যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার প্রস্তুতি চীনের!
চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা - ছবি সংগৃহীত
পালাবদলের হাওয়া ও পাল্টা প্রস্তুতি চীন বলয়ের
বিগত দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ডকট্রিন পাল্টানোর ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। এটি পরিণতি লাভ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। ইরাক এবং সবশেষে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের সাথে এই ডকট্রিনের সম্পর্ক রয়েছে, যার কারণে অনেকখানি অগোছালোভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারে দেশে বিদেশে সমালোচনার পরও প্রেসিডেন্ট বাইডেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে দৃঢতা দেখাচ্ছেন। তিনি আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, সিরিয়াসহ অন্য সব স্থান থেকেও আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার করা হবে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশের গৃহযুদ্ধে আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না বলেও তিনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে উল্লেখ করেছেন।
পশ্চিমা অনেক প্রভাবশালী গণমাধ্যমে এই প্রত্যাহারের সমালোচনা করা হচ্ছে এবং মন্তব্য করা হচ্ছে আমেরিকান সুরক্ষার ব্যাপারে আর কোনো দেশ ওয়াশিংটনের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না। কিন্তু আমেরিকান গভীর ক্ষমতা বলয়ের সূত্রগুলো বলছেন, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আমেরিকা বড় কিছু করার জন্য আফগানিস্তান থেকে নিজেকে পরিকল্পিতভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটি কয়েক মাস সময়ের মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করবে।
আমেরিকার ডকট্রিন পরিবর্তনের বিষয়টি চীন-রাশিয়া বলয়ের অজানা নয়। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান প্রত্যাহারের জন্য প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে চীন-রাশিয়া নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারের আয়োজন সম্পন্ন করে আনলে আসে ভিন্ন বক্তব্য। বেইজিং ও মস্কো দুই দেশই অরক্ষিত রেখে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা শুরু করে। কারণ তারা জানে আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়া মানে, লড়াইয়ের গতি চীনমুখী হওয়া।
আমেরিকার নতুন কৌশলগত যুদ্ধের বিষয়ে চীন একাধিক ফ্রন্টে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তাইওয়ান ইস্যুতে বেইজিং ঠিক কি চায় তা স্পষ্ট নয়। মাঝে মধ্যে সামরিকভাবে তাইওয়ানকে একীভ‚ত করার হুমকি দেয়। আবার দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের একাধিক নৌবহর পাঠানোসহ পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার পর চুপ হয়ে যায়। চীন সম্ভবত এভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক চাপের মুখে তাইওয়ানকে চীনা কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য করতে চায়।
দক্ষিণ চীন সাগরের প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি চীনের বার্তা হলো, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আপস-মীমাংসায় আসা। তাদেরকে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যাপারে বেইজিং অফার করছে। তবে দক্ষিণ চীন সাগরে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত কোন পদক্ষেপ বেইজিং গ্রহণ করলে তা তৃতীয় মহাযুদ্ধ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে হয়।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধের মোকাবেলায় চীন রাশিয়া ও অন্য মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা তৈরি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল মাধ্যম চালুর মতো কিছু পদক্ষেপ এগিয়ে নিচ্ছে চীন। বিশ্বব্যাংক গ্রæপের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংককে আরো শক্তিশালী ও সক্রিয় করতে চাইছে বেইজিং। এ ব্যাপারে রাশিয়াসহ অনেক দেশের সহায়তা পাচ্ছে চীন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের বাইরে, মালয়েশিয়া ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি কাউন্টার করার জন্য আকর্ষণীয় কিছু অফার তৈরি করতে চাইছে বেইজিং। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ ও পাল্টা সরকার গঠনের বিপরীতে চীন বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে যোগসূত্র তৈরি করছে, অন্য দিকে সামরিকভাবে রাশিয়ার সাথে সমন্বয় রেখে মিয়ানমারকে শক্তিমান করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
চীন রোহিঙ্গাদের বিপরীতে, জান্তা সরকারের সাথে আরাকান আর্মির সমঝোতা করিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিয়েছে।
চীনা পররাষ্ট্র কৌশলে সর্বাত্মকবাদী, শক্তিমান ও বৈধতার সঙ্কটে থাকা সরকারগুলো অগ্রাধিকার লাভ করে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মতো ইস্যু নিয়ে বেইজিং মাথা ঘামায় না বলে এই ধরনের সরকারগুলোও চীনা মৈত্রীতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। চীনের সাথে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহায়তা চুক্তিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে অর্থকড়ির প্রয়োজন হয় তা সহজে সরানো যায়। এতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প দুর্বল হয়ে গেল কি না তা নিয়ে বেইজিং ভাবে না।
বেইজিংয়ের কৌশলবিদরা মনে করেন, নতুন পরিস্থিতিতে চীনা জনগণকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার নিজস্ব বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করতে হবে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাক্সক্ষা এবং ‘হাইপার অ্যাক্টিভিটি’ এর কারণে ওয়াশিংটনের নতুন পদক্ষেপের জন্য চীনকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
ঝাঁকুনি এশিয়ায়, মধ্যপ্রাচ্যেও পরিবর্তনের সঙ্কেত
সব কিছু মিলিয়ে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে আমেরিকা ও মিত্রদের সাথে চীন-রাশিয়া বলয়ের যে লড়াইয়ের আলামত স্পষ্ট হচ্ছে তাতে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনিতে পড়তে পারে এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া। পরাশক্তিগুলোর নতুন যুদ্ধ খেলায় অনেক দেশে শাসন পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটতে পারে। এই লড়াই শেষ পর্যন্ত কী অবয়ব নেয় তা দেখতে খুব বেশি সময় সম্ভবত অপেক্ষা করতে হবে না। তবে একটি বিষয় অনুমান করা যায় যে, নতুন বৈশ্বিক লড়াইয়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে ইসলামী দেশগুলোকে অস্থির ও ধ্বংস করার প্রকল্প সম্ভবত থাকছে না। বরং ভারসাম্য স্থাপনকারী শক্তি হিসেবে দু’পক্ষের কাছে এসব দেশের কদর বাড়বে।
এ কারণে ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন প্যারেজ কয়েকদিন আগে এক টুইটার বার্তায়, তার দেশকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক ইসলাম ও ইরানের মতো যেসব দেশ ও শক্তি ইসরাইলের শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল তারা আমেরিকার সামনে আগামী দিনে শত্রু হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে তার নতুন কৌশল প্রণয়নে এগিয়ে যেতে হবে। জেরুসালেমে ফিলিস্তিনবিষয়ক আমেরিকান মিশন খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত এর একটি সঙ্কেত হতে পারে। বিপরীতে ইসরাইলের কৌশল কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসন্ন বলে মনে হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com