তালেবান নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও আশঙ্কা
আফগানিস্তানে তালেবান - ছবি সংগৃহীত
কাবুলে তালেবানের উত্থান নিয়ে কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে সতর্কতার সাথে এগোচ্ছে নয়াদিল্লি। আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের বিশেষ ঔৎসুক্য, স্বার্থ ও কৌশল রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য ও আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার করতে চাইলে আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে হবে না। আরএসএস যে ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্ন লালন করে, সে তালিকায় আফগানিস্তানও আছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাবুলে তালেবানের ঝটিকা বিজয়ে হকচকিত হয়ে পড়েছে ভারত। ২০ আগস্ট গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরের উন্নয়ন কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘ধ্বংসাত্মক শক্তি তথা সন্ত্রাসের মাধ্যমে আতঙ্কের পরিবেশ কায়েম করে যারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলায় বিশ্বাস করে, তারা কিছু সময়ের জন্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে ঠিকই। কিন্তু তার অস্তিত্ব কখনোই স্থায়ী হয় না। বেশি দিন ধরে তা মানবতাকে দমন করে রাখতে পারে না।’ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পরপরই সাবেক আফগান প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে সে বিষয়ে বিবৃতি দেয়ার পরিবর্তে নয়াদিল্লির উচিত হবে তার অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতে দৃষ্টি দেয়া। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত নয়াদিল্লির (https://www.dawn.com/news/1642085)।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর পশ্চাদপসরণের পর আফগানিস্তানে মূল প্রভাবকের আসনে বসতে যাচ্ছে চীন ও পাকিস্তান। এই দুই রাষ্ট্র ছাড়াও কাবুলের তালেবান শাসকশ্রেণীর নির্ভরতা বেড়েছে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের ওপর। ভারত তার অখণ্ডতা ও ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থে আফগান পরিস্থিতির ওপর সর্বদা তীক্ষè নজর রেখে আসছে এবং ক‚টনৈতিক দক্ষতায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানরা (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতায় এলে ভারত সে সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও নৃতাত্তি¡কভাবে তালেবানের সাথে পাকিস্তানের বোঝাপড়া ও সখ্যতা থাকায় ভারত তালেবানদের ওপর আস্থা রাখতে পূর্ণ সাহস পায়নি। পাকিস্তান ও চীনের সাথে তালেবানের সুসম্পর্ককেও ভারত বিবেচনায় রাখে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করলে আফগানিস্তান নিয়ে ভারত বেশ উৎসাহী হয়ে পড়ে এবং মাথা ঘামাতে থাকে। ভারত-আফগানিস্তান বেশ ক’টি কৌশলগত সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রত্যাশা ছিল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে। তালেবানরা মাথা তুলতে পারবে না আর। মোল্লা ওমর নেই, লাদেনও নেই। এ চিন্তা থেকে হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনির শাসনামলে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে ছোট-বড় ৪০০টি উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২৫ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে।
ভারত সবসময় আফগান যুদ্ধবাজ দলের ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’ সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে; যারা ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সমর্থিত হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনির সরকারকে দিল্লি সামরিক, অর্থনৈতিক, গোয়েন্দা তথ্য ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যায় ২০ বছর ধরে। আফগান ন্যাশনাল আর্মি অফিসারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ভারত। সোভিয়েত আমলের আফগান ট্যাংক ও এয়ারক্রাফটের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। রাশিয়ার তৈরি এমআই-৩৫ হেলিকপ্টার গানশিপের পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। রাজধানী কাবুলে পূর্ণ দূতাবাস ছাড়াও কান্দাহার, হেরাত, জালালাবাদ ও মাজার-ই-শরিফে ভারতের কনসুলেট স্থাপন করে কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে কাবুল দূতাবাসে দু’বার আত্মঘাতী গাড়িবোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ৭৫ জন নিহত ও ১৭১ জন আহত হয়। এ ছাড়া ২০০৭ সালে জালালাবাদ, ২০০৮ সালে মাজার-ই-শরিফ, ২০১৪ সালে হেরাত কনসুলেটে গ্রেনেড ও মেশিনগানে হামলা চালানো হয়। এতে বোঝা যায়, আফগানিস্তানে ভারতের সরব উপস্থিতি তালেবান পছন্দ করেনি। কারণ তারা মনে করে, ভারত দখলদার বাহিনীর দোসর।
পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে কৌশলগত কারণে আফগান ভ‚মিতে প্রভাব বাড়িয়েছিল দেশটি। বাঁধ, সেতু, রাস্তাঘাট, হেলথ সেন্টার থেকে আফগান সংসদ ভবন পর্যন্ত নির্মাণে ছিল ভারতের সাহায্য। ২০ বছরে নয়াদিল্লি-কাবুলের যে ক‚টনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা ধাক্কা খেয়ে গেল। ২০১৬ সালে হেরাত প্রদেশে ৪২ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে ভারত। এটি সালমা বাঁধ নামে পরিচিত। এ বাঁধের ফলে চিশতি শরিফ জেলার ৭৫ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসে। এখানে তালেবানের হামলায় ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে একাধিক ভারতীয় কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এ বাঁধ এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৬ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, ছাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ইরানকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। আফগানিস্তানে সমুদ্রপথে যোগাযোগ সহজতর করতে ভারত ও ইরান সম্প্রতি ছাবাহার বন্দরে কার্যক্রমও শুরু করেছে। এই বন্দর হতে পারে আফগানিস্তানে ভারতীয় পণ্য রফতানির বিকল্প রুট (ডয়চে ভেলে, ২০ নভেম্বর ২০১৩)।
পাকিস্তানকে এড়িয়ে ইরানের ছাবাহার বন্দর ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লি ইরান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ২১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করে। ১৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই রিং রোড কান্দাহার, গজনি, কাবুল, মাজার-ই-শরিফ ও হেরাত শহরকে স্পর্শ করেছে। এ রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ছয় ভারতীয় নাগরিকের। উল্লেখ্য, রাস্তাটি নির্মাণের জন্য ভারতীয় সহযোগিতা ও বিনিয়োগ ছিল তালেবানের অনুপস্থিতিতে। এ কারণে তালেবান সরকার সড়কটি ব্যবহারে ভারতকে সুযোগ দেবে কি না, তা নিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষকদের রয়েছে সংশয়। ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে কাবুলে সংসদ ভবন নির্মাণ করে দিয়েছে ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে এর উদ্বোধন করেন। শুধু তা-ই নয়, ভারত সরকার আফগানিস্তানকে ২০০ মিনিবাস, ৪০০ বাস, ১০৫ সরকারি গাড়ি, ২৮৫টি সেনাবাহী গাড়ি, পাঁচটি শহরে ১০টি অ্যাম্বুলেন্স, তিনটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান উপহার হিসেবে দিয়েছিল (আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৬ আগস্ট ২০২১ )।
জিনিউজের ভাষ্য অনুযায়ী, কাবুলে বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে পুল-ই-খুমরি বিদ্যুৎ প্রকল্প ২০০ কেভি ডিসি সঞ্চালন লাইন ও সাব-স্টেশন তৈরি হয়েছে ভারতীয় অর্থায়নে। দেশটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সৌর প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও করেছে ভারতীয়রা। কাবুলে একটি শিশু চিকিৎসাকেন্দ্রকে নতুন করে গড়ে তুলেছে নয়াদিল্লি। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল মিশনের আওতায় জায়গায় জায়গায় বিনা মূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বহু ক্লিনিক তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। স্কুলের বেঞ্চ, ডেস্ক ও গ্রামাঞ্চলে সৌর প্যানেল তৈরি করেছে ভারত। কাবুলে তৈরি হয়েছে একাধিক সুলভ শৌচালয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ, স্কলারশিপ ও ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ভারত। ১৬ হাজার আফগান শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে ভারত। জেনেভা সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, আফগানিস্তানে শতুত বাঁধ তৈরি করছে ভারত। ২০ লাখ মানুষ পাবেন পানীয় জল। প্রায় ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে প্রায় ১০০টি কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করা হয়। ভারতের সাবেক স্পেশাল ফোর্স অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পিসি কাটোচ মনে করেন, আফগানিস্তানে স্থিতাবস্থা আনতে সক্ষম হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এই ভেবেই ভারত বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু আমেরিকা তালেবানের হাতে ছেড়ে দিলো আফগানিস্তানকে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের তিন বিলিয়ন ডলার রীতিমতো ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০ বছর আগের চেয়ে বর্তমান তালেবান নেতৃত্বকে অনেকটা পরিপক্ব মনে হয়। এরই মধ্যে তালেবান প্রতিনিধিদল রাশিয়া ও চীন সফর করে ক‚টনৈতিক মিশন সম্পন্ন করেছে। এমনও হতে পারে, তালেবান নেতৃত্ব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে ভারতের সহায়তা চাইতে পারে। ভারতও নিজের স্বার্থে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত করে তালেবানের আস্থা অর্জন করতে পারে। এখানে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ বিদ্যমান। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তান ও চীন কোনো দিন চাইবে না আফগানিস্তানে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি পাক।
কাবুলে ক্ষমতার পরিবর্র্তনের সাথে সাথেই ভারতের সাথে স্থলবাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। ফলে দিল্লিসহ ভারতের প্রায় সর্বত্র শুকনো ফলের বাজার দর আকাশ ছুঁয়েছে। টাটকা ফলের দামও বেড়েছে মাত্রাছাড়া হারে। আখরোট, কাজুবাদাম, আঞ্জির, অ্যাপ্রিকট, কিশমিশ, সুগন্ধি হিং, ত্বীন, এলাচ, গরম মসলার বাজারের অবস্থা তথৈবচ। এ দিকে ভারতের পোশাক, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সিমেন্ট, চিনি, হার্ডওয়্যার পণ্যাদি, কৃত্রিম ফাইবার কম্পিউটারের যে বিশাল বাজার ছিল কাবুলসহ গোটা আফগানিস্তানে; তা-ও থমকে গেছে। ওই সব পণ্যে বোঝাই হাজার হাজার ট্রাক সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম পাঞ্জাবের ওয়াগা সীমান্তের এ পারে। এসব পণ্য এত দিন ওয়াগা সীমান্ত পেরিয়েই ঢুকে যেত আফগানিস্তানে। দুই দেশের মধ্যেদেড় শ’ কোটিরও বেশি ডলারের বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকারে। ভারতের রফতানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ আফগানিস্তানের সাথে। ২০১৯-২০ মেয়াদে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারত থেকে রফতানির মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ভারতে আফগানিস্তানের রফতানি প্রায় ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। দেশের শুকনো ফলের মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশ মেটায় আফগানিস্তান। তাই কাবুল ফের তালেবানের কব্জায় চলে যাওয়ায় তীব্র অনিশ্চয়তার সুতোয় ঝুলছে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে রফতানি ও আমদানি বাণিজ্য।(https://www.anandabazar.com/world/afghanistan-indian-trade)।
ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও আশঙ্কা হলো, তালেবানের সহায়তায় ভারতীয় জম্মু-কাশ্মিরের আন্দোলনকারীরা যদি অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জোরদার করে, তা হলে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে। কাশ্মির সঙ্কট পুরো ভারতকে অস্থির করে তুলতে পারে। আফগানিস্তান থেকে গিলগিট-বালতিস্তান হয়ে আজাদ কাশ্মিরের মধ্য দিয়ে শ্রীনগরে পৌঁছার কৌশলগত সড়ক রয়েছে। এই সীমান্ত অনেকটা অরক্ষিত। চীনের অর্থায়নে মহাসড়ক ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কাজ চলছে আজাদ কাশ্মিরের অভ্যন্তরে। কারাকোরাম পর্বতমালার পাদদেশ ধরে তিব্বত পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি হয়ে গেছে। গেরিলাদের আশ্রয় নেয়ার জন্য আজাদ কাশ্মির ছাড়াও আছে চীন নিয়ন্ত্রিত লাদাখ ও গালওয়ান উপত্যকা।
জম্মু-কাশ্মিরের এক কোটি ৩৬ লাখ জনগণ আগে থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। বঞ্চনাজনিত ক্ষোভের কারণে প্রায় সময় সঙ্ঘাত লেগে থাকে। ১৯৪৭ সালের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। কাশ্মির এখন বলতে গেলে ফুটন্ত তেলের কড়াই।
স্মর্তব্য, ২০১৮ সালের জুনে জম্মু ও কাশ্মিরে কেন্দ্রীয় শাসন চালু হয়। প্রবল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়। ফলে জম্মু ও কাশ্মির বিশেষ অধিকার হারায়। জম্মু ও কাশ্মিরকে ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয় এবং প্রচুর সেনা নিয়োগ করা হয়। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এরই মধ্যে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ভারতের উত্তর সীমান্তে চীন-ভারত খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। ভারতকে চীনের আগ্রাসন রোধে দুই লাখ সেনা মোতায়েন রাখতে হয়। অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা ভারতীয় নেতাদের গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। তারা সহজে বুঝতে পারে, বিদেশী সেনা চলে যাওয়া মানে তালেবানের প্রত্যাবর্তন ও ঝটিকা বিজয়। রাজনীতির নতুন ধারাপাত শুরু হয়ে যাবে। তখন ভারতীয় নেতারা কাশ্মিরি রাজনীতিকদের সাথে বৈঠক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নেন। প্রয়োজনে ৩৭০ ধারা পুনরুজ্জীবনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এ চিন্তা মাথায় রেখে চলতি সালের ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের ১৪ জন রাজনৈতিক নেতাকে দিল্লিতে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। মেহবুবা মুফতি ও ফারুক আবদুল্লাহকে মুক্তি দেয়া হয়। সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংলাপে অংশ নেন মেহবুবা মুফতি, কংগ্রেস নেতা গোলাম নবি আজাদ, সাবেক উপ মুখ্যমন্ত্রী কবীন্দ্রর গুপ্ত এবং জম্মু ও কাশ্মিরের বিজেপির প্রধান রবীন্দ্র রায়না ও ফারুক আবদুল্লাসহ অন্যরা। বৈঠকে মূল দাবিই হচ্ছে জম্মু-কাশ্মিরের রাজ্যের মর্যাদা ও অবলুপ্ত ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জম্মু-কাশ্মিরের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, কারাবন্দীদের মুক্তি দান, মামলা প্রত্যাহার ও জম্মু-কাশ্মিরে আগামী দিনে বিধানসভার নির্বাচন। বৈঠকের ফলাফল ইতিবাচক বলা যায়। সরকার ৩৭০ ধারা পুনরুজ্জীবন ও অপরাপর দাবিগুলো মেনে কাশ্মিরের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে চায় (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ জুন ২০২১)।
ইতোমধ্যে ভারত পর্দার অন্তরালে তালেবানের একাংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। বার কয়েক বৈঠকও হয়েছে। আন্তর্জাতিক লবি ও বৈদেশিক মিত্রদের মাধ্যমে তালেবানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তালেবান কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আফগানিস্তানের মাটি কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আমরা বিদেশী যোদ্ধাদের আশ্রয় দেবো না বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিশ্চয়তা দিয়েছি। দেশের ভেতরে-বাইরে আমরা আর শত্রু চাই না।’ এতেও দিল্লির সাউথ ব্লক পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ সরকার গঠন করার পর তালেবানরা এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করবে, তাদের কট্টরপন্থী সদস্যদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বা আফগান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকার নৃগোষ্ঠীগুলো ভিনদেশী যোদ্ধাদের আশ্রয় দিলে তা তারা বন্ধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সংশয় রয়েছে। ভারতীয় নেতারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ক‚টনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। সাবেক ভারতীয় ক‚টনীতিক জিতেন্দ্র নাথ মিশ্র বিবিসিকে বলেন, ‘দিল্লির জন্য সহজ কোনো বিকল্প নেই; যা আছে তা হলো খারাপ বিকল্প বা আরো খারাপ বিকল্প।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের ক‚টনৈতিক দক্ষতা আছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক বাহিনী ও আশরাফ গনির ওপর অতিমাত্রায় আস্থা রাখা ভারতের জন্য শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত কিন্তু একা নয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ ভারতের মিত্র। মিত্রদের পাশ কাটিয়ে ভারত তালেবানকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি না সন্দেহ আছে। ত্রিপক্ষীয় ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তান যদি এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়, ভারতকে তখন মাশুল দিতে হবে। এমনটি মনে করেন ক‚টনীতি বিশেষজ্ঞরা। দেখা যাক, রাজনীতি ও ক‚টনীতির খেলা কতদূর গড়ায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com