বিশ্বকাপ : বাংলাদেশের ১২

আফফান উসামা | Oct 23, 2021 07:33 am
বিশ্বকাপ : বাংলাদেশের ১২

বিশ্বকাপ : বাংলাদেশের ১২ - ছবি : সংগৃহীত

 

তাসমান পাড়ের দুই প্রতিবেশী ক্যাঙ্গারু আর কিউইদের ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ঘোলা পানিতে ডুবিয়ে ছিল বাংলার বাঘেরা। আর এবার ওই বাঘেরাই কিনা আরব সাগরে দুল্যমান শঙ্কায়! পা ফসকাকেই বিপদ, এই বুঝি আরব সাগরে তলিয়ে যায় অপমান আর লজ্জায়। এমনি সমীকরণ ভাবনায় রেখে বাঘেরা মুখোমুখি হয়েছিল পিএনজির; পাপুয়া নিউ গিনির। অতঃপর...

▪ এক—
৪, ৬, ০, ১, ৩৩, ১৫, ৬, ১০, ৫, ৬। এগুলো শুধুই কোন সংখ্যা নয়, এগুলো যেন প্রতিটা আফসোস, হতাশা আর স্বপ্ন ভঙ্গের নিষ্ঠুর নমুনা। নিষ্ঠুরতা দূর করে, খানিকটা সুখের আবেশ পেতে সবাই তাকিয়ে ছিল ওমানের মাস্কাটে, বাংলাদেশ আর পাপুয়া নিউ গিনি ম্যাচের দিকে। কিন্তু হায়! পূর্বাভাস দিয়েও আর উদ্ভাস হওয়া হয়নি, সম্ভাবনা জাগিয়েও আর সাধ পূরণ হয়নি। এ ম্যাচেও ফিরেছেন তিনি ২৯-এ, ফিরেছেন সেই পুরনো রূপে, আশাহতের গল্প লিখে। কার কথা বলছি বুঝে বাকি আছে কি? আপনার বুঝতে সময় না লাগলেও তার যে এখনো নিজেকে খুঁজে পাওয়া হয়নি, বোঝা হয়নি নিজের সক্ষমতা!

▪ দুই—
আগের ম্যাচে নিজ সামর্থ্যের জানান দিয়েছিলেন, খেলেছিলেন এক অতিপ্রয়োজনীয় ইনিংস। যদিও ভাগ্যের ছোঁয়া পেয়েছেন একাধিকবার, তবুও তো উচ্চস্বরে বলা যায় ‘ভাগ্য সাহসীদেরই কাছে পায়'। কিন্তু শেষ বলেও তো একটা শব্দ আছে, ভাগ্যেরও তো একটা ধৈর্য আছে। আগের বলে কম্পন তোলে হাবুডুবু খেতে খেতে বেঁচে গেলেও, পরের বলটায় ভাগ্য আর সহায় হয়নি। সুতরাং সাজঘরে ফিরেছেন ‘শুন্য’ রানে। ভাগ্যেরও তো একটা মান-সম্মান আছে।

▪ তিন—
কী লিখব তার সনে? তাকে পরিমাপ করা যায় এমন কোনো শব্দ আছে কি বাংলার অভিধানে? তিনি তো রত্ন বাংলার, তিনি তো গর্ব বাংলার, তিনি তো সৌরব বাংলার। যার সুবাসে আজ গোটা বিশ্ব মাতাল। আইপিএল যে কখনো তার সক্ষমতার পরিমাপ নয়, তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন আবার। কেন তিনি সবার শিরে, কেন তিনি বিশ্বের সেরা তাই যেন বোঝালেন বুঝালেন আবার। একটা ম্যাচে ব্যর্থ ছিলেন। শুধুই ব্যাট হাতে, বল হাতে যদিও উজ্জ্বল ছিলেন। কিন্তু দলের বিদঘুটে পরাজয়ে তিনিও পেয়েছিলেন ধিক ধিক ধিক্কার। অতঃপর... স্মৃতি মন্থন করুন। সুখ খোঁজে পাবেন।

▪ চার—
মনে আছে সেই ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন ট্রফির কথা। হায় হায় রব উঠেছিল তাকে নিয়ে। স্বয়ং বোর্ড প্রেসিডেন্ট নিউজিল্যান্ডে উড়ে গিয়েছিলেন তাকে একাদশ থেকে ছুড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। বোর্ডের দায়িত্বে থাকা একজন তো মন্তব্যও করেছিলেন, ‘ও এখন খেলার যোগ্য না, ওর বিকল্প দরকার'। যাহোক কাপ্তান ও কোচের বাধায় সে ম্যাচে আর তাকে বসানো যায়নি, হাথুরু সিংহে কড়া মনের মানুষ হলেও কখনো রত্ন চিনতে ভুল করেননি। অতঃপর সেই ম্যাচ খেললেন তিনি, গড়লেন শতক, হলেন ম্যাচ সেরা। সেই যে শুরু, এখনো হয়নি আর তার থামা। ১১৪ & ৫২/০ + ৭৫ & ৫০/১ + ১২৪ & ৫৪/২ + ৫১ & ২৯/৫ + ৪২ & ২৮/৩ + ৪৬ & ৯/৪; আইসিসির ইভেন্টে বাংলার শেষ ছয় জয়ের ছয়টাতেই ম্যাচ সেরার নাম সাকিব আল হাসান। সমালোচনার জবাবটা তিনি দিয়ে থাকেন তারই মতো করে, ব্যাটে বলে সমতালে।

▪ পাঁচ—
ভালোবাসার মাঝেই তো অভিমান থাকে। তেমনি তিনি ক্রিকেটটাকে খুব ভালোবাসেন বলেই হয়তো কখনো কখনো অভিমানের সুর তোলেন। তবে তিনি সর্বদাই চেষ্টা করেন ব্যাট হাতে তার জবাব দিতে। রান দিয়েই সমালোচকের মুখে কুলুপ এঁটে দিতে। কিন্তু কেন যেন হচ্ছে না, টি-২০ ক্রিকেটে ব্যাটটা যে তার হয়ে কথা বলছে না। সেই ভারতের বিপক্ষে ৪৩ বলে ৬০ এর পর, পরবর্তী ইনিংসগুলো তার যথাক্রমে- ৪, ০, ১৭, ১৬, ০, ২০, ০, ৩, ৩৮, ৬, ৫। ডাকই মেরেছেন তিন-তিনটা! বোঝাই যাচ্ছে খুব খারাপ যাচ্ছে সময়টা। যার উপর ভরসা বেশি, দল যাকে দিয়েছে মি. ডিপেন্ডেবল’র স্বীকৃতি, তার খারাপ সময়ে যে দলকেও বেশ ভুগতে হচ্ছে। মুশফিকেরই বা দোষ দিই কি করে, চেষ্টা তো তিনি করেন প্রাণ ভরে। এতো অনুশীলন আর ঘাম জড়ানো প্রচেষ্টা, সবই কি বৃথা যেতে পারে? নিশ্চয়ই একদিন তিনি ফিরবেন, ফিরবেন নিজের মতো করে। কিন্তু, কিন্তু তা কবে?

▪ ছয়—
২৭ বলে ৩ ছক্কা আর ৩ ছয়ে মারদাঙ্গা অর্ধশতক তার ব্যাটে। তাতেই যেন নতুন রেকর্ড, টি-২০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় দ্রুততম অর্ধশতকটা দেখে ফেললো তারই আগ্রাসনে। বুঝিয়ে দিয়েছেন বুড়িয়ে গেলেও তিনি ফুরিয়ে যাননি। তার এমন স্বরূপে ফেরাটা যে খুবই প্রয়োজন ছিলো। দলের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। পাশাপাশি নেতৃত্বেও তিনি বৈচিত্র্য এনেছেন। আর তাতে তিনি বেশ সফলও হচ্ছেন। কিন্তু তার নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনাটা যেন একটু কমই হয়, হয়তো এই জন্যই তিনি সাইলেন্ট কিলার। এখন মূল পর্বে তার ব্যাট আর মস্তিষ্কের আগ্রাসন হলেই ভালো কিছু সম্ভব, এই ভরসা আছে মনে।

▪ সাত—
প্রতিভার ভাণ্ডার নিয়ে এই দেশের ক্রিকেটে কতজনই না এসেছিলেন। যার অনেকেই হারিয়ে গেছেন, অনেকেই বা নিজেকে খুঁজে ফিরছেন। আর যারা আছেন তাদের অবস্থাও নড়বড়ে। তবে তাদের মাঝে ভিন্নতর একটা নাম। অনুর্ধ্ব ১৯ থেকে উঠে আসা আফিফ হোসেন ধ্রুব। নামের মতোই তিনি বাংলার ক্রিকেট আকাশে জ্বলজ্বল করছেন সম্ভাবনার সমাহার নিয়ে ধ্রুব তারারই মতো। যখনই সুযোগ মিলেছে, যেখানেই সুযোগ মিলেছে চেষ্টা অবধারিত নিজেকে বিলিয়ে দেবার। বাংলার ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভরসা হয়ে উঠার সুযোগ আফিফের সামনে। আশাকরি এই সুযোগটাও আফিফ লুফে নিবেন বরাবরের মতো করে।

▪ আট—
এই মুহূর্তে কি তাকে বলা যায় বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেট কিপার? এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বে অবশ্য খালি চোখেই তিনি সেরা। আহ, কিপিংও যে এক শিল্প, এম এস ধোনির পর তাকে দেখেই যেন অনুভব হওয়া। পর পর দুই ম্যাচে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে পাখির মতো উড়ে গিয়ে সাপের মতো ছোবল দিয়ে দৃষ্টিনন্দন বিস্ময়কর যে দুটো ক্যাচ হাতে নিলেন, তা যেন দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ তুল্য। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা আর মনের অজান্তেই দাঁড়িয়ে যাওয়া ছাড়া যখন আর কিইবা করার থাকে! আহ, ক্রিকেটেও যদি ফুটবলের মতো করে গোল্ডেন গ্লাভস থাকতো! তবে ব্যাট হাতের সুযোগগুলোও কাজে লাগানো চাই, শুধুই ছক্কা থেকে বুঝেশুনে খেলা চাই। তাতে দল যে আরো বেশি লাভবান হবে।

▪ নয়—
একজন পেস অলরাউন্ডারের অভাব যখন বাংলার ক্রিকেটকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো, তখন যেন গরমের তীব্র তাপদাহে ফাটা চৌচির মাঠে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় তার আগমন বাংলার ক্রিকেটে। কিন্তু শুরুর পথটা ছিলো তার বড্ড বেশি কঠিন। মিলারের পাঁচ ছক্কায় ক্যারিয়ার যেন প্রায় ফুরায়। কিন্তু যারা দৃঢ় প্রত্যয়ী, তারা ফিরে আসতে জানে। তিনিও ফিরে এসেছিলেন অল্প দিনেরই মাঝে। আর এরই মাঝে হয়ে গেছেন দলের নির্ভরতার প্রতীক আর অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই পাওয়ার হিটিংয়েও তিনি দলের মূল মন্ত্র। ১৯ বিশ্বকাপেও আলো ছড়িয়ে ছিলেন, টি-২০ বিশ্বকাপেও স্বরূপেই আছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন কতদূর, কোন সীমানায়।

▪ দশ—
ফিরে আসা হয়তো একেই বলে। দৃঢ় প্রত্যয়ীরাই তো ফিরে আসে। বাংলার ক্রিকেটে ফিরে আসার গল্পটা একটু মলিন, প্রায় সবাই হারিয়ে গিয়ে হয়ে যায় বিলীন। তবে সেই প্রত্যাবর্তনের গল্পে নতুন রূপ এনেছেন তিনি। জ্বলন্ত অঙ্গারে হেঁটে মনোবল চাঙ্গা করে ফিরে এসেছেন তিনি। পুরনো রূপে ফিরলেও বৈচিত্র্য না থাকায় বিফল হয়েছেন বার বার। ফলে বিশ্বকাপে আসার পূর্বে শরণাপন্ন হয়েছিলেন সাবেক কাপ্তান মাশরাফি বিন মর্তুজার। কি শিখেছিলেন তার থেকে, বুঝা যাচ্ছে যখন মাঝে মাঝে ছুড়ছেন স্লোয়ার। কিন্তু আসল যুদ্ধ এখনো বাকি। মূল পর্বে তাকে হতে হবে আরো বিধ্বংসী।

▪ এগারো—
রাজ্জাক-রফিকের দেশে স্পিনার সংকট! শুনতেই কেমন বেমানান লাগে। না, স্পিনার আছে বটে, কিন্তু মান সম্পন্ন ক্ষুরধার বৈচিত্র আছে কয়জনের ঘটে? মস্তিষ্কের বৈচিত্র কাজে লাগিয়ে সাকিব যদিও সাকিব হয়ে হয়ে গেছেন, কিন্তু কয়জনেই বা তা পারেন। টি-২০ ক্রিকেটে যার অভাব আরো প্রকট, আরো মলিন। দেশের মাটিতে হয়তো সময়ে সুযোগে কেউ কেউ দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে, কিন্তু বাইরে গেলেই তারা পরিণত হয় ভেজা বেড়ালে। তবে ভিন্নতা ধরে রেখেছে শেখ মেহেদী। নামটা অলরাউন্ডার হলেও, এখন পর্যন্ত স্পিনেই তিনি ক্ষুরধার। তবে চোখ থাকবে মূল পর্বে, সেই সাথে ব্যাট হাতে তার মারদাঙ্গা ক্রিকেটে।

▪ বারো—
তাকে একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে না? বলগুলোও যেন তার লাইন লেন্থটা খোঁজে পাচ্ছে না। বিধ্বংসী কাটারগুলোও যেন একটু এলোমেলো। ভয়ংকর আগ্রাসনটাও যেন নিরীহ, নিস্তেজ। কারণ হয়তো ক্লান্তিই হবে। আইপিএলে টানা ম্যাচ খেলার ধকলটা যে তার পাশাপাশি দলকেও ভোগতে হচ্ছে। আগেরবারের আইপিএল ক্লান্তি ঘোচাতে ভোগতে হয়েছে চার চারটা বছর, এবার যেন তেমন কিছু না হয়। তিনি তার রূপে থাকলে কি হতে পারে, তা কি কারো অজানা আছে? প্রার্থনা থাকবে সকলের সমস্বরে, ফিরে আসুন নিজের মতো করে, বিধ্বংসী ভয়ংকর রূপে।

** অধিনায়কের আগ্রাসন শুধুই ম্যাচে ছিল না, ম্যাচ শেষেও তার আগ্রাসন ছিল সংবাদ সম্মেলনে। ভক্তদের কাছে একটুখানি সম্মান চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, তাদের পরিবারের কথা, বলেছেন নিজেদের কথা। সত্যিই তো তাই, সমালোচনার রীতি পুরনো হলেও এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। যার প্রভাব পড়ছে খেলা ও খেলোয়ার আর সংশ্লিষ্টদের ওপরে। আমিও বলি, সমালোচনা হোক সকাল-বিকেল, কিন্তু তা সুস্থভাবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us