পঙ্গু মার্কিন সেনার আক্ষেপ : এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম
এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম - ছবি : সংগৃহীত
একটি ছবি। সেটাই আপাতত হতবাক করেছে গোটা দুনিয়াকে। নাইট ভিশন ক্যামেরায় তোলা ছবিতে হেঁটে আসতে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তিকে। তিনি আমেরিকার এক সেনাকর্মী। ডান হাতে রাইফেল। বাঁ হাতটি ফাঁকা। এমনই ঝোলানো। আফগানিস্তানে কর্তব্যরত অবস্থায় ওই দু’টি হাত এতটা নিরুদ্যম কখনও হয়েছিল কি? শেষ কবে এ ভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে ফিরেছেন আমেরিকার কোনো সৈন্য? উত্তর খুঁজতে বসে হাতড়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব। অনেকে এমনও মনে করছেন, ছবিটি আমেরিকার বর্তমান অবস্থান। ২০ বছরের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ‘ওয়াক আউট’ করার গ্লানি সব কিছুই বুঝিয়ে দিচ্ছে এক ঝলকে। ২০ বছরে আফগানিস্তানে অনেক কিছুই হারিয়েছে আমেরিকার সেনাবাহিনী। আবার উল্টোটাও হয়েছে। পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, নিজেদের ক্ষতির থেকে আমেরিকার সেনার হাতে ক্ষয়ই হয়েছে বেশি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব তৈরি করেছিল। যার মূল বিষয় ছিল, আমেরিকা কত প্রাণের মূল্য আফগানিস্তানে দিয়েছে এবং কতটা নিয়েছে। প্রজেক্টের নাম ‘কস্ট অব ওয়ার’। প্রজেক্টের তথ্য বলছে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ৬ হাজার ৩০৭ জন আমেরিকান প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৪৬১ জন আমেরিকার সেনা। ৩ হাজার ৮৪৬ জন আমেরিকার ঠিকাদার। অন্য দিকে, ২০ বছরে নিহত তালিবানের সংখ্যা ৫১ হাজার ১৯১ জন।
তালেবান উৎখাত করতে নেমেছিল ন্যাটো বাহিনী। এই ন্যাটোর সদস্য আমেরিকা ছাড়াও ব্রিটেনসহ প্রায় ৩০টি দেশ। ২০ বছরে আমেরিকার সহযোগী ওই দেশগুলোর সৈন্যদের মধ্যে ১ হাজার ১৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমেরিকার হয়ে যুদ্ধে নামা ৬৬ হাজার আফগান সেনা ও পুলিশ মারা গিয়েছেন। এমনকি আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, তাদেরও ৪৪৪ জন মারা গেছে সেনা-তালেবান সংঘর্ষে।
২০ বছরের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বলি হয়েছেন বহু সাংবাদিক। তালিকায় শেষ নাম পুলিৎজার পাওয়া ভারতীয় চিত্র সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। তার মতো আরো ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন আফগানিস্তানের পরিস্থিতির খবর করতে গিয়ে। এরা সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন না এমন ৪৭ হাজার ২৪৫ জন আম আফগান নাগরিক মারা গিয়েছেন। যারা আফগানিস্তানে থাকার মূল্য দিয়েই চলেছেন। দু’দিন আগেও বিমানবন্দরে রকেট হামলার জবাবে আমেরিকার ড্রোন হানায় একই আফগান পরিবারের ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে সাত জনই শিশু এবং নাবালক। এই ১০ জন অবশ্য হার্ভার্ডের পরিসংখ্যানের বাইরে। কারণ দুই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ গণনা করেছে এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
দেশ ছাড়ার সময় বেঁধে দিয়েছিল তালেবান। ৩১ আগস্ট। ক্যালেন্ডারে সেই তারিখ ছোঁয়ার এক মিনিট আগেই আফগানিস্তান ছেড়েছে আমেরিকার সেনা। রাতের অন্ধকারে। মাথা নিচু করে আমেরিকার শেষ সৈন্যের হেঁটে আসার দৃশ্য দেখে থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। মনে পড়িয়েছে আমেরিকার প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া এক সেনার আক্ষেপ, ‘এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম!’
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা