আসাম : অনুপ্রবেশকারী ঠেকানো বনাম নীরব উচ্ছেদ প্রক্রিয়া
আসাম : অনুপ্রবেশকারী ঠেকানো বনাম নীরব উচ্ছেদ প্রক্রিয়া - ছবি সংগৃহীত
সম্প্রতি ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দ্বারাং জেলায় সরকারিভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় ৮০০ পরিবারের বসতবাড়ির ওপর। আসাম সরকারের দাবি, ওই বসতভিটাগুলো সরকারি জমির ওপর অবস্থিত এবং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা এখানে বসবাস করছে অবৈধভাবে। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় দুজন সাধারণ লোক পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
সরকারের এমন দাবির বিপক্ষে সেখানকার বসবাসকারী পরিবাররা আসাম হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। কোর্টে মামলাটার শুনানি এখনো চলছে। এমন অবস্থায় উচ্ছেদ অভিযান চালানোর কোনো নিয়মই নেই। কিন্তু আসাম মুল্লুকে বর্তমানে অনিয়মই যেন নিয়ম!
বাংলাদেশে যদি কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়, তখন আমরা দেখি মিডিয়াসহ দেশের বেশিরভাগ মানুষ সংখ্যালঘুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। অথচ আসামে উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে একজন প্রতিরোধকারী সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকলে তার ওপর নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সাংবাদিক। পরে ওই সাংবাদিককে পুলিশ সদস্যদের সাথে কোলাকুলি করতেও দেখা যায়। যদিও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আসাম রাজ্যের দ্বারাং জেলাটি ৬৪ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত। এই জেলায় জাতিগতভাবে ৪৯ ভাগ বাঙালির বসবাস এবং অসমীয়া হলো ৪৯ ভাগ। আর উচ্ছেদকৃত ৮০০ পরিবারের সবাই বাংলাভাষী মুসলিম। আসামে বাংলাভাষী মুসলিম মানেই বাংলাদেশী- এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার এমন অপপ্রচারের নিন্দা জানানো হলেও আসামে থেমে নেই অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের অপপ্রচার। আর এতে করে ভারত থেকে উচ্ছেদ হওয়ার হুমকিতে রয়েছে আসামের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা।
আর এই মুসলিমরা একবার উচ্ছেদের সম্মুখীন হলে কোথায় যাত্রা করবে? অবশ্যই বাংলাদেশ! আর তাই আসামের এই সংকটটি শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা। আসামে ধর্মীয় মেরুকরণ থামানো না গেলে আরেকটি আরাকান দেখতে হবে বাংলাদেশকে!
আমরা বাংলাদেশীরা কি এটা নিয়ে ওয়াকিবহাল? সরকারিভাবে বারবার আসাম নিয়ে ভারতীয় অবস্থানের নিন্দা জানানো হলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আসাম নিয়ে একদমই কনসার্ন না। আমাদের ভাবনায় সাত সাগর তেরো নদী পারের অঞ্চলগুলো থাকলেও নিকটবর্তী আসামের দুর্যোগ নিয়ে কেন জানি চিন্তিত নই আমরা!
আসামের ' অবৈধ বাংলাদেশী ' তত্ত্বের পিছনের রহস্য সম্পর্কে দেখে আসা যাক।
১…
ভারতের রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের পর সবচেয়ে বেশি যে রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে সেটি হলো আসাম। তবে আশ্চর্যজনক যে আমরা পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্ক যেভাবে জানি এবং খবর রাখি, আসাম সম্পর্কে তার এক শতাংশও খবর রাখি না।
বাংলাদেশীরা আসামের খবর না রাখলেও এই আসামের রাজনীতিতে কিন্তু সবসময়ই বাংলাদেশ একটা বড় ফ্যক্টর!
আসামের বেশিরভাগ জনগণ অসমীয়া ভাষায় কথা বললেও বাংলাভাষী জনসংখ্যা রয়েছে ২৮ ভাগ । বরাক উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র নদের চরের জেলাগুলোতে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর এই বাংলা ভাষী জনগণের সাথে বিরোধ রয়েছে অসমীয়া জাতিগোষ্ঠীর।
আসামে মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে ৩৭ ভাগ। অর্থাৎ অসমীয়া ও বাঙালি দুই জাতির মুসলিমই আসামে বসবাস করছে। আসামের ২৮টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে আসামে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। আর তাই অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ তত্ত্বটি আরো বেশি পালে হাওয়া পাচ্ছে আসামে।
অথচ মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ যে অধিক জন্মহার সেটি বলা হচ্ছে না। আর বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আসাম থেকে অনেক এগিয়ে, তাই এদেশ থেকে আসামে কোনো অনুপ্রবেশ হওয়ার প্রশ্নই আসে না, এমন বিবৃতি বারবার দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন।
২…
মোগল সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের প্রায় অঞ্চলই নিজেদের করায়ত্তে আনতে পারলেও আসামকে কখনো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়নি। সর্বপ্রথম ১৮২৬ সালে অহোম রাজাদের হারিয়ে ইংরেজরা আসামকে দখল করতে সক্ষম হয়।
পাহাড়ি আসাম অঞ্চলে তখন ব্রিটিশরা চা চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু আসামের জনসংখ্যা কম হওয়ায় বিহার, ছত্তিসগড় প্রদেশ থেকে অনেক শ্রমিক প্রদেশটিতে আনা হয়। আবার এই শ্রমিকদের খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্য বেশ কিছু সংখ্যক কৃষক আসামে মাইগ্রেন্ট হয় বাংলাদেশের রংপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে।
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলা'র অবিচ্ছেদ্য অংশ সিলেট কে বাংলা থেকে বের করে আসামের সাথে জুড়ে দেয়। আর তখন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক নানা কারণে কিছু সংখ্যাক বাংলাভাষী সিলেটিরা আসামে মাইগ্রেন্ট হন।
১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত সিলেট আসামের অংশ ছিল। তাই এই অঞ্চল ১৯৪৭-এর আগ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আসামে কিছু মানুষ স্থানান্তরিত হন। পাশাপাশি আসাম- বেঙ্গল রেলওয়েতে কাজ করার সুবাদেও অনেক বাঙালি আসামে আবাস গড়েন। এভাবেই মূলত আসামে বাঙালি কমিউনিটি শক্তিশালী হয়।
৩…
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে অসমীয়া জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে ধারণা পেয়ে বসে, অতিরিক্ত বাঙালি জনগণের কারণে অসমীয়ারা আসামে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। এতে করে একটা সময় আসামজুড়ে বাঙালিবিরোধী সেন্টিমেন্ট গড়ে তোলে অসমীয়ারা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আরেক দফা মাইগ্রেশনের কবলে পড়ে আসাম। যুদ্ধশেষে বেশিরভাগ বাংলাদেশী নিজ দেশে ফিরে গেলেও কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী আসামে থেকে যায়। এই ঘটনার পর ( কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে ) আসামে বাঙালিবিরোধী সেন্টিমেন্ট আরো জোরদার হয়।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে আসামের বোরো জনগণ ( স্থানীয় একটি গোষ্ঠী ) বাঙালিদের উপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়৷ এতে আসামে কয়েক হাজার বাঙালি মারা যান, যার বেশিরভাগই মুসলিম।
★ অসমীয়রা চাই কি?
অসমীয়া জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি হলো এনআরসি করা। অর্থাৎ সরকার আসামের জনগণের তালিকা করবে। তালিকার বাইরে যারা থাকবে তারাই অবৈধ অভিবাসী, তাদের আসাম থেকে বের করে দিতে হবে। কংগ্রেস সরকার এনআরসি বিল পাশ করালেও কখনো নাগরিকত্বের তালিকা তৈরির কাজ করে নি। এতে করে কংগ্রেসের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে অসমীয়ারা।
অর্থাৎ এই বিরোধটা ছিলো অসমীয়া- বাঙালি বিরোধ। কোনো হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নয়। কিন্তু ২০১৬ সালে বিজেপি আসামে সরকার গঠনের পর একটি নতুন বিল পাস করে 'সিএএ'-এর নামে। 'সিএএ' আসামজুড়ে বিরোধ আরো বাড়িয়ে তোলে এবং জাতিগত সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যায় পর্যবসিত করে।
'সিএএ' বিলের মেইন কথা হলো, এনআরসির তালিকা থেকে বাদ গেলেও অমুসলিম জনগণ ভারতের নাগরিকত্ব পাবে। এই " সিএএ " বিলের বিরুদ্ধে শুধু যে মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিবাদ জানিয়েছে তা নয়, অসমীয়া জনগোষ্ঠী ও এটি মেনে নেয়নি। অসমীয়াদের মতে আমরা অবৈধ অভিবাসী মুক্ত আসাম চায়, অবৈধ মুসলিম অভিবাসী না শুধু।
আসামে বর্তমানে প্রধান চারটি পক্ষ গড়ে উঠেছে
১) অসমীয়া হিন্দু : এরা চাই হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের বাংলাভাষী লোককে অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করা হোক।
২) অসমীয়া মুসলিম : এরা এনআরসি নিয়ে চুপ। তবে সিএএ এর বিপক্ষে।
৩) বাঙালি মুসলিম : এনআরসি করা হচ্ছে মূলত এই পক্ষকে বহিরাগত প্রমাণ করাতে।
৪) বাঙালি হিন্দু : এনআরসিতে এদেরও বেশিরভাগ বহিরাগত হিসেবে উঠে আসছে। তবে এদের নাগরিকত্ব দিতে আলাদা করে 'সিএএ' বিল তৈরি করেছে বিজেপি সরকার। আর এতে কিছু অসমীয়া জনগোষ্ঠী ( হিন্দু + মুসলিম ) ক্ষুব্ধ।
এনআরসিতে বহিরাগত হিসেবে তাদেরই ধরা হচ্ছে, যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর আসামে বসবাস করা শুরু করেছে।
৪...
আসামের সব মুসলিমই কি বাঙালি?
২০২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আসামে মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ। যার মধ্যে বাঙালি মুসলিম হলো ৯৭ লাখ। বাকি ৪৩ লাখ মুসলিম অসমীয়া জনগোষ্ঠীর।
মূলত বহিরাগত বা অভিবাসী বিতর্কে অসমীয়া মুসলমানদের কথা আসে না। কারণ অসমীয়রা হাজার বছর ধরে আসামে বসবাস করছে।
মূলত এই ৯৭ লাখ বাঙালি মুসলিমকেই বহিরাগত হিসেবে টার্গেট করে এনআরসি চালায় আসামের বিজেপি সরকার। বিজেপি আসামের অসমীয়া বাঙালি বিরোধকে রূপান্তরিত করেছে হিন্দু মুসলিম বিরোধ হিসেবে। তাদের ধারণা ছিলো এনআরসির জালে অন্তত ৮০ লাখ বাঙালি মুসলিম ধরা খাবে। কিন্তু জরিপ শেষে দেখা হলো প্রায় ৯৫ ভাগ বাঙালি মুসলিম নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এতে করে নিজেদের জিঘাংসা বাস্তবায়নে হোঁচট খায় আসাম সরকার।
হোঁচট খেলেও থেমে থাকেনি আসাম সরকার। তারা সেখানকার বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে এখনো অবৈধ বাংলাদেশী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে। এতে করে সাধারণ অসমীয়া এবং হিন্দুদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে বাঙালি মুসলিমদের। এছাড়াও মুসলমানদের মাদরাসাগুলো অনেকটাই বন্ধ করে দিচ্ছে আসাম সরকার।
আর এই নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় গতকাল তারা দ্বারাং জেলায় পরিচালনা করলো নির্মম উচ্ছেদ অভিযান। হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন থাকা সত্বেও উচ্ছেদ অভিযানের এই দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র মগের মুল্লুকেই সম্ভব! আর সেই অভিযানে নিরীহ জনগণের দেহের ওপর সাংবাদিককে লাথি মারা! কোনো সভ্য সমাজে কি সম্ভব?
★ শেষকথা!
আসামের এই পরিস্থিতি যেন অচিরেই শান্ত হয় এই কামনা করি। আরেকটি আরাকান যেন আমাদের দেখতে না হয়। আসামের অস্থিরতা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের সীমান্তের নিরাপত্তা ও বিঘ্নিত হবে। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার অতি দ্রুত এই ব্যাপারগুলেতে কূটনৈতিক দৃষ্টি দিবে। বাংলাদেশী মিডিয়া এবং জনগণেরও উচিত দূরবীণ দিয়ে হাজার মাইল দূরের দেশগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার চেয়েও আসাম নিয়ে ভাবনা রাখাটা অধিকতর জরুরি।