ব্যাঙ
ব্যাঙ - ছবি সংগৃহীত
আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার আন্টির বিবাহ-পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী ছিলাম। যদিও কারো সামনে আমি তা প্রকাশ করিনি কখনো। আমার বাবা, ভাইয়েরা এবং ভাবীরা আমার অনুভূতিকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করত। এটা আসলে আমাদের কারো দৃষ্টিতে কোনো ভালো বিয়ে ছিল না। আমরা ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি আন্টি তার হাসব্যান্ড খুঁজে আসছে। ওয়াং জিয়াওটির সাথে তার সম্বন্ধ আমাদের পরিবারের জন্যে গৌরব বয়ে নিয়ে এসেছিল কিন্তু তা শেষ হয়েছিল অগৌরবের মধ্য দিয়ে। এর পরের জন ছিলেন ইয়াং লিন। অবশ্য ওয়াংএর মতো যোগ্য পাত্র ইনি ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বড় কর্মকর্তা, যা তাকে পাত্র হিসেবে নির্বাচনে উতরে যাওয়ার যোগ্যতা দিয়েছিল। হা-কপাল, আন্টি কিন হিকে বিয়ে করতে পারত, যে তার জন্যে পাগল ছিল; বরং এ বিয়েটা হাও ডাসুর সঙ্গে বিয়ের চেয়ে ভালো হতো। আমরা তখন ধরেই নিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত সে একজন বুড়ো-বালিকা হয়েই থাকবে। এমনকি আমরা এও আলোচনা করেছিলাম যে, যখন সে বুড়ি হয়ে যাবে তখন তার দেখাশুনাই বা করবে কে। কিন্তু সে আমাদের সব আন্দাজ উলোট পালোট করে দিয়ে বিয়ে করে বসলো হাও ডাসুকে। ছোট্ট লিওন ও আমি তখন বাস করছিলাম বেইজিংএ। খবরটি যখন আমরা শুনলাম তখন আমরা যেন আমাদের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাদের সব কল্পনা যখন ভেস্তে গেল তখন আমরা একবারে বিষণ্ন হয়ে পড়লাম।
অনেক বছর পর, আন্টি ‘চন্দ্র-শিশু’ নামক এক টিভি প্রোগ্রামে তারকা হয়ে উদিত হলো, যে প্রোগ্রামটি বস্তুত ছিল ভাস্কর হাও ডাসু সম্বন্ধে, যদিও টিভি-ক্যামেরাটি সব সময় আন্টির ওপরই তাক করা ছিল। আন্টি হাও ডাসুর উঠানে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝাঁকিয়ে সাংবাদিকদেরকে এই কথা বলে যাচ্ছিল: ‘যদি আপনারা জানতে চান কেন আমি হাও ডাসুকে বিয়ে করেছিলাম তাহলে আমাকে শুরু করতে হবে তার ওয়ার্কশপের ব্যাঙ-ভ্রমণ দিয়ে এবং তার স্টোররুম দিয়ে যেখানে সে তার মাটির প্রতি মাসমূহ রাখত, যখন সে তার ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর চুপচাপ বসে থাকত তখন তার চোখগুলো জ্বলজ্বল করতো এবং তার মুখাবয়বে ফুটে উঠত একটা স্বপ্নাচ্ছন্ন অশ্বের মতো ফাঁকা দৃষ্টি। সমস্ত জাতশিল্পীই কি স্বপ্নাচ্ছন্ন বৃদ্ধ ঘোড়ায় পরিণত হয় যখন তারা বিখ্যাত হয়ে ওঠে?’ আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হাও ডাসুর নাম আমার কানে বারবার বাজতে থাকলো যদিও আমি কয়েকবারই মাত্র তাকে দর্শন করেছিলাম। যে রাত্রে আমার ভাইপো ঝিয়ানকুয়ান তার পাইলটের চাকরি পাওয়া উপলক্ষে ডিনার পার্টির আয়োজন করেছিল সেই রাত্রে আমি তাকে শেষ দেখেছিলাম। এরপর এই প্রথম আমি তাকে দেখলাম টিভির পর্দায়। তার চুল এবং দাঁড়ি সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু তার শরীর যেমন ছিল তেমনটিই আছে। সেই টিভি প্রোগ্রামের সুবাদেই আমরা জানতে পারলাম আন্টি কেন হাও ডাসুকে বিয়ে করেছিল।
আন্টি একটা সিগারেট ধরাল, ধরিয়ে বড় একটা টান দিলো, তারপর কথা বলা শুরু করল। বিষণœতা হামাগুঁড়ি দিচ্ছিল তার কণ্ঠে। সে বলে চলল, ‘বিয়ে নির্ধারিত হয় স্বর্গে। এ কথার দ্বারা আমি যুবসমাজকে ধর্মীয় আদর্শের দিকে ডাকছি না কারণ আমিও এক সময় প্রচণ্ড বস্তুবাদী ছিলাম। কিন্তু যখন বিয়ের প্রসঙ্গ আসে তখন অদৃষ্টের ওপর বিশ্বাস না করে আপনার কোনো উপায় নেই।’ সে হাও ডাসুকে দেখিয়ে বললো, ‘তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। আপনি কি মনে করেন সে কখনো আমাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল?’
‘১৯৯৭ সালে আমার বয়স যখন ষাট বছর’, সে বলে চলল, ‘আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে বলেছিল, আমি আসলে রিটায়ারমেন্টে যেতে চাই কিনা। কিন্তু আমি কোনো জবাব দিইনি। আপনি হাসপাতালের পরিচালককে চেনেন, সেই অকৃতজ্ঞ জারজ হুয়াং জান, হেক্সি গ্রামের হুয়াং পির পুত্র। কে ধারণা করতে পেরেছিল যে, মায়ের পেট থেকে বের হয়ে সে মেলন হুয়াং হয়ে যাবে? সে কিছুদিন একটা মেডিক্যাল স্কুলে কাটিয়েছিল এবং যখন সে পাস করে বের হয়েছিল তখন সে সিরিঞ্জ দিয়ে ধমনী খুঁজে পেত না, স্টেথোসকোপ দিয়ে হার্ট খুঁজে পেত না এবং যখন সে কোনো রোগীর নাড়ি দেখত তখন সে নাড়ির কোনো নাগালও পেত না। কী কারণে যে তাকে হাসপাতালের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল! সে স্বাস্থ্য-ব্যুরোর পরিচালক শেনকে আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে সুপারিশ করেছিল। হতভাগ্য এই প্রাণীটির মেধা ছিল সীমিত। সে শুধু জানতো কিভাবে অতিথিসেবা করতে হয়, উপহার দিতে হয়, পশ্চাৎ দেশে চুমু খেতে হয় এবং মহিলাদের পটাতে হয়।’
এই পয়েন্টে এসে আন্টি তার বুকে জোরে একট থাবড়া মারল এবং সজোরে পদ সঞ্চালন করতে লাগল। সে রাগত স্বরে বলে উঠল, ‘কি বোকাটাই না আমি ছিলাম! নেকড়ে বাঘকে আমি ঘরে ঢুকতে দিয়েছিলাম। আমি তার জন্য হাসপাতালের সমস্ত মেয়ের সাথে মেলামেশা করার পথ সহজ করে দিয়েছিলাম। ওয়াং ঝিয়াওমেই নামে ১৭ বছরের একটা মেয়ে ছিল, যে এসেছিল ওয়াং গ্রাম থেকে। তার খুব সুন্দর ঘন চুলের বিনুনি ছিল, মিষ্টি গোলাকার মুখ ছিল এবং গজদন্তের মতো রঙ ছিল তার গায়ের। তার চুলগুলো প্রজাপতির ডানার মতো উড়ত। তার চোখগুলো যেন কথা বলত। কেউ যখন তাকে দেখত তখন সে বিশ্বাস করত যে, চলচ্চিত্র পরিচালক ঝাং ইয়ামু যদি তাকে আবিষ্কার করতেন তাহলে সে গং লি কিংবা ঝাং জিয়ির চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠত।
দুঃখের কথা হলো, কামার্ত শয়তান মেলন হুয়াং-ই প্রথম তাকে আবিষ্কার করে। সে ওয়াং গ্রামে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে সে ঝিয়াওমেইর মাতাপিতার সাথে এমনভাবে কথা বলে যা শূনে মৃতরা পর্যন্ত বেঁচে ওঠে। সে তাদের বোঝায় যাতে তারা তাকে তার হাসপাতালে পাঠায় এই জন্য যে, সে আমার কাছ থেকে মেয়েদের সমস্যা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারবে। সে বলেছিল যে, সে আমার ছাত্রী হবে কিন্তু একটা দিনও সে আমার সাথে কাটায়নি। পরিবর্তে সে সবসময় তাকে তার সাথেই রাখত এবং রাতের বেলা তার প্রেমিকা করে রাখত। এটাও যথেষ্ট খারাপ কাজ ছিল না। পরে সে এর চেয়ে খারাপ কাজ শুরু করে। সে দিনের বেলাতেও সবার সামনে তার সাথে ফস্টিনস্টি করা শুরু করে। সে প্রায়ই বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করত বড় বড় কর্মকর্তাদের সৌজন্যে। সে ওয়াং ঝিয়াওমেইকে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য পেশ করত। তার লক্ষ্য ছিল কর্মকর্তাদের খুশি করে বড় কোনো শহরে বদলি হওয়া। আপনি হয়তো দেখেননি, সে দেখতে ঠিক কেমন ছিল। তার মুখটা ছিল বানরের মতো লম্বা, ঠোঁটগুলো কালো, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস জন্তু-জানোয়ারের মতো। কিন্তু সে সেই চেহারা নিয়ে স্বাস্থ্য-ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। প্রত্যেকবারই ঝিয়াওমেইকে সে পানোন্মত্ত করে রাখত এবং তাকে অফিসারদের বিনোদন দেয়ার কাজে নিয়োজিত রাখত। ঝিয়াওমেই ছিল তার পক্ষ থেকে অফিসারদের জন্য একটা উপহার। শয়তান! খাঁটি শয়তান যাকে বলে সে ছিল তাই।
‘একদিন সেই ছোট্ট শয়তানটি আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠাল। অন্য মহিলারা, যারা হাসপাতালে কাজ করত, তার অফিসে থাকতে ভয় করত। কিন্তু আমি ভয় পাওয়ার পাত্র ছিলাম না। আমি আমার সঙ্গে একটি ছোট্ট ছুরি রাখতাম এবং তা সেই জারজের ওপর ব্যবহার করতে মোটেই ইতস্তত করতাম না। যাহোক, সে পেয়ালায় চা ঢালল, মিটমিট করে হাসলো এবং টেবিলের ওপর তা রাখল। ‘পরিচালক হুয়াং, আমাকে তুমি কিভাবে দেখতে চাও? চলো আমরা আসল পয়েন্টে চলে যাই।’ সে দাঁত বের করে ‘হে-হে’ করে হাসতে হাসতে বলল, ‘বড় আন্টি-’ সে আমাকে বড় আন্টি বলল কী বলল না তার আমি থোড়াই পরওয়া করি- ‘যেদিন আমি জন্মেছিলাম সেদিন তুমি আমাকে মায়ের পেট হতে বের করে এনেছিলে। এবং তুমি দেখেছ কিভাবে আমি সাবালকত্ম প্রাপ্ত হয়েছি। কেন, আমি তো তোমার ছেলেও হতে পারতাম। ‘হে হে’- ‘আমি এ ধরনের সম্মানের উপযুক্ত নই’, আমি বললাম। ‘তুমি বিরাট একটি হাসপাতালের পরিচালক যেখানে আমি মাত্র সাধারণ একজন মহিলাবিষয়ক ডাক্তার। তুমি যদি আমার ছেলে হতে, এই সম্মানে তখনই আমি মারা যেতাম। সুতরাং দয়া করে আমাকে তোমার মনের কথাটা বলে ফেল।’ সে আরো বেশি হে হে করে হেসে উঠে যে-লজ্জাকর কারণের জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল তা প্রকাশ করে দিল, ‘আসলে সব নেতৃত্বদানকারী ক্যাডাররা যে ভুলটা করে আমিও সেই রকম একটা ভুল করে বসেছি- ওয়াং ঝিয়াওমেই তো গর্ভবতী হয়ে পড়েছে।’
‘ধন্যবাদ!’ আমি বললাম। ‘এখন ঝিয়াওমেই তোমার ড্রাগনবীজ বহন করছে, এ হাসপাতালে তোমার নেতৃত্ব বংশ পরম্পরায় চলার পথ পাকাপোক্ত হলো দেখছি।’ ‘আমাকে উপহাস কোরো না, বড় আন্টি। গত কয়েক দিন ধরে দুশ্চিন্তায় আমি খেতেও পারছি না, ঘুমাতেও পারছি না।’ আপনারা কী বিশ্বাস করেন নাকি যে, জারজটা সত্যি সত্যিই খাওয়ার ও ঘুমানোর সমস্যায় আছে? ‘সে দাবি করছে যে, আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিই, এবং যদি তা না দিই, তাহলে সে আমাকে হুমকি দিয়েছে যে, কাউন্টি ডিসিপ্লিন কমিশনের কাছে সে রিপোর্ট করবে।’ ‘তাই?’ আমি বললাম। ‘আমি মনে করি দ্বিতীয় স্ত্রী এখনকার দিনে কর্মকর্তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একটা ভিলা কিনে ফেল, সেখানে তাকে বসবাস করতে দাও।’ সে বলল, ‘আমি তোমাকে বলছি, বড় আন্টি, আমাকে নিয়ে তামাশা করো না। আমার যদি ভিলা কেনার সামর্থ্য থাকেও, তবুও আমি পাবলিকের সামনে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্ত্রী রাখতে পারব না।’
‘তাহলে এগিয়ে যাও এবং তালাক দাও’, আমি বললাম। সে তার বাঁদর-মুখটা আরো লম্বা করে বলল, ‘বড় আন্টি, তুমি ভালো করেই জানো যে, আমার শ্বশুর মশাই ও শুকরের কসাই শালারা সব দুর্ধর্ষ খুনি। তারা যদি এটা জেনে যায় তাহলে আমার আর রক্ষে নেই।’ ‘কিন্তু তুমি তো একজন পরিচালক, একজন কর্মকর্তা!’ ‘যথেষ্ট হয়েছে, বড় আন্টি। তোমার বৃদ্ধ দৃষ্টিতে হাসপাতালের পরিচালক পদটি অত্যন্ত নগণ্য, কিন্তু শহরজুড়ে এটি উচ্চ আওয়াজের বায়ু নিক্ষেপের মতো গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং তামাশা বাদ দিয়ে তুমি এগিয়ে এসে কেন আমাকে সাহায্য করছ না?’ ‘আমি আবার তোমার কোন পূজায় আসব?’ সে বলল, ‘ঝিয়াওমেই তো তোমাকে খুব সমীহ করে। অনেকবার এ কথা সে আমাকে বলেছে। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যার কথা সে শুনবে।’ ‘তুমি আমার কাছে কী চাও?’ ‘তুমি তাকে ডেকে নিয়ে বলো সে যেন অ্যাবর্সন করে ফ্যালে।’ আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, মেলন হুয়াং, আমি এই হাত দিয়ে আর ওই পাপকর্মটি করব না। সারা জীবন ধরে এ পর্যন্ত আমি দুই হাজার গর্ভপাত ঘটিয়েছি। এটা আর আমি কখনো করব না। তুমি তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি পিতা হচ্ছো। ঝিয়াওমেই খুব সুন্দরী বালিকা। সে নিশ্চয়ই তোমাকে সুন্দর একটি ছেলে বা মেয়ে উপহার দেবে। তা তোমাকে সুখী করা উচিত। তুমি তার কাছে যাও, তাকে গিয়ে বলো, সময় হলে আমি তার শিশু ডেলিভারি করে দেবো।’
‘এই কথা বলে আমি তার অফিস থেকে বের হয়ে এলাম আত্মতৃপ্তির সাথে। কিন্তু সেই অনুভূতি টিকে থাকল খুবই অল্প সময়। আমি আমার অফিসে এসে যখন এক গাস পানি পান করলাম তখন আমার মুড গেল অব হয়ে। মেলন হুয়াং-এর মতো ব্যক্তির উত্তরাধিকারী থাকা মানায় না, আর এটা কি লজ্জার কথা যে, ঝিয়াওমেই এই জানোয়ায়ের শিশু তার পেটে বহন করে চলেছে। আমি ডেলিভারির অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, একটা শিশু ভালো হবে, না মন্দ হবে- তা নির্ভর করে জন্মদাতার স্বভাবের ওপর, লালন পালনের ওপর নয়। আপনি হয়তো উত্তরাধিকার আইনের সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু এটাই সত্য যা আমি অর্জন করেছি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
‘আপনি শয়তান মেলন হুয়াংয়ের ছেলেকে বৌদ্ধ মন্দিরের মধ্যে রাখতে পারেন, সেখানে সে লম্পট সন্যাসী হিসেবে বড় হয়ে উঠবে। ওয়াং ঝিয়াওমেইর জন্যে আমি কতটা দুঃখ বোধ করেছি সেটা বড় কথা নয়। আমি আসলে চেয়েছি, ওই শয়তানটা যেন এই সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে না পারে।
‘কিন্তু ঝিয়াওমেই নিজেই আমার কাছে এলো। সে দুই হাত দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরল এবং তার চোখের পানি দিয়ে আমার পায়জামা নোংরা করে দিলো। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ‘প্রিয় আন্টি, সে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। সে আমাকে মিথ্যা বলেছে। সে যদি আমাকে বেহেস্তও দিয়ে দেয় তবু আমি এ জারজটাকে বিয়ে করব না। আমাকে সাহায্য করুন, আন্টি। আমি তার শয়তানী বীজ আমার মধ্যে রাখব না।’
‘সুতরাং এভাবেই সব হলো’ বলে আন্টি আরেকটি সিগারেট ধরালেন এবং জংলি মানুষের মতো তা টানতে থাকলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মুখ ধোয়ায় ঢাকা পড়ে যায়। ‘আমি তাকে ভ্রƒণ থেকে রক্ষা করলাম। একটি গোলাপ পুরোপুরি ফুটতে গিয়ে ঝরে পড়ে গেল। ওয়াং ঝিয়াওমেই এখন একজন বিনষ্ট, পতিত রমণী।’ আন্টি উঠে দাঁড়াল এবং তার অশ্রু মুছে ফেলে বলতে লাগল, ‘আমি শপথ করেছিলাম এই কাজ আমি আর কক্ষণও করব না, এই অ্যাবর্সনের কাজ, কোনো মহিলা তার পেটে যদি শিম্পাঞ্জির বাচ্চাও ধরে, তবুও না। কিন্তু সেই কাজ আবার আমাকে করতে হলো। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, গা ঘামতে লাগল, আমি চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করলাম। কাজটা করা যেই শেষ হয়ে গেল, অমনি আমি মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লাম।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, কথা বলার সময় আমাকে অনেকটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আসলে তো আমি বুড়ি হয়ে গেছি। এতসব কথার পরও, খেয়াল করেন, আমি কিন্তু হাও ডাসুকে কেন বিয়ে করলাম তা এখনো বলিনি। যাহোক, সপ্তম চান্দ্র্রমাসের পনেরতম দিবসে আমি ঘোষণা দিলাম যে, আমি রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি। কিন্তু সেই জারজ মেলন হুয়াং চাইলো আামি তার সঙ্গে থাকি এবং একটা স্বাভাবিক নিয়মে রিটায়ারমেন্টে যাই এবং এজন্যে সে প্যারোলে আমাকে প্রতি মাসে আট শত ইয়ান দেবে। আমি তার মুখে থুতু নিক্ষেপ করলাম, ‘বাস্টার্ড কোথাকার, তোমার জন্যে আমি যথেষ্ট করেছি। এই হাসপাতালে যখন মেয়েরা এবং মহিলারা আসে তখন তারা কেবল আমার জন্যই আসে। আমি যদি টাকার পেছনেই দৌড়োতাম তাহলে আমি প্রতিদিনই হাজার হাজার ইয়ান উপার্জন করতে পারতাম। তুমি কি মনে করো, মেলন হুয়াং, মাসিক আট শত ইয়ানের বিনিময়ে তুমি আমার শ্রম কিনে নিতে পারবে? একজন বিদেশী শ্রমিক আমার চেয়ে অনেক যোগ্য। আমি আমার অর্ধেক জীবন দাসত্ব করে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আমার বিশ্রামে যাওয়ার সময়। এবার আমি উত্তরপূর্বের গ্যাওমি শহরে চলে যাব।’ শুনে সে মর্মাহত হলো। দুই বছর ধরে সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আমাকে কষ্টের মধ্যে ফেলার। একজন মহিলা হিসেবে আমি সবই দেখেছি। যখন আমি ছোট্ট বালিকাটি ছিলাম তখনো আমি জ্যাপের মতো শয়তানদের দেখে ঘাবড়াইনি। আর এখন তো আমার বয়স সত্তরের ঘরে। কোনো জিনিস তাকে ভাবালো যে, তার মতো পিচ্চি একটা জারজকে দেখে আমি ঘাবড়ে যাব? ঠিক আছে, আসুন আমরা পেছন দিকে ফিরে যাই।
‘আপনি যদি জানতে চান আমি কেন হাও ডাসুকে বিয়ে করেছিলাম তাহলে আমাকে ব্যাঙ দিয়েই শুরু করতে হবে। আমি রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আমার কিছু পুরনো বন্ধু রাতের ডিনারে একত্রিত হয়েছিল। ডিনারের সময় আমি তেমন পানটান করিনি যদিও একটা সস্তা তরল পানীয় ছিল। ঝাই ঝিয়াওয়েক. হোটেল মালিক ঝাই বাইঝুয়ার ছেলে, ছোট্ট সাইজের একটা বোতল আমার সম্মানে এনে বলল, এটা পান করেন তাহলে উঠে দাঁড়াতে পারবেন। টেবিলের প্রত্যেকেই কেমন মাতলামি করছিল এবং কেউ উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। এমনকি ঝাই ঝিয়াওয়েকের চোখও মাথায় উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।’
আন্টি বলল যে, সে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। এসে হাঁটা শুরু করল হোটেল ডরমিটরির দিকে। পাশে ছিল একটা জলাবদ্ধ এলাকা। চাঁদের কিরণ পানির ওপর পড়ে কাচের মতো জ্বলজ্বল করছিল। ব্যাঙের কর্কশ ডাক কোরাসের মতো বাজতে থাকল জলাশয়টির সব পাশে। তারপর ব্যাঙগুলো তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ব্যাঙগুলো তাকে ঘিরে তরঙ্গ সৃষ্টি করল এবং এইভাবে আকাশ পর্যন্ত উঠে গেল। হঠাৎ করে চার দিকে নিস্তব্ধতা নেমে এলো, সেই নিস্তব্ধতা ভাঙতে থাকল কেবল পোকামাকড়ের ডাকে। আন্টি বলল যে, সে ওষুধ সরবরাহকারী হিসেবে কতবার ভ্রমণ করেছে এবং রাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত গেছে, কখনো কোথাও ভয় পায়নি। কিন্তু আজ রাতে সে ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ব্যাঙের কর্কশ ডাককে সবসময় ঢোল-পিটানির সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু আজ রাতে তার কাছে মনে হলো, এটা যেন মানুষের ক্রন্দনধ্বনি, যেন হাজার হাজার সদ্যজাত মানবশিশু একসাথে ক্রন্দন করছে।
সে বলল, শিশুর ক্রন্দনই ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ধ্বনি কারণ পৃথিবীতে আর কোনো ধ্বনিই এরকমভাবে মানুষের আত্মাকে জাগাতে পারে না। সেই রাত্রে যে তরল পানীয় সে পান করেছিল, সে বলল, তা তার শরীরে ঠাণ্ডা ঘাম ঝরিয়ে দিলো। ‘মনে করবেন না যে, পান করার কারণে আমি মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম কারণ পান করার সাথে সাথে আমার ঢেকুর উঠে গিয়েছিল এবং তার সাথে সাথে আমার মাথাধরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আমার মন আবার পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।’ সে যখন মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল তখন সে চাইল ব্যাঙের ওই রুক্ষ ডাকের হাত হতে পরিত্রাণ পেতে। কিন্তু কিভাবে? যতই সে চেষ্টা করুক না কেন, ব্যাঙের ওই কর্কশধ্বনি ক্রোক-ক্রোক- চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরতে লাগল। সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। রাস্তার আঁঠাল পৃষ্ঠদেশ তার জুতার সোলকে যেন টেনে ধরল এবং তার পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল। ব্যাঙগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতো তার ওপর আছড়ে পড়ল, তাকে ঘিরে ধরল তাদের ক্রোধোন্মত্ত কর্কশধ্বনি দিয়ে এবং তার মনে হলো ব্যাঙগুলো মুখ দিয়ে তার চামড়া কামড়ে ধরছে এবং হাত দিয়ে তার ত্বকে চিমটি কাটছে। সে যতই নিচের দিকে নেমে যেতে লাগল ততই সুতার আকারে ব্যাঙগুলো তাকে পেঁচিয়ে ধরতে লাগল। সে জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটার চেষ্টা করল কিন্তু তাতে বরং কাঁদার মাত্রাই বেড়ে গেল। আন্টি বলল যে, এখন সে মাটিতে হাত ও হাঁটু গুটিয়ে দিলো এবং ব্যাঙের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চলতে লাগল। এখন তার হাতে, হাঁটুতে কাদা লেগে একাকার হয়ে যেতে লাগল কিন্তু সে কিছুরই পরওয়া করল না, সেই অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে চলতে লাগল। সেই মুহূর্তে, সে বলল, অসংখ্য ব্যাঙ জলাশয়ের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তে লাগল এবং পদ্মপাতার ওপর থেকে ব্যাঙেরা লাফ দিয়ে পানির মধ্যে পড়ে চাঁদের আলোয় ঝকমক করতে লাগল। তাদের কারো রঙ গাঢ় সবুজ, কারো কারো রঙ সোনালি হলুদ: কোনোটা বেশ বৈদ্যুতিক শলাকার মতো বড়, কোনো কোনোটা খেজুরের মতো ছোট। কারো চোখ সোনার পাতের মতো, কারো চোখ লালচে শিমের মতো।
তারা যেন সাগরের ঢেউয়ের মতো তার ওপর আছড়ে পড়ল, তাকে ঘিরে ধরল তাদের ক্রোধোন্মত্ত কর্কশধ্বনি দিয়ে এবং তার মনে হলো ব্যাঙগুলো মুখ দিয়ে তার চামড়া কামড়ে ধরছে এবং হাত দিয়ে তার ত্বকে চিমটি কাটছে। যখন তারা তার পিঠের ওপর, ঘাড়ে এবং মাথার ওপর লাফাতে লাগল, তাদের ভারে সে কাঁদার ওপর পড়ে গেল। সে বলল, তার বড় ভয় ছিল না তাদের আঁচড়ের কারণে, বরং তার গায়ে যে তাদের ঠাণ্ডা অসহ্য বিরক্তিকর কর্কশ চামড়ার ঘষা লাগছিল এটাই তাকে ভয় পাইয়ে দিলো। ‘তারা আমার শরীর পেচ্ছাব দিয়ে ভরিয়ে দিলো, হতে পারে এগুলো আসলে বীর্যই ছিল।’ সে বলল যে, তার তক্ষুণি তার দাদীর বলা একট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। দাদী তাকে একটি ধর্ষক ব্যাঙের কথা বলেছিল। এক কুমারী মেয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্য এক রাত্রে এক নদীর পাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ সে স্বপ্নে দেখল একজন যুবককে, যে কিনা সবুজ পোশাক পরে আছে। যখন তার ঘুম ভাঙল, সে দেখতে পেল সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে এবং অবশেষে সে এক ঝাঁক ব্যাঙের জন্ম দিলো। এই কাহিনী মনে পড়ায় তার শরীর কেঁপে উঠল, সে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল এবং গায়ে লাগা কাঁদার মতো সে ব্যাঙগুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। কিন্তু কয়টা ফেলবে। কিছু ব্যাঙ তার পোশাক ও চুলের সাথে লেগে রইল। দুটো ব্যাঙ তার কানের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে কানের দুলের মতো দুলতে লাগল। সে যখন দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত হলো তখন তার মনে হলো মাটি তার শুষে নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে তার পোশাক ছিঁড়তে লাগল, হাত দিয়ে তার চামড়ায় আঁচড় কাটতে লাগল। প্রতিটি ব্যাঙকে সে যখন ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল তখন সে চিৎকার করে উঠছিল। যে দুটো ব্যাঙ তার দুই কানে দুলের মতো দুলছিল, তাদের যখন সে ছুঁড়ে দিলো তাদের ঠোঁটের সাথে কিছু মাংস চলে গেল।
আন্টি আর্তনাদ করে উঠল এবং দৌড়াতে লাগল কিন্তু ব্যাঙের ঘের থেকে সে বের হতে পারল না। যখন সে পেছনের দিকে তাকাল, যা সে দেখল তাতে তার আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। হাজার হাজার ব্যাঙ তাকে ঘিরে আর্মির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা সব কর্কশ কণ্ঠে ডেকে চলেছে, লাফাচ্ছে, ধাক্কাধাক্কি করছে এবং একত্রে জড়ো হয়ে তার দিকে পাগলের মতো ধেয়ে আসছে। সে যখন দৌড়াতে লাগলো তখন ব্যাঙেরা লাফিয়ে লাফিয়ে তার পথে বাঁধার প্রাচীর তুলে ধরল। সে আমাদের বলল যে, ব্যাঙেরা যে তাকে আক্রমণ করছিল তাতে তার পরনের কালো রেশমি পোশাকটি ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে দৌড়ে নদীর পাড়ে চলে গিয়েছিল যেখানে সে ছোট পাথুরে ব্রিজের অস্তিত্ব অনুভব করল। তখন তার পরনের পোশাকটি ব্যাঙের আক্রমণে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় সে যখন ব্রিজের ওপর উঠল তখন সে প্রায় দিগম্বর। সে বিবস্ত্র অবস্থায় হাও ডাসুর কাছে ছুটে গেল।
ভদ্রতার কোনো কথা তখন তার মনে ছিল না এবং সে এ ব্যাপারে একটুও সচেতন ছিল না যে, সে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন। সে সেসময় লক্ষ্য করল যে, একজন লোক ব্রিজের মাঝখানে হাতে কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তার হাতে ছিল একটি কাদার স্তূপ। একটি চাঁদের শিশুই কেবল জ্যোৎস্নায় স্নাত কাদা দিয়ে তৈরি হতে পারে। লোকটা যে আসলে কে ছিল তা আমি জানি না, আমি তার পরওয়াও করি না। সে যেই হোক, সে আমার মুক্তির জন্য সাহায্য করতে বাধ্য ছিল। আমি তার রেইনকোটের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।’ সে সেই লোকটার দুই বাহুর মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং যখন তার স্তনদ্বয় তার বুকের সাথে ধাক্কা খেল তখন ব্যাঙগুলো তার গা থেকে খসে পড়ল। সে চীৎকার করে উঠল, ‘বড় ভাই, আমাকে সাহায্য করুন।’
আন্টির ব্যাঙের বর্ণনা আমাদের চোখের সামনে একটা ভয়ঙ্কর চিত্র ভাসিয়ে ধরল। ক্যামেরার আলো পড়ল হাও ডাসুর ওপর, যে তখনো মূর্তিও মতো বসে ছিল। আন্টি বলে চলল, ‘আমার যখন ঘুম ভাঙল তখন আমি আমাকে আবিষ্কার করলাম হাও ডাসুর ঘরে। সে আমাকে এক বাটি শিমের স্যুপ খেতে দিলো। তা পান করে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। তখনো আমি ঘামছিলাম। হঠাৎ করে আমার হুঁশ ফিরে এলো এবং আমি টের পেলাম কী পরিমাণে আমি আমার সর্ব শরীরে আঘাত করেছি। আমার সারা শরীরে ব্যথা করতে লাগল। মনে হলো আমার সারা শরীরে জ্বর বয়ে চলেছে। যাহোক হাও ডাসুর শিমের স্যুপ পান করে আমি সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। আমি শুনেছি পুনর্জন্মের কথা। আমার মনে হলো, আমি আমার স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছি এবং আমি নতুন মানুষ হয়ে গেছি। আমি হাও ডাসুকে বললাম, ‘বড় ভাই, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি...।’