চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব : একটি সরল সমীকরণ
চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব : একটি সরল সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
আমেরিকা এখন গভীরভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। নিপুণভাবে সাজিয়ে নিচ্ছে সমীকরণের নয়া ধারাপাত। প্রধান টার্গেট চীন। তাই বন্ধুত্বে আনতে হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। একসময় মুসলমান ‘জঙ্গি’ থাকলেও এখন তারা ‘শান্তিবাহী’। গ্লোবাল কর্তৃত্ব রক্ষার তাগিদে তাদেরও কাছে টানা প্রয়োজন। এজন্য আফগান থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনা। ফিরে আসা ইরাক সমর থেকে। যুদ্ধাংদেহী মানসিকতা মার্কিন অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আনা হয়েছে নীতিতে পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘এখন সৈন্য পাঠিয়ে অন্য দেশের কল্যাণ সাধনের দিন শেষ। সবাইকে নিজ দেশের সমাধান নিজেদেরই করতে হবে।’
তবে দূর থেকে কলকাঠি নাড়ার ইচ্ছেটা এখনো তারা পুষে। নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার জানান দিয়ে চলেছে। এখন মূল টার্গেট চীন। সেনা-অর্থ ও মেধা সেদিকেই ব্যয় করতে হবে। এজন্যই অকাসের আলাদা কোয়াড। আমেরিকা-ব্রিটেন-অষ্ট্রেলিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া। কিছুতেই চীনকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। অর্থবাণিজ্যের বাজারে যথেষ্ট দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। বিশ্বের দশটি বৃহত্তম অর্থনৈতিক কর্পোরেশনের পাঁচটিই চীনভিত্তিক। সামরিকভাবেও অনেক শক্তি অর্জন করেছে। সামনে আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। অর্থনৈতিক অবরোধকেও উতরে যাবে। তখন আমেরিকার পক্ষে গ্লোবাল নেতৃত্ব টেকানোই দায় হয়ে পড়বে। তাই এখনই তার গতি থামিয়ে দিতে হবে। এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। আমেরিকা তাই চীনের দুর্বল দিক থেকে আঘাত হানার চেষ্টা করছে।
চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে বাণিজ্যের অবদান সবচে বেশি। আর এই বাণিজ্যের সিংহভাগই পরিবাহিত হয় সমুদ্র পথে। সেজন্য সমুদ্র পথে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা গেলে চীনকে চাপের মুখে ফেলা সম্ভব। তাদের মোড়লিপনার উচ্চাভিলাষের গুড়েও বালি পড়বে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে প্রতিবেশিদের সাথে চলতে থাকা চীনের বিরোধ হতে পারে এর মোক্ষম অবলম্বন। তাইওয়ান নিয়ে রেশারেশির জেরে ব্রিটেনকেও সাথে পাওয়া যাবে। সেজন্যই আমেরিকা-ব্রিটেন-অষ্ট্রেলিয়া (অকাস) কোয়াড।
চীনের দুর্বলতার একটি দিক হলো দেশের অভ্যন্তরীন স্বাধীনতাকামী নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠী। আমেরিকা এদিক থেকেও চীনকে নাজেহাল করার চিন্তা-ভাবনা করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প তার ক্ষমতার শেষদিকে উইঘুর মুসলিমদের বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসনও ট্রাম্পের দেখানো পথেই হাঁটবেন। এবং জিনজিয়াং, হংকং, তিব্বতসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠিকে জোরালো সমর্থন দিবেন। এবং অভ্যন্তরীণভাবে চীনে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির চেষ্টা চালাবেন।
চীনের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নানা অবরোধ আরোপের মাধ্যমে চীনের বিনিয়োগ পরিসরকে সংকুচিত করা হচ্ছে। নিরপেক্ষ বলয়কেও চাপে ফেলে চীন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। মোটকথা হাতে থাকা সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে চীনের অর্থনৈতিক ভিতে চির ধরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আমেরিকা।
বাণিজ্যিক পরিসরে নিজের অবাধ কর্তৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় চীন। এটা সম্ভব হলে খুব সহজেই চীন আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধকে উতরে যেতে পারবে। তখন আর চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। এজন্য বৈশ্বিক অর্থবাণিজ্যে নিজের একচ্ছত্র প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, চীনা মুদ্রা ইউয়ান যেন কোনভাবেই ডলারের বিকল্প বিনিময় মাধ্যম না হতে পারে।
আরো নানাভাবে চীনের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখতে আমেরিকা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকার পক্ষ্যে আদৌ কি চীনকে প্রতিহত করা সম্ভব? অনেক বিশ্লেষক তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এর যৌক্তিক নানা কারণও তারা উল্লেখ করেছেন। যেমন অকাস কোয়াডের কথাই বিবেচনায় আনা যাক। দক্ষিণ চীন সাগরে অস্থিতিশীলতা তৈরির উপায় হিসেবে তা গঠন করা হয়েছে। এটা দ্বারা দক্ষিণ চীন সাগরকে আদৌ অশান্ত করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অষ্ট্রেলিয়া চীনের মূল প্রতিপক্ষ নয়। চীনের মূল প্রতিপক্ষ হলো দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। এদের কেউ এখানে আমেরিকার উপস্থিতি মানতে রাজি নয়। বরং সমঝোতার ভিত্তিতে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাতে চায়। তাছাড়া অষ্ট্রেলিয়ার মাধ্যমে আমেরিকা কতটুকু সফল হতে পারবে, তা নিয়েও কথা রয়েছে। অষ্ট্রেলিয়া একটি রফতানি নির্ভর দেশ। এবং রফতানি শিল্পে তারা অনেকটাই চীনের উপর নির্ভরশীল। তবে চীননির্ভর দেশ দ্বারা কি চীনকে চাপে ফেলা সম্ভব? এজন্য অকাস কোয়াডকে অনেক বিশ্লেষকই একটি অনর্থক কোয়াড হিসেবে দেখছেন। এই কোয়াড গঠিত হওয়ার পর চীনা প্রেসিডেন্টও একে অনর্থক আখ্যা দিয়েছেন। এই কোয়াডে অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ও ব্রিটেন হয়তো লাভবান হবে। কিন্তু এর কারণে মার্কিন বলয়ের অন্যতম সহযোগী ফ্রান্সের সাথে তাদের একটা তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হবে। এবং ফ্রান্সের বাণিজ্যমন্ত্রীর শালীনতা বিবর্জিত কথাবার্তা তো তিক্ততা অনেক দূর পর্যন্ত গড়ানোর ইঙ্গিত দেয়।
চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পাদিত হয়। তাদের কাছে সমুদ্রপথেই পণ্য পরিবহন করতে হয়। এজন্য চীন দক্ষিণ চীন সাগর-মালাক্কা প্রণালী-বঙ্গোপোসাগর-ভারত মহাসাগরের এই অনিরাপদ পথ এড়াতে বিকল্প হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগড় (উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল) থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তানকে লম্বালম্বিভাবে ছেদ করে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরে গিয়ে শেষ হবে। গোয়াদর বন্দরটি আরব সাগরের তীরে অবস্থিত। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অনিরাপদ সমুদ্রপথ থেকে চীন অনেকটাই নিরাপদ হয়ে যাবে। তখন আমেরিকার এই কোয়াডের স্বার্থকতা আর কী থাকবে?
আমেরিকা চীনের বাণিজ্যক্ষেত্রগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করলেও এক্ষেত্রে তাদেরকে থামানো মুশকিল। কারণ, এখন বিশ্ব বাণিজ্যের ৫০ ভাগ কেবলই চীনের মালিকানায়। বিশ্বের বৃহত্তম দশটি অর্থনৈতিক কর্পোরেশনের পাঁচটিই চীনভিত্তিক। জ্বালানী শিল্পের বিরাট অবস্থান দখল করে রেখেছে রাশিয়ার মতো চীনা বলয়ের অন্যতম সহযোগী বন্ধুপ্রতিম দেশ। এজন্য মার্কিন বলয়ে হয়তো তাদের বিনিয়োগ ক্ষেত্র সংকোচন করা যাবে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রা থামানো মুশকিল। তাছাড়া কৌশলগত সম্পর্কে মার্কিন বলয়ের হয়েও অনেক দেশ আবার অর্থনৈতিকভাবে চীনকে খুব তোয়াজ করে চলে। মার্কিন বলয়ের যেসব দেশে স্বৈরশাসক ক্ষমতা দখল করে বসে, মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হওয়ার কারণে (যদিও তা নাম কা ওয়াস্তে) আমেরিকার প্রতি তাদের নির্ভরতা কম হয়। চীন যেহেতু মানবাধিকার নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, এজন্য সহজেই তাদেরকে চীনা বলয়ে টেনে নিতে পারে। আমেরিকার অর্থনৈতিক অবোরোধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলে। তৃতীয় বলয়ের সাথেও রয়েছে চীনের ভালো সম্পর্ক। এজন্য চীনের বাণিজ্যক্ষেত্র দিন দিন অনেক প্রসারিত হচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক করিডোরকে ক্ষতিগ্রস্থ করা তাই অতো সহজ ব্যাপার নয়।
তাছাড়া চীন এখন তার অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেন প্রক্রিয়ায় মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা উয়ান চালু করার চেষ্টা করছে। প্রাথমিকভাবে চীন নিজ বলয়ে এই ব্যবস্থা চালু করবে। পরে তা আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিস্তৃত করবে। এক্ষেত্রে চীন-রাশিয়া এক জোট হয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসরও হয়েছে। তারা এতে সফল হলে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের একক কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে। এর মধ্য দিয়ে কার্র্যত আমেরিকা দন্তহীন বাঘেই পরিণত হবে।
বিশ্বময় আমেরিকার অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে বিশ্ব ব্যাংক সবচে বড় ভূমিকা পালন করে। তার মোকাবেলায় চীন দাঁড় করাতে চায় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এর সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে চীন বিশ্ব ব্যাপী তার আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার যে সব দেশ এখনো চীনা বলয়ের বাইরে রয়েছে, তাদেরকে কাউন্টার করার জন্য শুল্কবিহিন রফতানি, দীর্ঘমেয়াদি ঋণসহ চীন নানা আকর্ষণীয় অফার দেয়ার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশগুলোকেও নিজ বলয়ে শামিল করার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিতও দিয়েছে। অন্যান্য দেশকেও কাউন্টার করে নিতে পারবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
সময় যত অগ্রসর হচ্ছে, বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমেই চীনা বলয়ের অনুকূলে যাচ্ছে। এজন্য বিশ্লেষকের ধারণা, আগামী পৃথিবীর গ্লোবাল নেতৃত্বে থাকবে চীন ও চীনা বলয়ের দেশগুলো।