কমিউনিস্টবিরোধী সাংবাদিককে হত্যা এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন
আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন - ছবি সংগৃহীত
‘যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না’ বলেছেন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালানোর প্রাক্কালে সৃষ্টিকর্তায় ও ধর্মে অবিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ।
১৯৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ছয়জন আগন্তুক হাজির হলো মোনাহাজউদ্দিন গাহিজের কাবুলের বাড়িতে। গাহিজ ছিলেন মুসলিম বিশ্বের সে সময়কার উল্লেখযোগ্য কমিউনিস্টবিরোধী বুদ্ধিজীবী ও একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক। তিনি অব্যাহতভাবে আরব ও মুসলিম বিশ্বে সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থার নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও মগজ ধোলাইয়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছিলেন। তার পত্রিকায় আফগানিস্তানের রাজনীতি, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনীতে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ ও প্রভাব নিয়ে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এজন্য অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বহুবার তাকে ফোন করে হুমকি ও হত্যার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ওই দিন ঠিকই গুপ্তঘাতকের দল তার বাড়িতে হাজির হয়। ছয়জনের মধ্যে দু’জন ঘরে ঢোকে এবং শেষবারের মতো গাহিজকে সোভিয়েতবিরোধী লেখালেখি থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ দেয়। তিনি স্বভাবসুলভভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ঘাতকরা অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়ে। এতে তিনি, তার ভাতিজা নিহত হন আর উপস্থিত একজন মেহমান আহত হন।
‘কেজিবি : দি সিক্রেট ওয়ার্ক অব সোভিয়েত সিক্রেট এজেন্টস’ শিরোনামে জন ব্যারন লিখিত বইয়ে গাহিজের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করা হয় সবিস্তারে। পৃথিবীখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ব্যানটাম বুকস থেকে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় এই বইটি কেজিবির ওপর লেখা অন্যতম রেফারেন্স হিসাবে স্বীকৃত। আরো জানা যায়, সোভিয়েত ঘাতকরা ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যাকাণ্ডটিকে নৃশংস রূপ দেয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি করা গুলির খোসাসহ অন্যান্য আলামত রেখে যায় যাতে যে কেউ বুঝতে পারে, ওই হত্যাকাণ্ড ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লেখার খেসারত।
গাহিজ হত্যাকাণ্ডের পর কাবুলে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত সের্গেই পেত্রোভিচ কিকটেভ হুট করে এবং ক‚টনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে আফগানিস্তান ত্যাগ করেন। এ ঘটনা নিয়ে সে সময় ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, কিকটেভ ছিলেন কেজিবির একজন দক্ষ ও ক্রর কর্মকর্তা। গাহিজ হত্যার পর মুসলিম দেশগুলো একত্রে ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানালে ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সতর্ক করে দিলে সাময়িকভাবে তাদের তৎপরতা কিছুটা হ্রাস পায়।
কেজিবি শুধু একজন সাংবাদিক গাহিজকেই হত্যা করেনি। তাদের মাত্রাতিরিক্ত অপতৎপরতার জন্য অনেক দেশকেই বছরের পর বছর মারাত্মক খেসারত দিতে হয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের রেশ ধরে আজ পুরো পৃথিবীতেই ধর্মীয় উগ্রতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতে, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেই সূত্র অনুযায়ী, আফগানিস্তানে জোর করে সংস্কৃতি, সমাজ পরিবর্তন করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে দানবীয় নাস্তিক্যবাদী, কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী জঙ্গিবাদের সূচনা করে তার বিপরীতেই জন্ম নেয় ধর্মকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদ।
সাংবাদিক গাহিজ হত্যার মতোই এক ভয়াবহ, ক্রুর কিন্তু প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তাদের আগ্রাসনের সূচনা করে।