অস্ট্রেলিয়াকে কেন পরমাণু ক্লাবে টেনে আনা হচ্ছে?

জসিম উদ্দিন | Oct 07, 2021 05:20 pm
অস্ট্রেলিয়াকে কেন পরমাণু ক্লাবে টেনে আনা হচ্ছে?

অস্ট্রেলিয়াকে কেন পরমাণু ক্লাবে টেনে আনা হচ্ছে? - ছবি সংগৃহীত

 

পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া মিলে নতুন একটি ‘সামরিক ক্লাব’ করেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘোষণার মাধ্যমে ‘অকাস’ নামে সেটি আত্মপ্রকাশ করেছে। এ ক্লাবের প্রধান কাজ হচ্ছে, ত্রয়ী মিলে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করবে অস্ট্রেলিয়ার জন্য। সহযোগী প্রধান দেশটি সবার আগে এ ধরনের সাবমেরিন তৈরি করে। তার পর ১৯৫৮ সালে তাদের প্রাণের বন্ধু যুক্তরাজ্যকে সে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে।

নতুন চুক্তিটি বিশ্বমোড়লদের ক‚টনামি ও ভণ্ডামিকে প্রকাশ করে দিলো। এর পেছনে সামরিক আধিপত্য বিস্তারের বাইরে অর্থনৈতিক লাভালাভে সঙ্কীর্ণ একটি লোভী দৃষ্টিভঙ্গিও কাজ করেছে। ২০১৬ সালে উন্নত সাবমেরিন তৈরি করে দেয়ার জন্য ফ্রান্সের সাথে চুক্তি করে অস্ট্রেলিয়া। বিগত চার বছরে চুক্তি অনুযায়ী কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। ২০৩৫ সালে সাবমেরিন হস্তান্তর করার কথা ছিল। এ বাবদ ৯০ বিলিয়ন ডলারের লোভনীয় অফারটি একান্তভাবে ছিল ফ্রান্সের। অকাস হওয়ার আগে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া চুক্তি বাতিল করে ফ্রান্সের সাথে। বিপুল বাণিজ্য হারানোর শোকে ফ্রান্স ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট একে ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্স তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে কথা বলছেন ক‚টনীতির ভাষায়, সেটি শিষ্টাচারবহিভর্‚ত। ফ্রান্সের কাঁচা অর্থ লাভের ব্যবসাটি বেনিয়া ব্রিটিশরা তাদের রক্তের বন্ধু আমেরিকানদের সাথে ষড়যন্ত্র করেই একপ্রকার বাগিয়ে নিলো। এ ধরনের একটি সামরিক জোট গঠনে ফ্রান্সকে সাথে না রাখা, অন্য দিকে বাণিজ্যটা কেড়ে নেয়ার কষ্ট ফ্রান্সকে বহুদিন কুরে কুরে খাবে।

পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধে বৈশ্বিক চুক্তি কার্যকর রয়েছে। এর আওতায় নতুন করে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে না। অন্য দিকে এর ভাণ্ডার ও মজুদ বাড়ানোর কাজও বিশ্বে চলছে না। অস্ট্রেলিয়ার জন্য তৈরি এ সাবমেরিনে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু জ্বালানি ব্যবহার করা হবে। এতে ব্যবহৃত ইউরোনিয়াম পরমাণু বোমা তৈরির উপযুক্ত। এ চুক্তিটি কি সরাসরি পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি লঙ্ঘন করছে না? না, এ কাজ যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বে হবে বলে ‘ছাড়’ পাওয়া যাবে। বিশ্ব মাতব্বরদের কাজ নিয়ে সম্ভবত কেউ কিছু বলতে পারবে না।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়াকে কেন পরমাণু ক্লাবে টেনে আনা হচ্ছে? মূলত দেশটি চীনের পাশে হলেও অতটা কাছে নয়। দক্ষিণ চীন সাগরের মোটামুটি দূরবর্তী প্রান্তে এর অবস্থান। বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রতিপক্ষরা হলো ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। এসব দেশের সাথে সাগর নিয়ে চীনের বিরোধ। এ বিরোধে সবসময় অংশীদার হতে চাচ্ছে আমেরিকা। তারা তাইওয়ানকে নিয়ে সবসময় চীনের বিরুদ্ধে একটি প্রক্সি ওয়্যার অব্যাহত রেখেছে। বিগত দুই দশকে দেখা গেছে, ভারতকে কাছে টেনে চীনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করানো হয়েছে। ভারত আঞ্চলিক ইজারা নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু চীনের সাথে মল্লযুদ্ধে যায়নি। এ সুযোগে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানা ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি করে নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সে শক্তি ব্যয় করেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমেরিকার অনেক বন্ধু ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। ভারত দ্বারা চীনকে কোনো ধরনের মোকাবেলা করানো যায়নি। ভারতকে দিয়ে চীনকে পেছন থেকে আটকে ধরার আমেরিকার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

যেকোনো মূল্যে চীনকে আটকাতে চায় আমেরিকা। আফ্রিকার দরিদ্র মানুষকে করোনা থেকে বাঁচানোর চেয়ে এই ‘খেলা’ তাদের বেশি বিনোদন দেয়। আধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসা দুটোকে একসাথে পাওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাথে তারা জোট বেঁধেছে। এর দ্বারা চীনের বিরুদ্ধে কার্যকর পরোক্ষ যুদ্ধও বেগবান করা যাবে, যা জাপান ও ভারতকে দিয়ে সম্ভব হচ্ছিল না। এমনকি চীনের সাথে বিরোধে জড়ানোতে অনাগ্রহী আসিয়ান সদস্যদের দ্বারাও সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারীরা ব্রিটিশ আমেরিকানদের উত্তরাধিকার বহন করে। এর মানে তারা তাদের পিতৃপুরুষের কাছেই ফিরে যাচ্ছে।

ধনী দেশগুলোর উদ্বৃত্ত সম্পদ তা হলে কী কাজে এলো? নজিরবিহীন যে ক্লাব তারা গড়ে তুলতে যাচ্ছে, এতে ওই অঞ্চলে আরো বিপুল সামরিকীকরণ হবে। ফলে নতুন নতুন অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বাড়বে। সারা বিশ্বের উদ্বৃত্ত অর্থের একটি অংশ এর পেছনে ব্যয় হতে থাকবে। মোটকথা হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বিপুল অর্থের অপচয় বহু মানুষের প্রাণহানি ও বহু মানুষকে উদ্বাস্তু করার পর আমেরিকা আবারো অন্য একটি আক্রমণাত্মক প্রকল্পই গ্রহণ করল। এর দ্বারা মানবতার কোনো উপকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এসব ধনী দেশ মানুষের গরিবি লাঘব হতে পারত। তা না করে তারা পছন্দ করে নিলো যুদ্ধ হাঙ্গামা বাড়ানোর কাজ। কোনো একটি দামি খাবার খেতে না পারলে যদি গরিবের ঘোড়া রোগ হয়, তা হলে ধনীদের এই অনাচারকে কি ‘ধনীদের ঘোড়া রোগ’ বলা যাবে?


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us