বেকারত্ব, উদ্যোক্তার ফাঁকাবুলি ও শিক্ষাব্যবস্থার গলদ

বেকারত্ব, উদ্যোক্তার ফাঁকাবুলি ও শিক্ষাব্যবস্থার গলদ - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশে বেকারত্ব ভয়াবহ প্রকট রূপ নিয়েছে। এ অবস্থাকে একটি জাতির জাতিগত মূর্খতার প্রতিফলন বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ, যুগ যুগ ধরে যে-জাতি তার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সংকট মোকাবেলাই করতে পারছে না, এ অবস্থাকে সেই জাতির জাতিগত মূর্খতা ছাড়া আর কী বলা যায়? জার্মানিতে বেকারত্বের সমস্যা প্রসঙ্গে ওই দেশের বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, বেকারত্বের সাথে মূর্খতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত (৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮, ডয়চে ভেলে)।
আর ইউএস নিউজের ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বকে অর্থনীতির ‘সিক্রেট ক্যান্সার’ বলা হয়েছে।
যাই হোক, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পেরেছে। তাই বেকারত্বকে কোনোভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল বলা যেতে পারে না। এমনকি চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়াও মূল কারণ নয়। বেকারত্বের কারণ হিসেবে সবসময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়াকে একতরফা দায়ী করা মানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ব্যাপার। অর্থাৎ, মূল কারণ থেকে ফোকাস সরিয়ে দেয়া।
তো এখন প্রশ্ন হলো, এ দেশে বেকারত্বের প্রধান সমস্যাটা কী? আর মূল সমাধানটাই বা কী?
প্রধান সমস্যা হলো, আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের খাতগুলোতে যে বেসিক চাহিদা ও দক্ষতাগুলো বিশেষভাবে প্রয়োজন, সেসবের সাথে সমন্বয় না করেই আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। আর সেটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। চলছে গাড়ি, ঠ্যালাগাড়ি- এই অবস্থা!
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান সিলেবাস সম্পর্কে নিশ্চয়ই সবার কমবেশি জানাশোনা আছে। অনার্স-মাস্টার্স করেও বেসিক দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। অনেক সময় নিয়োগদাতা চাইলেও নিতে পারছে না।
কারণ প্রায়ই দেখা যায়, বেশিরভাগ আবেদনকারীই বেসিক দক্ষতায় কাঁচা থাকে এবং প্রদত্ত কাজের প্র্যাকটিক্যাল ক্ষেত্রগুলোতে অদক্ষ। এখন দেখুন, যেখানে নিয়োগকারীর প্রয়োজন দক্ষ কর্মী, সেখানে তিনি অদক্ষ, আনাড়ি বা আনকোরা কাউকে নিবেন কিভাবে?
তাহলে ক্লাস ওয়ান থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী কি ঘাস খেয়ে পড়াশোনা করেছে? না, তাও নয়। আসল ব্যাপার হলো, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে এবং পাঠপদ্ধতিতে এদেশের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় বেসিক দক্ষতাগুলো অর্জনে কার্যকর কোনো ফোকাস দেয়নি।
এ পর্যায়ে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এদেশে এত লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার থাকতে কিভাবে ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, কোরিয়া থেকে ওই দেশের নাগরিকরা আমাদের দেশে এসে বড় বড় গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানায় চাকরি করছে এবং শত শত কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে তাদের দেশে?
নয়া দিগন্তের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার (মার্কিন) এবং ২০১৭ সালে ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করে। অপরদিকে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে রেমিট্যান্স হিসেবে। এর মধ্যে শুধু ভারতীয়রাই বছরে নিয়ে যায় ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৩৩ হাজার কোটি টাকা (২৫ আগস্ট ২০১৮)।
বিদেশীরা আমাদের দেশে বড় বড় চাকরি করে আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিটেন্সের বড় একটি অংশ তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এরচে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে এ জাতির!
কিন্তু কথা হলো, তারা যে এদেশে মামা-চাচা কিংবা গায়ের জোরে চাকরি পাচ্ছে তা নয় মোটেও। তারা যোগ্যতাবলেই চাকরি পেয়ে থাকে। এ দেশের কর্মসংস্থানের অফিশিয়াল খাতগুলোতে সবচে কাঙ্ক্ষিত সাধারণ যোগ্যতা হলো- ইংরেজিতে সাধারণ বাতচিত তথা অফিসিয়াল করেসপন্ডিং করতে পারা। আর সেইসাথে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান থাকা। এই দুই দিককে ফোকাস করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সময়ের দাবি। কারণ, পড়াশোনা শুধু সার্টিফিকেটের জন্য নয়, চাকরি পেতে এবং করতেও কাজে লাগতে হবে তো, নাকি? অন্তত বেকারত্ব দূর করতে হবে আগে।
শিক্ষাব্যবস্থায় তথাকথিত সৃজনশীল, পিএসসি, জেএসসি– এসব ভুংভাং সংস্কার দেখিয়ে এত দিন শুধু সময়ই নষ্ট করা হয়েছে। এ দেশের কর্মসংস্থানের সেক্টরগুলোর কমন চাহিদা ও প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতার সাথে সমন্বয় করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। যত দিন একটি জাতি তার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পারবে না, তত দিন ওই জাতির জাতিগত মূর্খতা প্রকট হয়ে উঠতে থাকবে। তবে আশার ব্যাপার হলো, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মসংস্থানের উপযোগী কারিগরি শিক্ষামুখী একটি সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন (২ জুন ২০২১, প্রথম আলো)।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়াও বেকারত্ব বৃদ্ধিকে আরো প্রকট করে তুলেছে। এরকম আরো কিছু কারণ আছে। তবে প্রধান সমস্যার সমাধান না করলে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে না।
আরেকটা সমস্যা হলো, বেকারত্ব সমস্যাকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে জিইয়ে রাখার জন্য কথায় কথায় উদ্যোক্তা হওয়ার ফানুস ছড়ানো হয়। অথচ এ দেশের প্রত্যেক বেকারের পক্ষে কি উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব? কিংবা উদ্যোক্তা হতে চাইলেও সেটার জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স ও সুযোগ-সুবিধা কি প্রত্যেক বেকার পাচ্ছে বা পাবে? উত্তর হলো, না।
সুতরাং ভাবতে হবে সমষ্টিকে নিয়ে। ক্ষুদ্রসংখ্যক সফল উদ্যোক্তাদেরকে বেকারত্ব নিরসনের মানদণ্ড ভাবা চরম বোকামি। যা আমাদের দেশে বেকারত্বের প্রধানতম কারণের ওপর থেকে ফোকাস কমিয়ে দেয়। বেকারদের মধ্যে অতি নগণ্য সংখ্যকের পক্ষে উদ্যোক্তা হয়ে সফল হওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ঋণসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, ব্যবহারিক দক্ষতা ও রিসোর্সের অভাবে বেশির ভাগের পক্ষে সফল হওয়া অসম্ভব।
যুগান্তরের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ (২৮ মার্চ ২০১৮)। আর উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্ব ১০.৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (২১ আগস্ট ২০১৯, বা.প্র.)।
এখন প্রশ্ন হলো, এত বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রত্যেকেই যদি উদ্যোক্তা হতে যায়, তাহলে কি এটি সম্ভব? আমি উদ্যোক্তা হওয়াকে অপ্রয়োজনীয় বলছি না। অবজ্ঞাও করছি না। বরং বলতে চাচ্ছি, সমস্যার মূল গোড়ায় ফোকাস দিন। সমাধানের মূল জায়গায় হাত দিন। এর বাইরে তথাকথিত মোটিভেশন-ব্যবসার জোয়ারে মূল জায়গার ফোকাসটা যেন হারিয়ে না যায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়