শহীদ সাইয়েদ কুতুব : ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রপথিক
শহীদ সাইয়েদ কুতুব - ছবি : সংগৃহীত
শহীদ সাইয়েদ কুতুব ইব্রাহীম হুসাইন আশ-শাযলী, বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদারহুড) অধিনায়ক এবং অবিসংবাদিত নেতা।
তাকে আরব জাহানসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম চিন্তানায়ক, ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রপথিক এবং মিসরে ইসলামি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও তাত্ত্বিক পুরুষ মনে করা হয়।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে জন্ম নেয়া সাইয়েদ কুতুব কুরআনের হাফেজ ছিলেন। উচ্চতর পড়াশোনা করেন কায়রো দারুল উলুম ও আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে।
আমেরিকা থাকাকালীন তিনি পাশ্চাত্যের ভোগবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষার অসারতা ও নীচুতা অনুধাবন করেন। তখন তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানবসমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে। এই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি পরে কলম ধরেন এবং ইসলামি রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
সাইয়েদ কুতুবের লেখালেখি শুরু হয় শিশুসাহিত্য দিয়ে। শিশুদের মনে ইসলামি ভাবধারা জাগানোর জন্য এবং তাদের চারিত্রিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি আকর্ষণীয় ভাষায় গল্প লিখতেন। পরবর্তীকালে তিনি ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। মূলত লেখালেখির মাধ্যমেই তিনি পুরো বিশ্বে ব্যপকভাবে পরিচিতি পান। কারণ মুসলমানরা তার লেখা থেকে পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখে।
তিনি হাসান আল বান্নার প্রতিষ্ঠিত ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনে যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেন। তখন সংগঠনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবল চাপের মুখে ছিল। তবুও তার নিযুক্তির পর ইখওয়ানে অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। ওই সময় মিসরের মানুষ দলে দলে তাতে যোগ দিতে শুরু করে। ইখওয়ানিদের বিশ্বাস- তার কারণেই আবারও এই সংগঠন বিপ্লবী রূপ ফিরে পায়। যার ফলে একসময় তিনি ইখওয়ানের একনিষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান নেতা হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরকে স্বাধীনতা দানের ওয়াদা করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান দল ব্রিটিশের মিসর ত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ে এবং দু’বছরের মধ্যে দলের সক্রিয় কর্মীসংখ্যা ২৫ লাখে পৌঁছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। ঠিক তখনই ব্রিটিশ ও মিসর সরকার তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে।
সাইয়েদ কুতুব একজন উঁচুমানের সাহিত্যিক হওয়ায় একসময় ইখওয়ান-পরিচালিত সাময়িকী - ইখওয়ানুল মুসলিমীন-এর সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাস পরেই ব্রিটেনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সমালোচনা করায় মিসর সরকার জামাল আবদুন নাসের পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। তখন তাকেসহ হাজার হাজার ইখওয়ান সমর্থককে গ্ৰেফতার করা হয় এবং তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। দীর্ঘ ১০ বছর কারাভোগের পর তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্টের সুপারিশে মুক্তি লাভ করেন। এরপর আট মাসের মাথায় সরকার পতনের চক্রান্তে জড়িত থাকার মামলা দিয়ে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালের ২১ আগস্ট সামরিক ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। কার্যকর করা হয় এর আট দিন পর, ২৯ আগস্ট ভোরে।
মৃত্যুদণ্ডের আগে সাইয়েদ কুতুবকে কালিমা পড়াতে একজন সরকারি মৌলভিকে জেলখানায় পাঠানো হয়। তিনি এই মৌলভিকে লক্ষ্য করে বলেন- 'তোমার কালিমা তোমার রুটি যোগায় আর আমার কালিমা আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলায়।'
তার কারাগারের দিনকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ইউসুফ আজম লিখেছেন- ‘সাইয়েদ কুতুবের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন চালানো হয়। আগুনে শরীর ঝলসে দেয়া হয়। পুলিশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করা হয়। মাথার ওপর কখনো টগবগে গরম পানি ঢালা হয়। পরক্ষণে আবার খুবই শীতল পানি ঢেলে শরীর বরফের মতো ঠান্ডা করা হয়। পুলিশ লাথি, ঘুষি মেরে একদিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যেত।’
সাইয়েদ কুতুবের গ্রন্থগুলো যে পাঠ করত, সেই তার অনুসারী হয়ে যেত। তা রোধ করতে যেদিন তাকে ফাঁসি দেয়া হয়, সেদিন মিসরের পথে পথে তার রচিত তাফসির 'ফি যিলালিল কুরআন'- এর প্রায় ৬৪ হাজার ভলিয়ম পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়- যার কাছে সাইয়েদ কুতুব- এর গ্রন্থ পাওয়া যাবে তাকে দশ বছর জেল হাজতে হবে।
ধারণা করা হয়- তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার প্রধান একটি কারণ হলো এই বই রচনা। তাই তার মৃত্যুর পর বইটি সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহল জাগে। মানুষের এই কৌতূহলের কারণে যে বছর সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয় ওই বছরেই বইটির সাত সংস্করণ ছাপা হয়েছিল।
হাসান আল বান্নার পরে সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে ইখওয়ান অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতে ইখওয়ানের প্রভাব চোখে পড়ার মতো। তুরস্কের একেপি, ফিলিস্তিনের হামাস, তিউনিশিয়ার আন-নাহদা, সিরিয়ার ইখওয়ানুল মুসলিমিন সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল মূলত ইখওয়ান থেকে অনুপ্রাণিত এবং তাদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত।
সাইয়েদ কুতুবকে তার কাজ ও চিন্তা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং মুসলিম বিশ্বে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে।