আজারবাইজান নিয়ে ইরানের উদ্বেগ ও ভয়
আজারবাইজান নিয়ে ইরানের উদ্বেগ ও ভয় - ছবি : সংগৃহীত
নাগরনো কারাবাখ নিয়ে ৪৪ দিনের যুদ্ধে আজারবাইজানের বিজয়ের পরে এই অঞ্চলের পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। আজারবাইজান তার ইরান সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলোও রয়েছে যার মধ্য দিয়ে ইরানি ট্রাকগুলো কারাবাখের উপর দিয়ে যাতায়াত করত। ইরানি ট্রাকগুলো অবশ্য ইয়েরেভান হয়ে কারাবাখের আর্মেনিয়ান-জনবহুল অংশে পণ্য বহন অব্যাহত রেখেছে, যা বর্তমানে রাশিয়ার শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বাকু গোরাস-গফান সড়ক দিয়ে যাওয়া ট্রাকের জন্য শুল্ক/ফি নেয়া শুরু করে, যা আর্মেনিয়াকে ইরানের সাথে সংযুক্ত করে। তেহরান আনুষ্ঠানিকভাবে এই অতিরিক্ত খরচের ব্যাপারে নীরব থাকলেও, আর্মেনিয়া থেকে অবৈধভাবে আজারবাইজান প্রবেশের জন্য আজারবাইজান কিছু চালককে গ্রেফতার করে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখনই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করে এবং চালকদের মুক্তির দাবি জানায়। এ ব্যাপারে বাকুতে ইরানি রাষ্ট্রদূতও সক্রিয় তদবির করেন। একই সাথে মোহাম্মদ রেজা আহমদী সাংগারির মতো কিছু ইরানি আইনপ্রণেতা আজারবাইজানকে অপমান করে টুইট করেন যে, ‘আপনার ছোট দেশের বয়স আমাদের সর্বকনিষ্ঠ আইন প্রণেতার চেয়েও কম’। টুইটে আরো বলা হয়, কারাবাখ জয় এবং তুর্কি সমর্থনে ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছে বাকু। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদুল্লাহিয়ান নিউ ইয়র্কে তার আজারবাইজান প্রতিপক্ষের সাথে সাক্ষাতের পর বলেন যে, আজারবাইজান এবং ইরানের মধ্যে ‘তৃতীয় পক্ষ’ রয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এটি ইসরাইলকে নির্দেশ করে, যা কয়েক দশক ধরে আজারবাইজানকে সমর্থন করে আসছে। আজারবাইজানে কয়েক লক্ষ ইহুদির বসবাসও রয়েছে।
হোসেন আমির-আবদুল্লাহিয়ান উল্লেখ করেন যে, সামরিক মহড়াগুলো ছিল ইরানের অভ্যন্তরীণ দর্শকদের জন্য। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, ‘আমরা লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া ও আজারবাইজানে আছি এবং সেখানে থাকব’। তেহরান ইরানের আজারি জনসংখ্যা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। একটি সফল, ধর্মনিরপেক্ষ, আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীন আজারবাইজান ইরানি নাগরিকদের জন্য একটি রোল মডেল হয়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে অনেকের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। তদুপরি, এই অঞ্চলে তুরস্কের প্রত্যাবর্তন আগের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। বাকু ও আঙ্কারা এখন শুশায় স্বাক্ষরিত একটি নিরাপত্তা চুক্তির দ্বারা সংযুক্ত। এই চুক্তি দুটি দেশকে একই নিরাপত্তা বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। কাস্পিয়ান সাগরে উভয় দেশের নৌ-মহড়াগুলোকেও ইরান হুমকি হিসেবে দেখে। তেহরান এখনো এই অঞ্চলের যেকোনো পরিবর্তনের প্রতি অসহিষ্ণু, কারণ দেশটি একই সময়ে আফগানিস্তান, উপসাগর এবং ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করে আসছে।
গত বছর কারাবাখ চুক্তি হওয়ার কিছুদিন পর, ইরানি আইনপ্রণেতা আহমদ বেগিশ এক বিবৃতি দিয়ে তার সরকারকে আজারবাইজান এবং নাখচিভানের মধ্যে ট্রানজিট করিডোরকে স্বীকৃতি না দেয়ার অনুরোধ জানান যা আর্মেনিয়া, তুরস্ক ও ইরানের সীমান্ত দিয়ে যাওয়ার কথা। আজারবাইজানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বেগিশ পার্লামেন্টের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার আহ্বান জানান যে, ইরান এই অঞ্চলের সীমান্তের ভৌগোলিক পরিবর্তন এবং এই প্রশ্নে করিডোরকে স্বীকৃতি দেয় না। দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধের সমাপ্তি চুক্তির ব্যাপারে ইরানি সমালোচকরা তাদের উদ্বেগ গোপন করেননি এবং তারা দাবি করেন যে প্রস্তাবিত করিডোর এবং এর পাশাপাশি চুক্তির অন্যান্য বিধান তাদের দেশের সীমান্তে গুরুতর পরিবর্তন আনবে।
কারাবাখ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, তেহরান আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত হতে আগ্রহী ছিল এবং একাধিক অনুষ্ঠানে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। উপরন্তু, দেশটি আর্মেনিয়াকে তার ভূখণ্ডের মাধ্যমে অস্ত্রের পরিবহন করার বিষয়টিও অস্বীকার করে। এর মাধ্যমে স্পষ্টতই তেহরান ইয়েরেভানকে সমর্থন করার ব্যাপারে দীর্ঘদিনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৯৯৩ সালের পর, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও, তেহরান সাধারণভাবে বাকুর সাথে কোনো বিশেষ সংহতি দেখায়নি এবং আর্মেনিয়ার দিকে ঝুঁকে ছিল বরাবর। এটি ছাড়াও তেহরান-বাকু সম্পর্ককে প্রভাবিত করার আরো অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, তেল আবিব ও ওয়াশিংটন থেকে ইরানের আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের ভূমিকা এবং ইরানের অভ্যন্তরে আজেরি-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ। অন্য দিকে আজারবাইজানও তার ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে ইরানের ধর্মীয় প্রভাবের বিষয়ে আশঙ্কা করে।
মনে হতে পারে না যে ইরান ও আর্মেনিয়া অংশীদার হতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয় যে কট্টর খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হলেও অনেক প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের চেয়েও ইয়েরেভানের সাথে তেহরানের সম্পর্ক শক্তিশালী। এটা স্পষ্ট যে দু’টি দেশ একে অপরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কারণ রয়েছে, কারণ ইরানকে রাশিয়া ও ইউরোপে যাতায়াতের জন্য বিকল্প ক্রসিং সুবিধার জন্য আর্মেনিয়াকে প্রয়োজন, অন্য দিকে আর্মেনিয়ার আজারবাইজানের সাথে যোগাযোগের অভাবের কারণে বাণিজ্যপথে ক্রমাগত বাধার সম্মুখীন যা পূরণ করে ইরান।
আজারবাইজান তেহরানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, কারণ দেশটি ইরান, আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মধ্যে অবস্থিত নাখিভান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে সরবরাহের জন্য তার আকাশসীমা এবং ভূখণ্ডের উপর নির্ভর করে। কারাবাখ জয়ের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতিশীলতা বাকুর পক্ষে পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ ইরানের সীমান্তবর্তী আজারবাইজানের অংশ অবশেষে বাকুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
ইরানের উদ্বেগ ও ভয়
ইরানের দৃষ্টিকোণ অনুসারে, তেহরানের বিরুদ্ধে তেল আবিব একটি যুদ্ধবাজ নীতি গ্রহণ করেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা চ্যালেঞ্জ করার জন্য বাকুকে উসকানি দিচ্ছে। তেহরান দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চলমান মহড়ার জন্য ‘ফতেহান-ই-খায়বার’ শিরোনামটি বেছে নিয়েছে। ফতেহান-ই-খায়বার হলো ৬২৮ সালের খায়বার যুদ্ধের কলব্যাক, যেখানে নবী মোহাম্মদ সা: মদিনার মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরব উপজাতিদের উসকানি দেয়ার খায়বার অঞ্চলের ইহুদিদের মুখোমুখি হন। ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিও সম্প্রতি আজারবাইজানকে ইসরাইলের সাথে মেলামেশা করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছেন, ‘যারা মনে করেন যে বিদেশীদের উপর নির্ভর করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে তাদের জানা উচিত যে তার জন্য এক বিশাল মূল্য দিতে হবে।’
সীমান্তে স্থাপিত সামরিক সরঞ্জামগুলোর ধরন এবং স্কেল এই ইঙ্গিত দেয় যে ইরান বাকুকে ‘আঞ্চলিক দুঃসাহসিকতা’ থেকে বিরত রাখতে চায়; কিন্তু তেহরান শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘর্ষ এড়াতেও চায় বলে মনে হয়। যদি পরিস্থিতির সত্যি সত্যিই অবনতি হয় এবং আজারবাইজান তেহরানের উদ্বেগ ও সতর্কবাণী পাত্তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ইরান সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। আর্মেনীয় মাটি থেকে আঘাত করতে পারে। সেই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে আজারবাইজানের মিত্র, প্রাথমিকভাবে তুরস্ক, বাকুর সমর্থনে ইরানের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে অংশ নিতে প্রস্তুত হবে কি না।
ইরানকে তার জাতীয় নিরাপত্তার লাল রেখাকে নিশ্চিত না করে পিছিয়ে না যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢপ্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। দক্ষিণ ককেশাসের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উন্নয়নের মধ্যে যার কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে। বাকুর উপর যেকোনো বর্ধিত চাপ শুধু তুরস্ক ও রাশিয়াকেই নয়, পশ্চিমা শক্তিকেও সমীকরণে নিয়ে আসতে পারে। তেহরানে আজারবাইজান দূতাবাসে আজারবাইজানি ও ইরানে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে বৈঠকটি এই ইঙ্গিত দেয় যে, বাকু জোটের বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফর্মে সাবধানে খেলাটি খেলছে।
কাস্পিয়ান সাগরের অধিকার নিষ্পত্তির বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কাস্পিয়ান সাগরকে হ্রদ নাকি সমুদ্র হিসাবে গণ্য করা হবে তা নিয়ে বিরোধ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তবে ইরান ছাড়া অন্য চারটি দেশ এর পানি সীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয়ভাবে সমঝোতায় এসেছে। এ ব্যাপারে ইরান এককভাবে তুর্কমেনিস্তান কাজাখস্তান রাশিয়া আজারবাইজানের অনেকটা সম্মিলিত মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে সাগরের এক-পঞ্চমাংশের অধিকার দাবি করে। সব মিলিয়ে মধ্য এশিয়ায় ইরান খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায় এখন আছে বলে মনে হয় না। বরং সেই তুলনায় তুরস্ক তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর এসব দেশের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পথে অনেকদূর এগিয়েছে। ইরান কোনোভাবেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব মেনে নিতে চায় না। আজারবাইজান নিয়ে চলমান উত্তেজনার এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
mrkmmb@gmail.com