; সেটাও পর্তুগিজ চরৎবং থেকে এসেছে। ইস্ত্রি, ইস্পাত, মেয়েদের সায়া, বন্দুকের কার্তুজ, কামরা (কক্ষ), কাফ্রি (কৃষ্ণাঙ্গ), পিপা, তামাক, তামা (ধাতু বিশেষ), আনারস, আচার, পাদ্রি, আয়া, আলকাতরা, আলপিন, আলমারি, বোতল, বোতাম, বালতি প্রভৃতি অজস্ত্র দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি কিংবা সংস্কৃতি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাবের কথা সবার জানা। এর আর্থ-রাজনৈতিক, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক নানা কারণ রয়েছে। কিন্তু কয়েকশ’ বছর পরেও পর্তুগিজ প্রভাব এ দেশে বিদ্যমান থাকা সহজ নয়।