যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ডকট্রিন : মুসলিমরা আর টার্গেট নয়?
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিহত ইরানি জেনারেল সোলায়মানি - ছবি সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলগত ডকট্রিনে পরিবর্তনের একটি অংশ হিসেবেই কি আমেরিকা নিজেকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়েছে? নতুন ডকট্রিনে আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলাম নয় বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যে ধারা চলতি শতকের গোড়া থেকে আমেরিকা শুরু করেছিল সেখান থেকে সরে এসে বৈশ্বিক নীতিতে দেশটি নতুন বিন্যাস আনবে বলে মনে হয়।
আমেরিকান নীতি বিশ্লেষক ও উপদেষ্টাদের বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে। আমেরিকান বিশ্লেষক রবিন রাইট লিখেছেন, ‘আমেরিকার [আফগানিস্তান থেকে] মহাপশ্চাৎপসরণ কম করে হলেও ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যাহারের মতোই অপমানজনক, যা সোভিয়েত সাম্রাজ্য এবং কমিউনিস্ট শাসনের অবসানে অবদান রেখেছিল। বড় দুই শক্তিই পরাজিত হয়ে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’ একটু ভিন্ন মাত্রার হলেও একই কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ক্ল্যাড। তবে তিনি আমেরিকার ভিন্ন এক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। জন লি এন্ডারসনকে পাঠানো এক ই-মেইলে জেমস ক্ল্যাড আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের উল্লেখ করে বলেছেন, “এটি একটি ক্ষতিকর আঘাত, কিন্তু সাম্রাজ্যের ‘শেষ’ এখনো হয়নি, সম্ভবত দীর্ঘ মেয়াদেও নয়। মারাত্মক পরাজয় আমেরিকার প্রতিপত্তি ক্ষুণœ করেছে; তবে, আমাদের মুখে ভ‚-রাজনৈতিক ডিমের সমতুল্য সরবরাহ করছে।... বিস্তৃত বিশ্বে, আমেরিকা এখনো তার অফশোর পাওয়ার-ব্যালেন্সিং ফাংশন ধরে রেখেছে। আর কিছু উত্তপ্ত সাংবাদিকতা সত্তে¡ও, কোনো অপরিবর্তনীয় সুবিধা আমাদের প্রাথমিক ভ‚-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চীনকে দেয়া হয়নি।”
নতুন ডকট্রিনে মার্কিন প্রতিপক্ষ কে?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমেরিকান কৌশলগত বিন্যাসে চীন এবং রাশিয়াই হচ্ছে প্রধান প্রতিপক্ষ; যদিও প্রতিপক্ষ হিসেবে সক্ষমতা বিচারে রাশিয়ার বৈশ্বিক নেতৃত্বে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ্য যতটা, তার চেয়ে চীনের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ ক্ষমতা অনেক বেশি। আফগানিস্তানে দীর্ঘ সময় কাজ করা সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী, ইয়েলের জ্যাকসন ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো ররি স্টুয়ার্ট বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রাধিকার এখন আর আফগানিস্তানের মতো জায়গায় নয়, বরং চীনের সম্প্রসারণের মোকাবেলায় নিবেদিত।’
চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র যে, তাদের প্রতিপক্ষ করতে যাচ্ছে সেটি জানে। গত সপ্তাহে সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ ভ‚-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে প্রস্তুত; কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ওয়াশিংটনের বেশির ভাগ পদক্ষেপই হয় বস্তু ছাড়া নিছক ধোঁকাবাজি। যুক্তরাষ্ট্র যা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তা হলো চীনের ধারাবাহিক বিকাশের ক্ষমতা। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে শক্তির সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে এবং এমনকি তা অতিক্রম করবে। সে সাথে চীনের সামরিক শক্তি অন্যের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। চীনের এই গতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যকে ভেঙে ফেলার প্রবণতা তৈরি করেছে। ওয়াশিংটন স্বপ্ন দেখছে- চীন তার উন্নয়ন গতি হারাবে, আর তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের উন্নয়ন গতিশীলতা অর্জন করবে।’
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, “আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের অর্থ এই নয় যে আমেরিকা আধুনিক বিশ্বে তার ধ্বংসাত্মক শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকছে। এর পরিবর্তে এটি হবে একটি টার্নিং পয়েন্ট, যা দেখায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘মন্দ কাজ’ করার পরবর্তী লক্ষ্য খুঁজে পাবে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করার জন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়বদ্ধ করা হয়নি। যুদ্ধকে দীর্ঘ দিন ধরে একটি ভুল হিসেবে দেখা হয়েছে; কিন্তু সব সময়ই এটিকে অভিনব শব্দবাজি করে বৈধতার মোড়ক দেয়া হয়েছে।... যুক্তরাষ্ট্রে সুদিনের সময়, জর্জ ডবিøউ বুশ প্রশাসনের বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘গণতান্ত্রিক মডেল’ স্থাপনের একটি অহংকারী পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু পরিকল্পনাটি ইরাক থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিছু মার্কিন অভিজাত এখন চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা সম্পদ ব্যবহার করতে চাইছেন। তারা চীনা জাতির নবজীবনের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে এবং চীনের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের জন্য আরো উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে আসতে চান।”
নতুন পরিস্থিতিতে চীনা আধিপত্য খর্ব করতে চারটি ক্ষেত্রে আমেরিকা তার মিত্রদেরকে নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- দক্ষিণ চীন সাগরসহ চীনের চারপাশে একটি বৈরী শক্তির বলয় তৈরি করা। এর অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান উপক‚লে আমেরিকান নৌ শক্তিকে ব্যাপকভাবে জোরদার করা।
এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকবে দক্ষিণ চীন সাগরের একক মালিকানা চীনের দাবি করার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ চীন সাগর সংযুক্ত দেশগুলোকে কোয়াডের বলয়ে নিয়ে আসা অথবা ভিন্ন কোনো জোট তৈরি করা; এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর ইন্দোনেশিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক বাড়ানো; জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে আরো বেশি সক্রিয় করে তোলা; কোয়াডের অংশীদারদের মধ্যে ভারতকে চীনের ব্যাপারে অধিকতর সক্রিয় করে তোলা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে না পারলেও অন্তত একটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ অবস্থানে নিয়ে আসা।
আমেরিকার চীনবিরোধী লড়াইয়ের দ্বিতীয় ক্ষেত্র হতে পারে বেইজিংয়ের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যক্ষেত্রগুলোকে বাধাগ্রস্ত করা। এ ক্ষেত্রে আমেরিকান ও তার মিত্রদের যেসব বিনিয়োগ করপোরেশন রয়েছে, তাদের স্থাপনা পর্যায়ক্রমে চীন থেকে সরিয়ে এনে এশিয়ায় অন্য দেশগুলোতে স্থাপন। এর সাথে চীনা পণ্যের প্রবেশে আমেরিকান বাজারে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাণিজ্যিকভাবে চীনকে কোণঠাসা করা। ট্রাম্পের আমলে বন্ধ করা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য দেয়া বাণিজ্য সুবিধাগুলো ফিরিয়ে এনে মিত্রদের আস্থা অর্জন করা।
চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আমেরিকার তৃতীয় লক্ষ্য এলাকা হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগানো। রাশিয়া ও অন্য চীনা মিত্রদেশগুলোকে সাথে নিয়ে বিকল্প মুদ্রা ও লেনদেন প্রক্রিয়া তৈরির চৈনিক প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করা। এ জন্য বিশ্বব্যাংক আইএমএফ গ্রæপের কঠোর ঋণদান ব্যবস্থাকে উদার করে চীনা অর্থায়নসূত্রকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে চীনের ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট’ উদ্যোগের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বিশেষভাবে টার্গেট করা। একই সাথে, নতুন সিল্ক রোডের এই উদ্যোগ যাতে সফল হতে না পারে তার চেষ্টা করা।
চীনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতের আরেকটি ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে জিংজিয়ান হংকং ও তিব্বতসহ বিচ্ছিন্নতাপ্রবণ অঞ্চলগুলোর অধিকার আন্দোলনে সমর্থন দেয়াকে। জিংজিয়ান সহায়তার জন্য আফগান অঞ্চল থেকে আমেরিকার প্রত্যাহার কৌশলগত বিপত্তি তৈরি করলেও মধ্য এশিয়ার কোনো দেশকে দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করার প্রচেষ্টা। হংকংয়ে চীনের মূল ভ‚খণ্ডের আইন ও রীতি-নীতি চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ রয়েছে সেটিকে চাঙ্গা করে তোলা। একই সাথে হংকং ও উইঘুর-এর মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা। ঠাণ্ডা হয়ে আসা তিব্বত ইস্যুটিও আবার বৈশ্বিক দৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে কোয়াড মিত্র ভারতকে কাজে লাগানোর বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো।