তালেবানের প্রত্যাবর্তন : চীনের নতুন হিসাব-নিকেশ
তালেবানের প্রত্যাবর্তন : চীনের নতুন হিসাব-নিকেশ - ছবি সংগৃহীত
সম্প্রতি একটি ইতালীয় সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, ২০ বছর দখলদারিত্বের পর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার সাথে সাথেই দ্রুত আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করা শেষে দেশটি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিকভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল প্রস্তুত সংগঠনটি। ইতালীয় পত্রিকা লা রিপাবলিকাকে জাবিউল্লাহ বলেন, 'আমাদের জন্য চীন প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগী। আমরা একটি মৌলিক এবং ব্যতিক্রমী সুযোগ লাভ করেছি, কারণ চীন আমাদের দেশে বিনিয়োগ ওঅবকাঠামোগত পুনর্নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।'
এই প্রেক্ষাপটে তালেবান মুখপাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। প্রথম বিষয়টি হলো, সংগঠনটি ’সিল্ক রোড’ প্রকল্পের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বেইজিংয়ের কাছে অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচিত। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, আফগানিস্তানে বিশাল তামার মজুদ রয়েছে। চীনের সহায়তায় তামা খনিগুলো পুনরুজ্জীবিত করা এবং এমনকি খনিগুলোর আধুনিকায়ন করা সম্ভব হবে। তৃতীয় দিক হিসেবে জবিউল্লাহ বলেন, বৈশ্বিক বাজারের প্রবেশের জন্য আফগানিস্তানের জন্য চীন নতুন পথ হয়ে উঠতে পারে।
চীন সম্বন্ধে তালেবানের এই ধরনের বক্তব্য এই প্রথম নয় এবং তারা যে এই ধরনের বক্তব্য এই শেষ বারের মতো দিচ্ছে না, তাও স্পষ্ট। কেবল ভৌগোলিক নিকটবর্তিতা এবং প্রত্যক্ষ সম্পর্কের জন্য নয়, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির শক্তিমত্তা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার ভূমিকা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণেও সংগঠনটি চীনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। তালেবানও ভালোভাবে জানে, মার্কিন দখলদারিত্ব প্রতিরোধ করা এবং আফগানিস্তানকে শাসন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আর সে জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্য, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জন এবং নিজ দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার বিষয়টি বিবেচেনা করা তাদের জন্য অতীব প্রয়োজন।
নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে চীন ওয়াশিংটনের সেনা প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম পরাজয় বলে মনে করে। তাদের মতে এই পরাজয় আমেরিকার ভাবমূর্তি, খ্যাতি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করেছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আগে চীন আফগানদের মধ্যকার সংলাপ অভ্যন্তরীণ সমর্থন করে। তবুও একই সময়ে দেশটি কার্যত এমন ইঙ্গিত দিয়েছে যে সময় এলে তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে তারা রাজি। কিছু চীনা সংবাদপত্র স্পষ্টভাবে বলেছে, তালেবানের সাথে বৈরী সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে বেইজিংয়ের কোনো আগ্রহ নেই; কিন্তু একই সাথে সন্ত্রাসবাদ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করার জন্য তালেবানের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়। সম্ভবত জুলাই মাসের শেষের দিকে জ্যেষ্ঠ তালেবান প্রতিনিধি দলের সাথে মোল্লা বারাদারের চীন সফর এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাদের বৈঠক আফগানিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে সংগঠনটির প্রতি চীনের নীরব স্বীকৃতির দিকে ইঙ্গিত করে এবং আফগানিস্তান নিয়ে চীনের প্রাথমিক নীতির প্রতিফলন ঘটায়। ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় বিজয়ী চীন। আফগানিস্তান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করলে চীন অবশ্যই উপকৃত হবে, কারণ আফগানিস্তানে অর্থ ঢালা শুরু হবে এবং দেশটিতে বিনিয়োগ ও পুনর্গঠনের অনুমতি পাবে। এই ধরনের পরিস্থিতি বিশেষত পাকিস্তানের সাথে কাজ করে এর জন্য দারুণ সুযোগ তৈরি করতে পারে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করবে এবং নতুন পারস্পরিক ক্ষেত্রে স্বার্থ তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনের জন্য বিড়ম্বনাকর বিষয় হলো, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার চীনের জন্য যতখানি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, তেমনি কিছু সমস্যাও উপস্থাপন করেছে। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে তালেবানকে যুক্তিবাদী, মুক্তমনা ও মধ্যপন্থী একটি দল হিসেবে উপস্থাপন করে তাদের সাথে কাজ করার ধারণাকে গ্রহণযোগ্য করা সহজ কাজ নয়। এই অসুবিধার কারণ হলো ঐতিহ্যগতভাবে চীন সরকার ইসলাম এবং স্থানীয় ইসলামী আন্দোলনকে জন্য নেতিবাচক ছবি তৈরি করে আসছে। বেশ কিছু দিন ধরে চীন তালেবানকে পূর্ব তুর্কিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে আসছে। চীনের বেশ কয়েকটি সরকারী প্রতিবেদন তালেবানের বিরুদ্ধে ওই ইসলামী আন্দোলনকে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দানের অভিযোগ এনেছে। এই কারণে বর্তমানে তালেবানকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোতে উপস্থাপন করার চীনের সরকার যে প্রচেষ্টা করছে তাতে দেশটির নিজস্ব জনগণ বিভ্রান্ত।
সর্বোপরি নিজের রোড অ্যান্ড বেল্ট প্রকল্পের আফগান অংশ নির্মাণকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে আগামী দিনগুলোতে আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করার উচ্চাভিলাষ থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে চীনকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। দেশটি আফগানিস্তানের ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ সঞ্চয় আহরণেও বিনিয়োগ করতে চায়, যার আনুমানিক মূল্য দুই থেকে তিন লাখ কোটি ডলার।
নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা, পূর্ব তুর্কিস্তানের সাথে তালেবানের বিদ্যমান কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিন্নকরণ এবং এ বিষয়ে চীনা নীতির সমালোচনা করা থেকে তালেবানকে বিরতকরণ। মনে হয় তালেবান এই বিষয়টি বেশ আগেই বুঝতে পেরেছে। যে কারণে স্পষ্টতই দলটি উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনের অবস্থান বা তার নীতি সম্পর্কে কখনো কোনো মন্তব্য করে থেকে বিরত রয়েছে।
আঞ্চলিক পর্যায়ে আফগানিস্তান পরিচালনায় তালেবান ব্যর্থ হলে অথবা পুনরায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হলে বা আফগানিস্তান নতুন করে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলে কিংবা প্রতিনিধিত্বকারী যুদ্ধের আখড়ায় পরিণত হলে এই বার তা বেইজিংয়ের ওপর বিশাল আর্থিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ হলো এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র আর আফগানিস্তানে উপস্থিত নেই। চীন তখন একটি অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে লাভবান হওয়ার সব হিসেব বাষ্পীভূত হয়ে যাবে এবং সম্পূর্ণ পরিস্থিতি চীনের জন্য সম্ভবত এক ভয়বহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ভবিষ্যতে আফগানিস্তান পরিস্থিতির অবনতি হলে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা না করে চীন যদি তালেবানের সাথে স্বতন্ত্রভাবে বোঝাপড়া করতে চায়। তবে যত যাই হোক, যদি ভবিষ্যতে তালেবানের কোনো সম্ভাব্য বিরোধী পক্ষের সাথে কাজ করতে চেষ্টা করলে, তাহলে চীন নিজেই নিজের স্বার্থকেই বিপদে ফেলবে। কারণ তাতে করে তালেবানকে সম্ভাব্য বন্ধুর পরিবর্তে কার্যত শত্রুতে পরিণত করতে পারে। অতএব আগামী দিনগুলোতে আফগানিস্তানে চীনের সব হিসাব-নিকেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
বিদেশী পত্রিকা থেকে