যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট কে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন - ছবি : সংগৃহীত
১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধে বিপুল উদ্যমে অংশগ্রহণ করেছে।
স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৭৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভ করে। এরপর আয়তন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশটি পূর্বে, উত্তর ও দক্ষিণে ব্রিটেনের স্পেন ও মেক্সিকো সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর ব্যবসায় অগ্রগতি ও চাঙ্গাভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু করে। পূর্ব এশিয়ায় চীন, কোরিয়া, জাপান, ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরে আলজেরিয়া, লিবিয়া হয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ দ্বীপপুঞ্জ, বিশেষত কিউবা ও হাইতি; এরপর হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, পানামা, কলম্বিয়া ইত্যাদি দেশে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
আর এই যুদ্ধগুলো ছিল ১৯১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণের আগে।
১৯৪১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরও পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকার যুদ্ধাভিযান বন্ধ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই পূর্ব এশিয়ায় দু-দুটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা : ১. কোরিয়া যুদ্ধ যেটি সমাপ্ত হয় ১৯৫৩ সালে, ২. ভিয়েতনাম যুদ্ধ যেটি সমাপ্ত হয় ১৯৭৫ সালে।
বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি ও সরঞ্জামের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও উভয় যুদ্ধে তাদের পরাজয় ঘটে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, ভিয়েতনামে আমেরিকার শোচনীয় পরাজয় তাদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধাভিযানে লাগাম টেনে ধরবে। ভিয়েতনামে পরাজয় বরণের ফলে পুরো বিশ্ব ও মার্কিন জনগণের বড় একটি অংশের মনে আমেরিকার সামরিক শক্তিমত্তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হল। ফলে মার্কিন সমরবিদদের জন্য নতুন একটি যুদ্ধ জয়ের প্রয়োজন পড়ল।
এরপর আমেরিকা গ্রানাডা, লেবানন, ইরান, কসোভো, হাইতিসহ বেশ কিছু দেশে এককভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করল।
এরপর তো নাইন ইলেভেনের ঘটনা ঘটল, যেখানে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে ৩ হাজার মার্কিন নাগরিক নিহত হয়। এখন তো নতুন যুদ্ধ শুরু করা ছাড়া মার্কিন প্রশাসনের হাতে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না।
'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ' শিরোনামে সূচনা হলো লড়াইয়ের নতুন অধ্যায় যা কোনো সময় বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ল। তবে মৌলিকভাবে ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা দুই দশকব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল যার উভয়টাতেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি একটি সামরিক গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র ১৭ বছর যুদ্ধবিহীন কাটিয়েছে আমেরিকা। এটি ছিল মার্কিন জাতির ইতিহাসের মাত্র সাত শতাংশ। অর্থাৎ তাদের ইতিহাসের ৯৩ শতাংশ সময় তারা কোনো না কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের লজ্জাজনক পরিণতির পরও অতীতের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় সকলের মনেই কৌতুহল রয়েছে যে আমেরিকার পরবর্তী আগ্রাসন কোথায় এবং কবে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সিআইএ ও বড় বড় প্রযুক্তি ও সামরিক কোম্পানিগুলো নতুন কোনো যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজে নিতে খুব বেশি দেরি করবে বলে মনে হয় না।
পেন্টাগনের জেনারেল ও তাদের সমমনা সরকারি কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত সমরবিদরা 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ'-এর প্রথম ফ্রন্ট আফগানিস্তানে দুই ট্রিলিয়ন ডলার ও দ্বিতীয় ফ্রন্ট ইরাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার পরও নতুন যুদ্ধক্ষেত্র অনুসন্ধানে নেমে পড়েছে।
ওয়াশিংটনে প্রকাশিত সিআইএর বিবৃতিতে চোখ বুলালে অনুমান করতে মোটেই বেগ পেতে হয় না যে পরমাণু কর্মসূচির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির দরুণ ইরানের দিকে বা সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে আবির্ভূত চীনের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুকের নল ঘুরে যেতে পারে।
তাছাড়া উত্তর কোরিয়া প্রতিনিয়ত তাদের পরমাণু শক্তি সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। যা তাদের উপর পেন্টাগনের ঈগলদের হামলার বৈধতা দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নজিরবিহীন মেরুকরণ সৃষ্টি হলেও চীনবিরোধী নীতির ক্ষেত্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ঐক্যমত সৃষ্টি হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল থেকে বোঝা যায়, ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক আমলাতন্ত্র চীনের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা প্রণয়নে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গত মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ নিরাপত্তা প্রস্তাবনায় তারা চীনের হুমকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। কারণ বর্তমানে একমাত্র চীনই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী যারা প্রযুক্তির পাশাপাশি সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী যা আমেরিকার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্তির পর নব্বই দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তার সৈন্যবাহিনীর পিছনে ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা চীনের সামরিক ব্যয়ের চেয়ে ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি।
বরং একই সময়ে সারাবিশ্ব মিলেও এত খরচ করেনি সামরিক বাহিনীর পেছনে।
হন্ডুরাস থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত, জাপান, ইরাক ও কাতার থেকে জার্মানি ও ইতালি পর্যন্ত সবগুলো মহাদেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড ফিন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ৭০টি দেশে ৮০০-এর বেশি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বিশ্বে এরকম নজির দ্বিতীয়টি নেই।
অধ্যাপক ফিন বলেন, চীন ব্রিটেন ফ্রান্স ও রাশিয়ার মতো অন্যান্য বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর সব মিলিয়ে মাত্র ৩১টি বিদেশী ঘাঁটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।
ওয়াশিংটন এই বিদেশী ঘাঁটিগুলোতে দেড় থেকে দুই লাখ সৈন্য মোতায়েন রাখে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক অভিযানের সময় এই সংখ্যায় কিছুটা হেরফের হয়ে থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন সরকারের অবস্থানের ভিত্তিতে ও সামরিক উপস্থিতির তারতম্য ঘটে থাকে।
নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু কিছু অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন সামরিক উপস্থিতি ও তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশ করা হয় না।
চীনকে মোকাবেলার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে পেন্টাগন প্রায়ই বিভিন্ন সামরিক মহড়ার আয়োজন করে থাকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ গবেষক ও বিশ্লেষকদের মতে তাইওয়ানে চীনের আগ্রাসন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওই ধরনের পদক্ষেপ হোয়াইট হাউসকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দিবে।
চীন যদি তাইওয়ানকে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নেয়, তাহলে যে ওয়াশিংটনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আগামীর দিনগুলোই বলে দেবে আফগানিস্তান ও ইরাকে শোচনীয় পরাজয়ের পরও আমেরিকার যুদ্ধ করার খায়েশ এখনো বাকি আছে, নাকি আমরা মানব ইতিহাসের নজিরবিহীন কোনো যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি?
সূত্র : আলজাজিরা