সিপাঝাড় : আসামের সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে
সিপাঝাড় : আসামের সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের আসাম রাজ্যের সিপাঝাড়ের গরুখুঁটি এলাকায় যে নৃশংস উচ্ছেদ অভিযান এবং হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে– তা এখন সারা পৃথিবীতে নিন্দিত হচ্ছে। যেভাবে ভারতের নাগরিক এবং নদীর ভাঙনে ঘরহারা মুসলিমদের ৪০- ৫০ বছরের বসতবাটি– জমি থেকে হিমন্ত উৎখাত করেছেন– তা হিটলারি নির্যাতনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সবথেকে বড় কথা– হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আগের মতোই তার এইসব কাজের জন্য মোটেই অনুতপ্ত নন। অনুতপ্ত তো দূরের কথা– তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিতও নন। আসলে ফ্যাসিবাদীদের মন-মানসিকতা ও আচরণ বোধহয় এই ধরনেরই হয়ে থাকে। এখন হিমন্ত যোগী আদিত্যনাথকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কোথায় তিনি যারা আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে রয়েছে– কিংবা যারা উৎখাত হয়ে এই বর্ষার মধ্যে মা-বোন ও সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন– তাঁদের জন্য তিনি মানবিক সাহায্যে ব্যবস্থা করবেন– পরিবর্তে তিনি আরও দমন-পীড়নের ছক তৈরি করে নিয়েছেন। তৈরি করে নিয়েছেন কীভাবে এই অসহায় মানুষগুলির উপর ‘আইনগতভাবে’ দমন– অত্যাচার– নির্যাতন ও ভীতিপ্রদর্শনের স্টিম রোলার চালানো যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল– মানবাধিকার সংগঠন নিন্দা ও আবেদন করলেও হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আরও উগ্র ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এর মধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে– গরুখুঁটি গ্রামে যে উত্তেজনা ও সহিংসতা হয়– তার পিছনে রয়েছে পুলিশের নির্দয় আক্রমণ ও নৃশংস অভিযান। সশস্ত্র পুলিশ সহযোগীদের নিয়ে তাদের অমানুষ ফটোগ্রাফারের নির্যাতনের ছবি সারাবিশ্বে প্রকাশিত হয়েছে। চাপের মুখে ওই ফটোগ্রাফারকে গ্রেফতার করলেও যে পুলিশরা অর্ধমৃত বা লাশের উপর নৃশংসতা করার ক্ষেত্রে তার সহযোগী হয়েছিল– তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না বলে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাই দরং-এর পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন।
নির্যাতিতদের সমবেদনা জানানো তো দূরের থাকুক– হিমন্ত সরকার উচ্ছেদকৃতদের দমন করার জন্য যে নকশা তৈরি করেছে– এখন তার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। অসম পুলিশ প্রথমে ওই অঞ্চলের দুর্গত পরিবারবর্গের দু’জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। এদের নাম আসমত আলি আহমেদ (৩৭) ও চাঁদ মামুদ (৪৭)। এরা ধলপুর ও কিরাকারা গ্রামের বাসিন্দা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ– এরা নাকি দরিদ্র মানুষদের ঘর ভাঙার সময় পুলিশকে বাধা দেওয়ার প্ররোচনা দিয়েছিল। উচ্ছেদ অভিযানের সময় তারা নাকি বাসিন্দাদের ঘরের মধ্যেই থেকেই পুলিশকে বাধা দিতে বলেন। হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাই সুশান্ত বিশ্ব শর্মা দরং জেলার পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেছেন– এদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ষড়যন্ত্র করার জন্য বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশ খুনের চেষ্টা করার ধারাও এদের উপর জারি করা হয়েছে। তবে পুলিশ সুপার এটাও বলেছেন– এই দুই ব্যক্তির সঙ্গে পিএফআই-এর কোনও সংযোগ পাওয়া যায়নি। এরা এই এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য।
এ দিকে সমালোচনার মুখে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ‘মুসলিম আতঙ্ক’ তৈরি করতে পিএফআই-হাজির করেছেন। তার বক্তব্য– পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া নামে যে সামাজিক সংস্থাটি রয়েছে– যত গণ্ডগোলের মূলেই নাকি তারাই!
এই সংস্থাটি মোটামুটি কেরল– কর্নাটক– উত্তরপ্রদেশে কাজ করে। তারাই নাকি দরং-এ গরুখুঁটি প্রত্যন্ত এলাকায় হাজির হয়ে গেছেন এবং সেখানে হিমন্তবাবুর বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছেন। ওই এলাকায় পিএফআই-এর বিরুদ্ধে কোনও থানায় এফআইআর নেই। কিন্তু কাউকে তো হাজির করতে হবে!
হিমন্তর বক্তব্য– এদের নিষিদ্ধ করতে হবে এবং গণহারে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে হবে। আর তাহলেই সমস্যার সমাধান!
হিমন্ত বলছেন– কিছু লোক এই উচ্ছেদকৃত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য ২৮ লক্ষ টাকা তুলেছেন। হয়তো এই টাকা সংগ্রহের রিসিপ্টগুলি হিমন্তের হাতে ইতিমধ্যেই এসে গেছে!
নইলে পাক্কা ২৮ লক্ষ কী করে বললেন? অর্থাৎ এই ঘরহারা এবং সমস্ত সংস্থান বঞ্চিত এই মানুষগুলো না খেয়ে হিমন্তর সামনে তড়পে তড়পে মরুক– এটাই কি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী চান? কেউ এদের সাহায্যও করতে পারবে না! ঘর ভাঙলে কেউ প্রতিবাদ তো দূরে থাকুক– মুখে টুঁ শব্দ করতে পারবে না। কারণ– এখন মাননীয় হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসমে রাজ করছেন।
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি থেকে গুয়াহাটিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে ছিলেন জমিয়তে-উলামায়ে-হিন্দ– জামায়াত-ই-ইসলামি-হিন্দ প্রভৃতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিরা। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাদের সাক্ষাতের জন্য সময় দেয়াতে অনেকে অবাক হন। পরে জানা যায়– এই বৈঠকের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এইউডিএফ-এর সর্বেসর্বা মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল। হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সঙ্গে বদরুদ্দিন আজমলের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে– সে কথা সারা আসাম জানে। কিন্তু অনেকেই বলছেন– এই বৈঠকে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মুসলিম নেতৃবৃন্দকে খানিকটা ধোকাই দিয়েছেন। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই বৈঠক সম্পর্কে কোনো বিবৃতি দেননি। কিন্তু মুসলিম নেতৃবৃন্দ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান– হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাদের বলেছেন– আপনারা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সেখানে যান– কোনো অসুবিধা নেই। নতুন করে কারো উপর জুলুম করা হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকার চায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। বিকল্প জমির কথাও ভাবা যেতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ওই দিনই হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ওই দুর্গত এলাকার ভিক্টিমদের গ্রেফতারি শুরু করেন। কোনো সাহায্য দেয়া দূরের কথা– যারা সাহায্য নিয়ে যাচ্ছেন তাদেরই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কোনোরকম শিথিলতা দেখানো হচ্ছে না। বরং ঘোষণা করা হয়েছে– নতুন করে উচ্ছেদ করা হবে। উচ্ছেদ চলবে অন্যান্য জায়গাতেও। আর কারা এর শিকার হবে? বলা বাহুল্য– শিকার হবে আসামের অসহায় সংখ্যালঘুরাই। বিজেপি ও সংঘ পরিবারে হিমন্তের সুখ্যাতি তুঙ্গে উঠবে।
সদ্য সদ্য (৩০ সেপ্টেম্বর) মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নাম না করে স্পষ্ট ইঙ্গিতে বলেছেন– ২০৫০ সালে নাকি ‘এরা’ পুরো আসামে ক্ষমতা দখল করে ফেলবে। যদি রাজ্যের একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এই ধরনের কথা বলেন– তাহলে সেখানে শান্তি বজায় থাকা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে আসামে মুসলিমদের ভবিষ্যৎ কি? যদি হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই ধরনের ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন– সেক্ষেত্রে অসমের ৩৬ শতাংশ মুসলিম যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে এবং যেকোনও সময় উচ্ছেদ ও অত্যাচারের শিকার হবে– তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র : পুবের কলম