পাকিস্তানকে কেন কাছে টানছে যুক্তরাষ্ট্র
জো বাইডেন ও ইমরান খান - ছবি সংগৃহীত
আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের আর পাকিস্তানকে প্রয়োজন নেই বা ফুরিয়েছে- বাস্তবতা কিন্তু এর একেবারেই ধারেকাছেও নয়। বরং উল্টো আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের পাকিস্তানকে এখন আরো বেশি দরকার। লন্ডন ইকোনমিস্ট সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সম্প্রতি এক আর্টিকেল ছেপেছে। আবার পাকিস্তানেরও আমেরিকাকে আর তেমন দরকার নেই, পরিস্থিতি সেটিও নয়। আজকের পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ছেড়ে অনেক বেশি চীন নির্ভরশীল হলেও এটি কোনো ‘আমেরিকা অপ্রয়োজনীয়’ ধরনের অবস্থা নয়। তাই মাঠের সাধারণ নাগরিকের ভাষায়, কোনো প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকার সাথে বা নিয়ে কথা বলতে যাওয়ার কিছু ভুল তো এখানে আছেই। ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখতে পারি আমরা।
ভুল হওয়ার অন্য আরো যে বিশেষ কারণ, তা এখন বলব। প্রথমত, এবারের সেনা প্রত্যাহার করার পর বাইডেন প্রশাসনের কারো মানে শেরমানের এই পাকিস্তান সফর একেবারের ভিন্ন ও নয়া তাৎপর্যের। এক নয়া যুগের; কারণ আগের ২০ বছর আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক ছিল এমন যে, আফগানিস্তানে হামলা চালাতে চায় তাই হামলার লঞ্চিং প্যাড হিসেবে আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার ও তাকে বাধ্য করা হবে- এই যে সম্পর্ক এত দিন থাকলেও এবারই প্রথম সেই শর্ত আর নেই। পাকিস্তানও এসব বাধ্যবাধকতা থেকে একেবারে মুক্ত। এই নতুন মুক্ত পরিস্থিতিতে শেরমান পাকিস্তান সফরে এসেছেন, তা থেকে সব পক্ষের দেখা উচিত। ফলে কথাবার্তা বা নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় এ নিয়ে সব পুরনো রেফারেন্স বাদ দিয়ে এটি নয়া সম্পর্কের কাল হিসেবে কথা বলতে পারতে হয়েছে বা হবে উভয়পক্ষকে।
কিন্তু সাবধান, এরই মধ্যে এক নয়া কমন পাকিস্তান-আমেরিকাসহ আরো অনেকের সাথে কমন এই ইস্যু সামনে। সেটি হলো- ১. তালেবান এখনো কোনো সরকার গঠন করতে পারেনি। ২. তারা এখনো এক আমিরের আফগানিস্তান নিয়ে আঁকড়ে পড়ে আছে। রাজা আর জনপ্রতিনিধির ফারাক বুঝতে চাইছে না। ফলে অবলীলায় রাজা বা আমিরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারছে। আমিরের দেশে আমিরই দেশের মালিক এখানে কোনো নাগরিক থাকে না, হুকুমের বান্দা থাকে। এখানে দেশ গড়ার কিছু থাকে না। আমিরের খেয়াল থাকে। ৩. জাতিসঙ্ঘসহ সারা পশ্চিম যেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা হলো- প্রায় ১০ লাখ শিশু না খেয়ে মরার মুখোমুখি, প্রায় ১৮ লাখ দুস্থ মানুষ যারা জাতিসঙ্ঘের মানবিক নানান ধরনের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল প্রভৃতি। এসব মানবিক সাহায্য তালেবান সরকার স্বীকৃত নয় বলে আগের মতো সরবরাহ বজায় রাখতে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের ক্ষুধা এসব কী সমস্যা তা জানার যোগ্য থাকে না। পশ্চিম তাই আগেই স্বীকৃতির ইস্যু এড়িয়ে সরাসরি কথা বলতে এসেছে। আমেরিকা, ইইউ এরই মধ্যে বিনা স্বীকৃতিতেই কাবুল সফরে কথা বলেছে। একটি স্বীকৃত সরকার হতে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা, পরামর্শ করেছে। কিন্তু এটিকে তাদের ঠেকা, তারাই বিপদে পড়েছে- এমন অনুমান নিয়ে ব্যাপারটাকে দেখা এক বিরাট ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়া হবে। আসলে আমেরিকা, ইইউ যেটা আগবাড়িয়ে করছে, সেটা হলো নিজেদের দিক থেকে যা করণীয় কর্তব্য ছিল, তা পূরণ করে রাখছে; যাতে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় যদি কিছু শিশু অভুক্ত মারা যায়; যাতে সে আগেই পরিষ্কার রাখতে পারে তাদের দায়ের অংশ ও উদ্যোগ তারা যথেষ্ট নিয়েছিল। কিন্তু তালেবানদের কারণে পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। এটি কখনই হয় না যে, দানগ্রহীতার আগ্রহ নেই আর মানুষ দাতাকে প্রধান দায়ী করবে।
৪. অতএব দাতারাই ঠেকায় পড়েছে আর তাদের সেই ঠেকে যাওয়া দশাকেই ব্যবহার করে চাপ দিয়ে তাদের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে- এটি খুবই আত্মঘাতী ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত হবে।
৫. এরপর যা লিখব সেগুলোই তালেবান ইস্যুর মূল প্রসঙ্গ। নয়া তালেবান এরা স্বীকৃত সরকার নয় বলেই এটি থিতু সরকার নয়, এ অনুমান ভুল, ভিত্তিহীন। এটি এখনো অস্থিতিশীল মূলত এর অভ্যন্তরীণ সংহতি খুবই দুর্বল। কথাটাকে যদি রেডিক্যাল আর লিবারেল ধারা হিসেবে বলি, তবে এ দুই ধারার বিরোধ প্রধান অ-সংহতি চিহ্ন। এখানেই শেষ নয়। তালেবানের ভেতরের এই বিরোধের বাইরের আরো চরম রেডিক্যাল (আইসিস-কে) ধারা আছে, যার ছাতার নিচে সমমনা আরো ছোট গ্রæপ আছে। এরা তালেবানদের ‘চরম অসহনীয় শত্রæ’ জ্ঞান করে।
৬. এরই মধ্যে আইসিস-কে গত আগস্টের দুই এয়ারপোর্ট হামলার পরে আর বসেনি। তাদের এখনকার টার্গেট মূলত হাজারা ট্রাইব বা এথনিক গোষ্ঠী, যারা শিয়া জনগোষ্ঠী। আর মোট আফগান জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। প্রথম তিন গোষ্ঠী পশতুন (৪০-৫০ শতাংশ ), তাজিক (২৫ শতাংশ) আর হাজারা (৯ শতাংশ)। এ হামলা মূলত নির্মূল করা ধরনের। আপাতত যা তাদের মসজিদে হামলা টাইপের। অনেকে হাজারা মুসলমান কি না তর্ক সে দিকে নিতে পারেন। এটি ভুল পথ। এমন তর্ক ইসলামের ভেতরে। কিন্তু বাইরের পুরো দুনিয়া ব্যাপারটাকে দেখে কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হিসেবে, বসনিয়ায় যা হয়েছে। দুনিয়াতে ১৯৪৫ সালের আগে এমন বহু এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেয়া গেছে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরে দুনিয়া বদলে গেছে; কারণ এক ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ তৈরি হয়ে আছে। বিশেষত ২০০০ সালের পরে যে গ্লোবাল আইনিকাঠামো, আদালত ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে; তাতে যারাই কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে যাবে, তো সে যে অজুহাতেই হোক তারা সহি মুসলমান ছিল না বলে অথবা অন্য কিছু, এরা প্রত্যেকেই এখন বিচারের সম্মুখীন হবে, সর্বোচ্চ সাজা পাবে।
এসব হলো আফগানিস্তানের আরেক জগৎ। সেই জটিলতার একটু ইঙ্গিত দিলাম। আর এখানে এবার ভারতের অবস্থা নিয়ে একটি কথা বলে শেষ করব।
অবশেষে ভারতের মিডিয়া জানাচ্ছে, আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আফগানিস্তানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার’ দায়িত্বে আছেন এমন মর্যাদার মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সম্মেলন আহ্বান করতে যাচ্ছে ভারত। আর তাতে প্রধান দুই মেহমান পাকিস্তান ও চীন।
তা হলে এত দিন মোদির হিন্দুত্ববাদ আর ভোটের স্বার্থে যে এ দুই দেশকে ভারতের চরম শত্রু বলে প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, এর কী হবে? যে চরমশত্রু দেশ সেই আবার দাওয়াতি-অতিথি হয় কী করে? ভারতের স্বার্থ অবশ্যই চীন-পাকিস্তানের স্বার্থের বিরোধী এবং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ‘চরমশত্রু দেশ’ বলে চিনানো আর প্রতি মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা- এই হিন্দুত্ববাদ অগ্রহণযোগ্য, ভারতের পক্ষেও যায় না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com