আফগান যুদ্ধে স্বপ্নের কমিউনিস্ট স্বর্গ ভেঙে ছত্রখান

আবু রূশদ | Sep 22, 2021 05:53 pm
আফগান যুদ্ধে তাদের স্বপ্নের কমিউনিস্ট স্বর্গ ভেঙে ছত্রখান

আফগান যুদ্ধে তাদের স্বপ্নের কমিউনিস্ট স্বর্গ ভেঙে ছত্রখান - ছবি সংগৃহীত

 

নির্মমতা, ছলনা, সামরিক শক্তি, ভণ্ডামির মাধ্যমে শুরু হয় দশ বছর মেয়াদি ইতিহাসের ভয়াবহতম ক্রুর এক সামরিক দখলদারিত্বের। অঘটনের সেই শুরু। লাখ লাখ স্বাধীনচেতা আফগানকে হত্যা করে দখলদার সোভিয়েত বাহিনী ও তাদের আফগান দোসর কমিউনিস্ট পেটোয়া বাহিনী। প্রায় পঞ্চাশ লাখ আফগান সোভিয়েত আগ্রাসনের হাত থেকে জীবন, মান-সম্ভ্রম বাঁচাতে আশ্রয় নেয় পাকিস্তান ও ইরানে। অনেকে চলে যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। ওই দশটি বছর মুজাহিদিন ও কথিত প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দমনের নামে প্রায় বিশ লাখ আফগানকে হত্যা করা হয়। লাখ লাখ পঙ্গু হয়ে যায়। গ্রামের পর গ্রাম আকাশপথে হামলা হেলিকপ্টার দিয়ে এবং স্থলপথে ট্যাংক-সাঁজোয়া যান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেয়া আফগানদের ত্রাণ শিবিরগুলোতে হামলা চালানো হয় জঙ্গিবিমান দিয়ে। নাপাম বোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় শরণার্থীদের। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট রাতে এমনি এক মিশনে এসইউ-২৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মারানশাহ শরণার্থী শিবিরে নাপাম বোমা বর্ষণ করতে আসেন সোভিয়েত কর্নেল রুতস্কয়। কিন্তু পাক বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমান তার বিমানটি ধ্বংস করলে রুতস্কয় প্যারাসুটের মাধ্যমে পাকিস্তানের মাটিতে অবতরণ করতে বাধ্য হন। তাকে গ্রেফতার করে পাক সরকার। বহু দেনদরবারের পর রুতস্কয়কে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে সোভিয়েতের পতন হলে কর্নেল রুতস্কয় রাশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ওই সময় একটি চরম মানবতাবিরোধী বিষয় পৃথিবীর দৃষ্টি কেড়েছিল। সোভিয়েত বাহিনী ছোট বাচ্চাদের হত্যা বা মারাত্মকভাবে জখম করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলনা সামগ্রী রাতের বেলা আকাশ থেকে আফগানিস্তানের গ্রাম এলাকায় নিক্ষেপ করত। বাচ্চারা ওইসব দেখে খেলতে গিয়ে মারা পড়ত। এ জাতীয় মানবতাবিরোধী নির্যাতনের বেশির ভাগই আবার কঠোর প্রেস সেন্সরশিপের কারণে বাইরে প্রকাশিত হতো না। আজ এত বছর পর বিশ্ব সেসব ভুলতে বসেছে। ভুলে গেছে অপরাধের সূত্রপাত সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরু করেছিল। ওই আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়াতেই জন্ম নিয়েছিল মুজাহিদিন যা পরে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংগঠনে রূপ নেয়।

সোভিয়েত আগ্রাসন মোকাবেলায় মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয় আমেরিকাসহ সব পশ্চিমা শক্তি, মুসলিম দেশ ও চীন। পাকিস্তানে গড়ে ওঠে প্রশিক্ষণ শিবির। আমেরিকা সোভিয়েত বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমানের অব্যাহত হামলা ঠেকাতে পাকিস্তানকে সরবরাহ করে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। মুজাহিদিনদের দেয় কাঁধে বহনযোগ্য বিমানবিধ্বংসী স্টিঙ্গার মিসাইল। কথিত আছে যে, মার্কিন অনুরোধে সেসময় সৌদি বাদশাহ পুরো মুসলিম বিশ্বে জিহাদের ডাক দেন স্রষ্টায় অবিশ্বাসী সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে। মূলত সেই আহ্বানের কারণেই প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকে হাজারে হাজারে গেরিলা যোগ দেয় সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে। সে সময় সেখানে এসে হাজির হন ‘ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী’ ওসামা বিন লাদেন ও আয়মান আল জাওয়াহিরি। তারা তখন সবাই ছিলেন পশ্চিমাদের ‘সুইটহাটর্’। খ্রিষ্টান জগৎ, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল- সবাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য এক হয়ে মুসলমানদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারত পক্ষ নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।

এদিকে আফগান ঝড়ের প্রায় পুরোটাই সামলাতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। লাখ লাখ আফগান শরণার্থী, মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ, সহায়তা প্রদান, লজিস্টিকস নিশ্চিত করাসহ সব ভার বহন করেছে পাকিস্তান। এতে পাকিস্তানের পুরো সমাজে বিষবৃক্ষের রোপণ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়। শরণার্থীদের সঙ্গে লুকিয়ে প্রবেশ করে আফগান গুপ্তচর সংস্থার অপারেটিভরা। তারা পাকিস্তানে সন্ত্রাসী তৎপরতার তাণ্ডব শুরু করে। সেই থেকে পাকিস্তানে জেঁকে বসে উগ্রবাদ, সংস্কৃতিতে আসে পরিবর্তন। অনিবন্ধিত মাদরাসার সংখ্যা আনাচে কানাচে বৃদ্ধি পায় যেগুলোতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এখনো নেই। এগুলো থেকেই বের হতে থাকে বিশ্ব সম্পর্কে খুবই কম জানা, ‘মাথা গরম’ উগ্রবাদী গোষ্ঠী যারা নিজ দেশের সামরিক বাহিনীকেও ‘অমুসলিম’ বলে মনে করে থাকে, আত্মঘাতী বোমা হামলাকে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েমের পথ’ বলে বিশ্বাস করে। এর রেশ চলছে চার দিকে। এর মূল দায় অবশ্যই সোভিয়েতদের, কমিউনিজম কায়েমের সেই খায়েশের। বলা যায়, কমিউনিজমের ধর্মবিরোধী জঙ্গিবাদই ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদকে ডেকে এনেছে, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের স্বাভাবিক নিয়মে।

সমাজতন্ত্রের নামে যে ভয়াবহ অত্যাচার, নিপীড়ন চালানো হয় আফগানিস্তানে, তা আজ অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। এখনকার প্রজন্ম তো বলতে গেলে এ নিয়ে কিছুই জানে না। অন্যরাও বিষয়টি প্রায় ভুলতে বসেছে। কারণ, ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত বাহিনী পরাজয়ের কালিমা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাজত্বের পতন হয় ও দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশেও কমিউনিজম জাদুঘরে স্থান পায়। তখন সাবেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা খোলস বদলিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সমাজের সব ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে। পশ্চিমাদের তারা এমন একটি ধারণা দেয় যে, মুসলমানরা হলো পরবর্তী সমস্যা ও তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এক্স কমিউনিস্টরাই সেরা হাতিয়ার! দেখা যায় সব দেশে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে মিডিয়া, এনজিও দখল করে বসেছে সাবেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা। এরা মিষ্টি মিষ্টি কথায় কতগুলো শব্দ ছুড়ে দেয় সমাজে। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন এদের খুব পছন্দের শব্দ। বাস্তবে এসবে তারা কতটুকু বিশ্বাস করে তা গবেষণার বিষয়। তবে এরা সাফল্যের সাথে সব জায়গায় রিপারকেশন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এরাই প্রচারমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের ইতিহাসটা আড়াল করেছে। এদের কাজের মধ্য দিয়েই প্রতিটি মুসলিম দেশে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিবাদের। খেসারত দিচ্ছে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও মুসলমানরা। এক দিকে লুকানো সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অতি ধর্মনিরপেক্ষ জঙ্গিবাদ, অপর দিকে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। এটাই ওদের প্রতিশোধ আফগান যুদ্ধে তাদের স্বপ্নের কমিউনিস্ট স্বর্গ ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাওয়ার।

শক্তিমান বিধাতা লিওনিদ ব্রেজনেভ অ্যান্ড গংকে ক্ষমা করেননি। হয়তো অন্যদেরও ক্ষমা করবেন না। কারণ সবাই কেবল কৌশলগত কারণে, মানবিকতার জন্য নয়, আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং এখনো জ্বলছে পৃথিবীর অগণিত দেশ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us