ইরানকে সমস্যায় ফেলতে পারে আজারবাইজান?
ইরানকে সমস্যায় ফেলতে পারে আজারবাইজান? - ছবি : সংগৃহীত
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। দুটি দেশই অনেকটা একই ইতিহাস, ধর্ম, জাতি এবং সংস্কৃতির অংশীদার। এখনকার আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র রুশ-পারস্য যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯ শতকের প্রথমার্ধে ইরান থেকে পৃথক হয়েছিল। আরাস নদীর উত্তর এলাকার আজারবাইজান রাশিয়ার দখলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইরানের অংশ ছিল। ইরান ও আজারবাইজান যথাক্রমে বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিয়া জনসংখ্যার দেশ। সেইসাথে শিয়া ইতিহাসে উভয় দেশের অভিন্ন ঘটনাও রয়েছে। তবে আজারিরা হলো তুর্কি বংশোদ্ভূত জাতি গোষ্ঠী। আর দুই দেশের মধ্যে কিছু উত্তেজনাও রয়েছে নানা ইস্যুতে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে আধুনিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। ইরান ১৯৯১ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৯২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তেহরানে আজারবাইজানের একটি দূতাবাস এবং তাবরিজে কনস্যুলেট রয়েছে। উভয় দেশই অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (ইসিও) এবং ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) পূর্ণ সদস্য।
আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের নাগরনো-কারাবাখ দ্বন্দ্বের কারণে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কে কিছুটা শৈথিল্য শুরু হয়। ইরান, আজারবাইজানকে সমর্থন করার পরিবর্তে, আর্মেনিয়াকে সমর্থন করে। যা নিয়ে আজারবাইজানে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ইরানের হাসান রুহানি প্রশাসনের সময় দু’দেশের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। ২০১৫ সালে আজারবাইজানে ইরানের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেন যে ইরান নাগরনো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আজারবাইজান-ইরান সম্পর্ক আরো ভালো করবেন। ইব্রাহিম রইসির নতুন রক্ষণশীল সরকার তেহরানের ক্ষমতায় আসার পর সে অবস্থা আর থাকছে না। আজারবাইজানের শত্রু আর্মেনিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, অন্য দিকে ইরানের শত্রু ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে আজারবাইজান।
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ২০২০ সালের নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধ দক্ষিণ ককেশাসে ইরানের প্রভাব এবং নীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। তেহরান এই সঙ্ঘাতের গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারেনি অথবা যুদ্ধবিরতি আলোচনা ও পরবর্তী শান্তি চুক্তিতেও উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদিও আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের সীমান্ত সঙ্ঘাতে প্রাসঙ্গিক আঞ্চলিক শক্তি ছিল ইরান। সঙ্কট সমাধানে দেশটির অবস্থান ছিল তুরস্ক ও রাশিয়ার এক পাশে। তেহরান বাকুর আঞ্চলিক বিজয়কে সমর্থন করার জন্য আঙ্কারা ও মস্কোর সাথে সম্মত হতে বাধ্য হয়েছিল, যা ইরানের আর্মেনিয়াপন্থী ঐতিহ্যগত অবস্থান থেকে উল্লেখযোগ্য প্রস্থান হিসেবে দেখা যায়।
এখন কিন্তু তেহরান মনে করছে, আজারবাইজান ইরানের সৎ বিশ্বাসের প্রতিদান দেয়নি। আরব, ইউরোপীয় দেশ ও ইসরাইলকে অগ্রাধিকার দেয়ার সময় বাকু জেনে বুঝে নাগরনো-কারাবাখের পুনর্গঠনে তেহরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। তেহরানের ভাবনা অনুসারে, তুরস্ক, ইসরাইল ও পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী সামরিক শক্তি দ্বারা সমর্থিত, আজারবাইজান মনে করেছিল যে এটি ইরানের আঞ্চলিক শক্তির বিষয়ে তার অবস্থানকে শক্তিমান রাখবে। গত মাসে, আঙ্কারা ও ইসলামাবাদের সাথে বাকু যে যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করে, তার লক্ষ্য ছিল তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টা জোরালো করা।
তেহরান মনে করে, যৌথ মহড়া ক্যাস্পিয়ান সাগরের আইনগত অবস্থাসংক্রান্ত কনভেনশনের যে বিধান রয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক। এই বিধান অনুসারে কাস্পিয়ান সাগরে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ। (আজারবাইজান, ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়ান ফেডারেশন এবং তুর্কমেনিস্তান)। একই সাথে বাকু আর্মেনিয়ার সাথে ইরানের যোগাযোগকে চ্যালেঞ্জ করে ইরানি ট্রাকগুলোকে আজারবাইজানের সদ্য দখলকৃত অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়ায় বাধা দেয়। আজারবাইজান চেকপয়েন্ট স্থাপন করে ইরানি ট্রাকের কাছে ফি নেয়া শুরু করে। আজারবাইজানের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে রুটিন পদ্ধতি হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টার বিপরীতে, তেহরান এই নতুন, দৃঢ়চেতা আজারবাইজানকে একটি বৃহত্তর ছবিতে দেখে, যাতে ইরানবিরোধী শক্তির সহায়ক হিসাবে বাকু ইরানের প্রতি ইসরাইলের মতো শত্রুতা করছে বলে ভাবছে তেহরান।
ইরান প্রাথমিকভাবে বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সমর সরঞ্জাম ও সৈন্য মোতায়েনের দায়িত্ব দেয়। কিন্তু এটি ছিল বাকুকে ভয় দেখানোর ইরানের পরিকল্পনার একটি ছোট্ট অংশ। কয়েকদিন পরে, তেহরান আজারবাইজান সীমান্তের কাছে তার নিজস্ব সামরিক মহড়া শুরু করে এবং বলে যে, ‘আমরা কখনোই ইরানি সীমান্তের কাছে ‘প্রক্সি জায়নিস্ট শাসনের উপস্থিতি সহ্য করব না’ অথবা ‘আঞ্চলিক সীমানা এবং ভূ-রাজনীতির কোনো পরিবর্তন’ মেনে নেবো না।
এই ধরনের পদক্ষেপ, ইরানি কর্মকর্তাদের কট্টর মন্তব্যের পাশাপাশি এই ইঙ্গিত দেয় যে তেহরান প্রকৃতপক্ষে তার সীমান্তের কাছাকাছি মারাত্মক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। ইরানের কট্টরপন্থী পত্রিকা কায়হান দাবি করেছে যে, তুর্কি-আমেরিকান পরিকল্পনার ভিত্তিতে, আর্মেনিয়ার ‘পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রপতি’ বাকুর সাথে ‘যোগসাজশে’ “আর্মেনিয়ার সুনিক প্রদেশকে আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করতে চায়”। আজারবাইজানের ব্যাপারে ইরানের ক্ষোভের একমাত্র কারণ এটি।
সুনিক প্রদেশ আজারবাইজানের বাকি অংশকে নাখিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র এক্সক্লেভ থেকে আলাদা করে এবং ইরানের সাথে আর্মেনীয় সীমানা গঠন করে। আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে ২০২০ সালের শান্তি চুক্তিতে আজারবাইজানকে সুনিক প্রদেশের মাধ্যমে নাখিভানকে বাকি আজারবাইজানের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি করিডোর দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এর আগে, সমস্ত সংযোগ দক্ষিণে ইরান বা পশ্চিমে তুরস্কের মাধ্যমে করা হয়েছিল।
তেহরান মনে করছে, বাকু স্পষ্টতই এই পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট নয় এবং পুরো সুনিক প্রদেশ গ্রহণের একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বজায় রেখেছে, যা ইরানকে একটি প্রতিকূল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে ফেলতে পারে। এতে তেহরান আর্মেনিয়ার সাথে তার সংযোগ এবং এই অঞ্চলে সুবিধাজনক প্রবেশাধিকার হারিয়ে ফেলবে। আর এতে তেহরানকে একটি নতুন উৎসাহিত আঞ্চলিক শক্তির সাথে মোকাবেলা করতে বাধ্য হতে হবে যার সাথে ইরানের চিরশত্রু ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।