গোঁয়ার্তুমির কারণে বিপর্যয় বিরাটদের
বিরাট কোহলি - ছবি : সংগৃহীত
এলাম, দেখলাম, জয় করলাম, কথাগুলো বলতে বা শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, করাটা কিন্তু ততটা ঠিক নয়। আসলে এমনটা সচরাচর দেখা পাওয়াটাই দুর্লভ বিষয়। ভারতীয় দলের বিশ্বকাপের আগের হাবভাব কিন্তু অনেকটা এমনটাই ছিল। তবে পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট ফেভারিট টুর্নামেন্টে থেকেই ছিটকে যাওয়ার দোরগোড়ায়।
প্রতিভার কমতি নেই ভারতীয় দলে, কোনো ক্রিকেটারেরই প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। অন্তত এই বিশ্বকাপ দলে নিজের দিনে একা হাতে ১৫ জন ক্রিকেটারই দলকে ম্যাচ জেতাতে সক্ষম। তবে বিশ্বের ১৫ জন সেরা ক্রিকেটার খেললেই যে সেই দলটা সেরা হয়ে যায়, এমনটা কিন্তু নয়। দলগতভাবে একে অপরের দুর্বলতা ঢাকা, বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা লোকের দায়িত্ব নেয়া, এটাই তো একটা সেরা দলের সাফল্যের চাবিকাঠি।
তবে আদপে দেখতে গেলে এই ভারতীয় দল কিন্তু একসাথে বেশি ক্রিকেটই খেলেনি। সূর্যকুমার যাদব, ইশান কিষাণ থেকে বরুণ চক্রবর্তী, দলের তুরুপের তাসেরা কেউ প্রধান ভারতীয় দলের হয়ে একটি সিরিজ খেলেছেন, কেউ আবার তাও খেলেননি। হঠাৎ করে কোনো কিছু ক্লিক করে যাবে, সেটা ভাবাটা স্রেফ বোকামি। এরপর আসা যাক ফর্মের বিষয়ে। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, ঋষভ পন্ত, তাবড় তাবড় নাম রয়েছে ভারতীয় দলে। তার ওপর আবার সদ্য একই জায়গায় সকলেই আইপিএল খেলেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই সবাইকে তাদের সহজেই পরাস্ত করা উচিত ছিল।
আদপে রোহিত-কোহলিরা টুর্নামেন্টে খেলতে নামার আগে কেউই কিন্তু ফর্মে ছিলেন না। লোকেশ রাহুল এবং পন্ত ছাড়া আইপিএলের প্রথম ১০ জন সর্বাধিক রান করা ব্যাটারদের কেউই ভারতের এই বিশ্বকাপ দলে নেই। তাহলে, এবার প্রশ্ন উঠে রাহুল কেন ব্যর্থ হলেন, তিনি তো ফর্মেই ছিলেন। এর জন্য ম্যানেজমেন্ট কিছুটা হলেও দায়ী। সম্ভবত বিগত এক বছরে ভারতের সেরা ব্যাটার রাহুল। তবে গোটা আইপিএলে পাঞ্জাব কিংসের হয়ে তিনি খেলেছেন সঞ্চালকের ভূমিকায়।
মরশুমের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে ধুঁয়াধার ব্যাটিং করে তিনি যে মারকুটে মেজাজেও রান করতে সক্ষম, তা রাহুল দেখান বটে। ভারতীয় ম্যানেজমেন্টও সেই রাহুলকেই দেখতে চেয়েছিল বিশ্বকাপে। তবে গোটা একটা মরশুম সঞালকের ভূমিকায় খেলার পর হঠাৎ করে রাতারাতি ভূমিকা বদলে ফেললে যে কারুরই পক্ষে তা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। দেখতে গেলে দোষ ভারতীয় নির্বাচকদেরও কম নয়। দলে বদল ঘটানোর সময় ও সুযোগ থাকলেও তারা সেটা স্রেফ এড়িয়ে গিয়েছেন।
আইপিএল যদি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হয়, তাহলে সেই আইপিএলে ইশান এবং সূর্যকুমারের ভালো ইনিংস বলতে একটা। মরশুমের সর্বাধিক উইকেট নেয়া দুই বোলারকে সুযোগই দেয়া হয়নি ভারতীয় দলে। রাহুলের প্রিয় সখা হার্দিক পান্ডিয়ার চোটের সমস্যাও কিন্তু কারুর অজানা নয়। দুই বছর আইপিএলে বল না করার পরও জোর করে তাকে অলরাউন্ডার প্রমাণ করতে বল করানোটা যে কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে দল।
বিরাট কোহলির স্পিনের বিরুদ্ধে সমস্যা, মোহাম্মদ শামির ইকোনমি রেট, ভুবনেশ্বর কুমারের অফ ফর্ম, হাফ-ফিট বরুণ, এসব নিয়ে আলোচনা করতে বসলে কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যাবে। তবে একটা বিষয় না বললেই নয়। ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট বা কোহলি স্বয়ং বার বার ক্রিকেটাররা যে যন্ত্র নয়, সেটা দাবি করে এসেছেন। দিনের শেষে নিজেরাই হয়তো সেই বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলেন তারা। কিউয়িদের বিরুদ্ধে হারের পর বুমরাহের জৈববলয় নিয়ে অভিযোগ যতই অজুহাত বলে মনে হোক, দিনের শেষে দলের পারফরম্যান্সে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে এই বিষয়টিই।
আইপিএল বাদেও বিগত ১০ মাসে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার লম্বা সফর, তার মধ্যে অত্যন্ত চাপ নিয়ে খেলা, ঘর থেকে দূরে থাকা, ভারতীয় ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে ক্লান্ত করে দিয়েছে। সেই কারণে হয়তো মাঠে ক্রিকেটাররা মজুত থাকলেও তাদের সেই মধ্যে আবারো সেই নিজের সম্পূর্ণটা উজাড় করে দেয়ার শক্তিটা আর নেই। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন তিনেক পরেই কিন্তু আবার দেশে ফিরে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে এই ক্রিকেটারদেরই। তাই কোনোভাবেই তাদের রেহাই নেই।
সবশেষ একটাই কথা বলা চলে, ক্রিকেটাররাও মানুষ, যন্ত্র নয়, তাই এলাম, দেখলাম, জয় করলাম, তত্ত্বটা আর যাই হোক ক্রীড়াক্ষেত্রে অন্ত খাটে না।
সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস