উপসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্কের নতুন মিশন
এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
প্রায় এক দশকের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং মাঝে মাঝে সরাসরি বৈরিতার পর তুরস্ক ও তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণায়ানের জন্য সম্প্রতি তুর্কি এবং মিসরীয় কর্মকর্তারা এই বৈঠকে বসছেন।
২০১৩ সাল থেকে দেশ দুটির মধ্যে প্রথম উচ্চ-স্তরের সরাসরি আলোচনা মে মাসের কায়রো শীর্ষ সম্মেলনের পর উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আঙ্কারার এই বৈঠকটি তুরস্ক-মিসর মধ্যকার আলোচনার দ্বিতীয় দফা।
২০১১ সালের আরব বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার পর দেশটি ও বিবাদমান আরব দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ পুনর্স্থাপনের সর্বশেষ নমুনা এই বৈঠক। আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাজুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন জন্ম নেয়। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন যাবত গদিনসীন অনেক শাসক ক্ষমতাচ্যূত হয় এবং অন্যরাও হুমকির মুখে পড়ে।
তুরস্ক আন্দোলনকারী মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই অঞ্চলে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ গ্রহণ করে এবং জনপ্রতিবাদের মুখে আরব দেশগুলোকে শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য চাপ দেয়।
কিন্তু তার পরিবর্তে তুরস্ক যে সব গোষ্ঠীকে সমর্থন প্রদান করেছিল তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং আঙ্কারা এ অঞ্চলে নিজেকে বন্ধুহীন অবস্থায় খুঁজে পায়।
২০১৩ সালে মিশরে সামরিক প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা এবং তুর্কি মিত্র রাষ্ট্রপতি মোহামেদ মোর্সিকে অপসারণ করলে দুই দেশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয় ।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও তুরস্কের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। কারণ দুই দেশই মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিজেদের ক্ষমতাসীন রাজবংশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছিল।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোজ্জিকে হত্যার পর সৌদিদের সঙ্গে তুরস্কের মতবিরোধ সবার সামনে উঠেছিল। তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেচেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক যুবরাজ মোহাম্মেদ বিন সালমানের (যিনি এমবিএস নামেও পরিচিত) ঘনিষ্ঠ মহলের দিকে অভিযেোগের আঙুল তুলেছিলেন।
২০১৯ সালে জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত ত্রিপোলি-ভিত্তিক সরকারকে সমর্থনে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তুরস্ক। অন্যদিকে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব সরকারবিরোধীদের প্রতি সমর্থন জানায়।
২০১৭ সাল থেকে তুরস্কের মিত্র কাতারের বিরুদ্ধে মিসরীয়, আমিরাতি, সৌদি ও বাহরাইনি আরোপিত অবরোধ আঙ্কারার সাথে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই বছরের শুরুর দিকে এই উপসাগরীয় সংকটের সমাধান বিভাজন শেষে পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা দূর করেছে।
গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে নিমন্ত্রণ করার দুই সপ্তাহ পর এরদোগান সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতা যুবরাজ মোহাম্মেদ বিন জায়েদের সঙ্গে ফোনালাপ করেন।
যদিও এরদোগান এবং সৌদি যুবরাজ এখনো সরাসরি কথা বলেননি, তবে মে মাসে তুর্কি রাষ্ট্রপতি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুলাজিজের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলেছিলেন যে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তরন কারণে আঙ্কারা দেশটির প্রাক্তন প্রতিপক্ষদের মধ্যে পুনর্মিলনের পরিবেশ তৈরি করেছে।
‘মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট’-এর ‘সেন্টার ফর টার্কিশ স্টাডিজ’-এর পরিচালিকা গোনুল তোল বলেন, আরব বসন্তের গণ-অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। "অনেক আরব দেশের শাসকদের মধ্যে ক্ষমতা-বিরোধী হুমকির ভয় তুঙ্গস্পর্শী হয়েছিল, দেশগুলোর জনসাধারণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাচ্ছিল এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল।"
এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দেশগুলো তুরস্ককে বড় হুমকি হিসেবে গণ্য করে এবং তাকে লক্ষ্য করে "আক্রমণাত্মক, নিরাপত্তামূলক বৈদেশিক নীতি" গ্রহণ করে, তিনি যোগ করেন।
তাড়াহুড়ো করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণের যে লক্ষণ দেখা গেছে, তাতে ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক ভূমিকার প্রতি বিশ্বাসও ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
একই সময় আরব বসন্ত-পরবর্তী আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি কাজ করছে না, এই উপলব্ধি সৌদি, আমিরাতি এবং মিশরীয়দের কূটনীতি-ভিত্তিক পন্থা অবলম্বনের পথে পরিচালিত করে।
"তারা বুঝতে পেরেছে, ‘এখন থেকে আমাদের যে অঞ্চলে বাস করি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি থাকবে না এবং নিরাপত্তামূলক বৈদেশিক নীতি আমাদের পছন্দসই ফলাফল দেয়নি," তোল বলেন।
২০১০ সালের দশকের শুরুর চেয়ে আরব ত্রয়ী তাদের দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব নিয়ে এখন কম উদ্বিগ্ন, এমনটা বলার সাথে তোল আরো বলেন, "এই অঞ্চলের নেতাদের মানসিকতা পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়েছে।"
আহি এভরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুষদের শিক্ষক এইয়ুপ এর্সয় বলেন, তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তার অটল সমর্থন ত্যাগ করেছে এবং তাদের পক্ষে আগের মতো সোচ্চার নয়।
"যথেষ্ট সমস্যা সৃষ্টিকারী" এই প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের সঙ্গে দ্বন্দের অবসান তুরস্ককে এই অঞ্চলে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের বিদ্যমান বাধাগুলো থেকে আরো বেশি অব্যাহতি দেবে। পাশাপাশি দেশটির "আঞ্চলিক প্রভাব" স্বীকৃত হবে এবং এ অঞ্চলে "ক্রমাগত তৃতীয় পক্ষীয় দ্বন্দ্ব"-এর সম্ভাবনাও দূর হবে।
তিনি বলেন, কায়রো এবং আবু ধাবির সঙ্গে সম্পর্ক আরো ভালো হলে তাতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসকে আরো একঘরে হয়ে পড়বে।
করোনা ভাইরাস মহামারীতে প্রভাবিত এই অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য তুরস্ক-আরব দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই দ্বন্দ্বের অবসান দেশগুলোকে পারষ্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ এবং উন্নত পর্যায়ের বিনিয়োগের দিকে পরিচালিত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
"স্থবির দেশীয় অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক হিসেব খাতে দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির কথা বিবেচনা করলে বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বর্ধিত বিনিয়োগ তুরস্কের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে।"
যদিও চার দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে প্রতিযোগিতা এবং অবিশ্বাসও কিছু মাত্রায় বজায় থাকবে।
‘জার্মান ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্স’-এর সহকর্মী গালিপ দালায় বলেন, বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত শত্রুতা আন্ত:দেশীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাকে কঠিন করে তুলতে পারে এবং শুধুমাত্র দেশগুলোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাত্রা হ্রাস করাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
" এই বাস্তবতা লিবিয়ায় সবচেয়ে স্পষ্ট, যেখানে দেশগুলোর কেউই নিজস্ব অবস্থান পরিবর্তন করে নি কিন্তু তারা সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি করছে না," তিনি বলেন।
এল-সিসি মোর্সিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার প্রতি এরদোগানের বিষোদগারের কথা উল্লেখ করে দালায় আরো বলেন, " এরদোগানের জন্য সিসির সাথে হাত মেলানো বা তাার সাথে ছবি তোলাও মানসিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে কঠিন কাজ হবে।"
এদিকে তোল এরদোগান এবং সৌদি যুবরাজের মধ্যকার বিরোধের উপর জোর দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এমবিএস ভুলে যাননি তুরস্ক খাশোজ্জির ব্যাপারে কী করেছিল। "আরব গণ-অভ্যূত্থান দিয়ে শুরু হওয়া গত দশকটি এই শাসকগোষ্ঠীর জন্য যতখানি আতঙ্কজনক এবং কঠিন ছিল এবং সেই সময় তুরস্ক যে আচরণ দেখিয়েছিল তা সব মিলিয়ে পারষ্পরিক সম্পর্কে এমন একটি দগ্ধ চিহ্ন রেখে গেছে যা সহজে দূর হবে না।"