ঝাঁকড়া চুল, লম্বা রানআপ এবং একটি ইয়র্কার
লাসিথ মালিঙ্গা - ছবি সংগৃহীত
গত দুই দশকে যারা ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন, তারা তো বটে, অন্তত বাসার ছাদে খেলনা ব্যাট আর বল হাতে নেয়া ছোট্ট শিশুটাও জানে ওই নামটি। নামটির পুরোটা জুড়েই আছে সুন্দর আর শ্রেষ্ঠত্বের গল্প। ওই গল্পমাখা ২২ গজ আর মানুষটার বিচ্ছেদে কার না মন কাঁদে! ওই ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে লর্ডসে বসে কোনো এক ইয়র্কার দেখা দর্শক- সবার মন আকাশ যে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে তা বলতে হয় নাকি।
এই তো সে দিনের কথা, ২০০৪ সালের ১ জুলাই ডারবিনে পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ। অভিষেক ম্যাচেই ৬ উইকেট নিয়ে যতটা না নজর কেড়েছে, তার চেয়েও বেশি আলোকিত ছিল ক্যারিয়ারের প্রথম দুটি উইকেটই দুর্দান্তভাবে তুলে নেয়ার ঘটনা। ডারবিন টেস্টে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৫৭ রান নিয়ে ব্যাট করা ড্যারেন লেহমানকে এলবিডব্লিউ'র ফাঁদে ফেলে সাজঘরে ফেরান ওই তরুণ ফাস্ট বোলার। দ্বিতীয় উইকেট তুলে নিতে এবার জীবন্ত কিংবদন্তী এ্যাডাম গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে আউট করেন তিনি। এই তিনিই ব্যতিক্রমী বোলিং এ্যাকশনের মালিঙ্গা।
৩৩৯ ম্যাচের বর্ণিল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে লাসিথ মালিঙ্গার অর্জনের খাতা সাফল্যে ভরপুর। দীর্ঘ দুই দশকের মতো ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানো এই পেসার টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৩০টি। যেখানে তার উইকেট সংখ্যা ১০১টি। ইনিংসে সর্বোচ্চ ৫০ রানে ৫ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি এক ম্যাচের সেরা বোলিং ফিগার ২১০ রান খরচায় ৯ উইকেট। যেনতেনভাবে কাটানো টেস্ট ক্যারিয়ারে ফাইফারও মাত্র তিনটি।
তবে কেমন ছিলেন ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির মালিঙ্গা? তা তো সবচেয়ে ভালো জানার কথা মালিঙ্গার বিপরীতে ব্যাট ধরা ক্রিকেটারই। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৩৩৮ উইকেটের মালিক লিজেন্ডারি এই ফাস্ট বোলার। ম্যাচের হিসাবে খেলেছেন ২২৬টি। সেরা বোলিং ৩৮ রানে ৬ উইকেট শিকার। ৬ (৫.৩৫)-এর নিচে ইকোনমি রেটে বোলিং করা মালিঙ্গা ম্যাচে ৫ উইকেট শিকার করেছেন মোট ৮ বার।
ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণেও বরাবরি দুর্দান্ত লঙ্কান তারকা। ৮৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে যে কয়টা উইকেট ঝুলিতে পুরেছেন, তা দিয়েই ইতিহাসের পাতায় অনন্য হয়ে গেছেন তিনি। প্রথম বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তো বটে, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায়ও প্রথম নামটি লাসিথ মালিঙ্গা। তার নেয়া ১০৭ উইকেটের ধারে কাছে আছেন কেবল সাকিব আল হাসান (১০৬* উইকেট)। সেরা বোলিং ৬ রানে ৫ উইকেট।
এ তো শুধু পরিসংখ্যানের সংজ্ঞায় মালিঙ্গা।
তবে ২২ গজে তুরুপের তাস হয়ে আসা মালিঙ্গাকে জানতে হলে, চোখ দিতে হবে ওই ঝাঁকড়া চুলে দৌড়ে আসা বোলারের দিকে, একটা চুমু তো খাবেনই। বলের গায়ে যে চুমু এঁকে দিয়েই হয়তো বশ করেন উইকেট উপড়ে ফেলার জন্য। ওভারে ছয়টি বল ইয়র্কার হতে পারে! বেশ অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে না? এমন অবিশ্বাস্য সব চিন্তার বাস্তব রূপ দেয়া বোলার মাসিথ মালিঙ্গা। একের পর এক ইয়র্কার ঝড়ে প্রতিপক্ষকে ধুমড়মুচড়ে দিয়েছেন ক্যারিয়ারজুড়েই।
তাই তো ক্রিকেট আঙিনায় একটি কথা প্রচলিত হয়েই গেছে, 'মালিঙ্গা মানেই ইয়র্কার'। আদতে তো এমনই হয়, ইয়র্কারের সমার্থক শব্দটাই মালিঙ্গা। তবে এত শত অর্জন ছাপিয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে একজন 'মালিঙ্গা' হয়েই ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় থাকাটাই হয়তো দিনশেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। বিদায় বলেছেন সব ধরণের ক্রিকেটকে। মালিঙ্গাদের কি আসলেই বিদায় হয়? না, মোটেই না। হয় তো কেবল কাজের অব্যাহতি।