প্রসঙ্গ কুমিল্লা সংঘর্ষ : একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ

ফ্লোরা সরকার | Oct 22, 2021 08:14 pm
প্রসঙ্গ কুমিল্লা সংঘর্ষ : একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ

প্রসঙ্গ কুমিল্লা সংঘর্ষ : একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ - ছবি : সংগৃহীত

 

সম্প্রতি কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে নানামুখী মতামতে সোশ‍্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেছে। এখন পত্রিকার চেয়ে সোশাল মিডিয়া বেশি সরব থাকে। এসব মতামতের মধ‍্যে দুটি পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করার মতো - এক. একজনের মতে বাংলাদেশে সুলতানি আমলের শাসন শুরু করা উচিৎ, কারণ এটা মুসলিমপ্রধান দেশ আরেকজন বলছেন, '৭১ পূর্ব ইতিহাস টিতিহাস বুঝি না, বাংলাদেশের ইতিহাস যদি বুঝি, তাহলে '৭১-পরবর্তী ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস বুঝি। দুই. ইকবাল হোসেন নামে যে ছেলেটাকে কোরআন রাখার কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাতে হিন্দু জনগোষ্ঠী বেজায় খুশি এবং মুসলিম জনগোষ্ঠী বেজায় নাখোশ। আমরা এখন এই দুটি বিষয় একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করবো।

এক নম্বরে যে দুটি মতামতের কথা দুই ব‍্যক্তি পৃথকভাবে বলেছেন, তাদের দুজনই ভয়ানক ভুলের মধ‍্যে বসবাস করছেন। প্রথম কথা হলো, যদি সুলতানি আমলের শাসন আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই, তাহলে ইতিহাসের যে পর্যায়ে সুলতানি শাসন কায়েম ছিল সেসব পর্যায় ফিরিয়ে আনতে হবে। খুব সংক্ষেপে সেই পর্যায়টায় একটু চোখ বুলিয়ে নেই। ইতিহাসে সুলতানি আমল প্রধানত দিল্লি সালতানাত বলে পরিচিত। দিল্লি সালতানাতের সময়কালটা কত ছিল? ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ‍্যবর্তী সময় । এই সময়ে তুর্কি, আফগান ইত্যাদি রাজবংশ দিল্লি শাসন করত। রাজধানী দিল্লি এবং অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি। সরকারি গঠনতন্ত্র কেমন ছিল? রাজবংশ। প্রধান ধর্ম কী ছিল? সুন্নি ইসলাম। রাজধানী কখনো লাহোর, কখনো দিল্লি, কখনো আগ্রায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। বিস্তারিত আর কিছু দেখার দরকার নেই। শুধু এই কয়টা তথ‍্যের মধ‍্যে দিয়ে আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি একমাত্র ধর্ম ছাড়া ( তাও আংশিক। কারণ শিয়া মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়না) বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশের কোন মিল পাওয়া যায় না।

অর্থনৈতিক পরিবেশ তো নয়ই। এখন কথা হলো, মধ‍্যযুগের এই শাসনব্যবস্থা আবার কায়েম করা তো সম্ভবই না আর ইতিহাস কখনোই পেছনে হাঁটে না। ইতিহাসের প্রয়োজন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার কারণে।

এবার দ্বিতীয়জনের কথায় আসা যাক, যার কাছে '৭১-পূর্ব ইতিহাসের কোনো মূল্য নেই এবং যিনি ইতিহাস বলতে '৭১-পরবর্তী ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস ছাড়া আর কোনো ইতিহাস বোঝেন না বা মানেন না। আমাদের দেশটা আয়তনে যেমন ছোট, চিন্তার জগতেও ঠিক তেমনি ক্ষুদ্র। ইতিহাস তো পেনসিল দিয়ে লেখা কোনো লেখ‍্যপত্র না যে, চাইলাম আর মুছে ফেললাম। যে 'আমরা' আজ এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি, এই আমরা তো আকাশ থেকে পড়িনি। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষেরই বংশধর। আরো সহজ করে বললে, বর্তমান প্রজন্মের কোনো ছেলে বা মেয়ের দাদা অথবা নানা '৭১ প্রজন্মের মানুষ ছিল। তাই বলে সেই দাদা বা নানার কি বাবা বা দাদারা ছিল না? যদি '৭১ থেকে ইতিহাস শুরু করতে হয়, তাহলে সেসব দাদা বা নানার জন্ম বা ইতিহাসকেও অস্বীকার করতে হয়। যা অসম্ভব। কাজেই ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোনো উপায় কোনো দেশেই নেই। বরং পূর্ব ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়। ওই ইতিহাসে কিছু ভুল থাকতে পারে। ইতিহাসের কাজই তো ভুলগুলো সুধরে নিয়ে চলা। তাকে অস্বীকার করে চলা নয়। তাহলে আমাদের দেখতে হবে, বাংলাদেশে যখন ধর্মনিরপেক্ষ নামের এই আজব ভূতটা ছিলনা তখন আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল।

আমাদের ইতিহাসের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি, অন্তত কাছের ইতিহাসের দিকে, তাহলে দেখতে পাবো, আমাদের এখানে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট যতটা প্রকট ছিল, সামাজিক সংকট ততটা প্রকট ছিল না। ধর্ম আমাদের সমাজকে কখনো বিভক্ত করে নাই। বরং আমরাই ধর্মকে বিভক্ত করেছি। এখানে প্রধান দুটো জনগোষ্ঠী, হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে কখনোই বিরোধ ছিল না। বিনয় ঘোষ তার 'বাংলার নবজাগৃতি' বইয়ে 'ইসলাম ও বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়' অধ‍্যায়ে সুলতানি এবং মোগল যুগের ভারত সম্পর্কে লিখেছেন, "বিহারের হিন্দু কুর্মী চাষীরা মুসলমানদের মহরম উৎসবে যোগ দেয়, রমজানের উপবাস করে ...বাংলার মুসলমানরা গ্রামে হিন্দুদের দুর্গোৎসবে যোগ দেয়, হিন্দুরাও মুসলমানদের ঈদ মহরমে আনন্দ করে... হিন্দুদের মতন বাংলার মুসলমানরাও শীতলা ও রক্ষাকালী পূজা করে .... বাংলার 'সত‍্যপীর' হিন্দু-মুসলমানদের মিশ্র দেবতা।" শুধু সুলতানি বা মোগল যুগে নয়, আমার নিজের মায়ের যুগেও অর্থাৎ পাকিস্তান যুগেও এই সম্প্রীতির গল্প শুনেছি। মুসলমান ছেলেমেয়েরা দলে দলে দুর্গা পূজায় সামিল হতো। সারা বছর দুর্গা পূজার আশায় তারা পথ চেয়ে বসে থাকত। এমনকি ২০১৬-২০১৭-২০১৮ সালে আমি নিজেই আমাদের কলেজে ( সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) হিন্দু শিক্ষকদের দেখেছি, প্রতি বছর কলেজের সব শিক্ষকের জন‍্যে তারা দুর্গা পূজার নাড়ু ও অন‍্যান‍্য খাবার নিয়ে আসতেন। এই যদি হয়, আমাদের সামাজিক পরিবেশ, তাহলে হঠাৎ কী এমন আকস্মিক ঝড় এলো যে, ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানকে এক করতে হবে?

সব থেকে বড় কথা 'ধর্মনিরপেক্ষ' কনসেপ্টটা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য কনসেপ্ট। পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ কনসেপ্ট গড়ে উঠেছিল প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক কারণ পরে যুক্ত হয়। আর সামাজিক কারণে তো নয়ই। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষ বলে যতই চেঁচাই না কেন, যার যার ধর্ম ( ধর্ম বলতে এখানে অনেক বড় অর্থে বলা হয়েছে ) ঠিক না থাকলে, সংঘর্ষ এমনকি নিজ নিজ ধর্মের মধ‍্যেও সংঘর্ষ লেগেই থাকবে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পূর্ব ইতিহাসের আলোকেই আমাদেরকে আমাদের দেখতে হবে, শুধু একাত্তর পরবর্তী ইতিহাস দিয়ে দেখলে চলবে না।

এবার দ্বিতীয় নম্বরে আসা যাক।

ইকবাল হোসেন ধরা পড়ায় দুই গোষ্ঠীর দুই রকমের রিএ‍্যাকশান প্রসঙ্গে। হিন্দুরা খুব খুশি মুসলমানের কাজ বলে, মুসলমানদের দুঃখ মুসলমানদের দিয়ে কাজটা হলো কীভাবে ইত্যাদি। আমরা মূল রেখে গাছের ডালপালা নিয়ে ব‍্যস্ত থাকি। গাছের মূল ধরে টানতে যে পরিশ্রমের দরকার ওই পরিশ্রম আমরা করতে চাই না। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রম তো নয়ই। ইকবাল হোসেন বা ইলা মিত্র যে-ই পূজার মণ্ডপে কোরআন রেখে আসুক, তাতে কিছু যায় আসে না। কথা হলো এই অন‍্যায় কাজটা কোথায়, কেন, কিভাবে উৎপত্তি ঘটল? যে কাজ করলে সমাজে সংঘর্ষ বাঁধে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, ওই কাজ অত‍্যন্ত গুরুতর অন‍্যায় কাজ। অন‍্যায় করলে তার শাস্তি অপরিহার্য। কিন্তু শুধু শাস্তি দিলেই এই ঘটনার অবসান হবে না। আমাদের ওই মূলের খোঁজ করা এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মূল বের হলে, তার সমাধান সম্ভব। না হলে একই অন‍্যায়ের পুনরাবৃত্তি হতে হতে একসময় সেটা ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের রূপ নেবে। কাজেই ইকবাল নাকি ইরা, এসবের চেয়ে বেশি জরুরি কেন, কিভাবে এসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ করা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসি-সাঁওতাল-বাংলা ও অন‍্যান‍্য ভাষাভাষী, ধনি-গরিব, নারী-পুরুষ সবাই কিন্তু এই বাংলাদেশেরই নাগরিক। এই নাগরিকত্ব আর এই ভূখণ্ড যদি আমরা রক্ষা করতে চাই, সবাইকে মিলেমিশেই রক্ষা করতে হবে। নিজেদের ভূখণ্ড নিজেরা রক্ষা করতে না পারলে তখন সেটা অন‍্যের দখলে চলে যায়। দুর্বলতার সুযোগ সবাই নিয়ে নেয়। আমাদের এখন প্রয়োজন ধর্ম-শ্রেণি-গোষ্ঠী সবার ঐক্যের মধ‍্যে দিয়ে কোরআন রাখার প্রকৃত কারণ বের করে আনা এবং এসব বিভেদের অবসান করা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us