ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্ব : ভূ-রাজনীতির বলি লেবানন!
ভূ-রাজনীতির বলি লেবানন - ছবি : সংগৃহীত
লেবানন পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ। এর উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া এবং দক্ষিণে ইসরাইল অবস্থিত, ভূমধ্যসাগরজুড়ে তার পশ্চিমে অবস্থিত সাইপ্রাস; ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা এবং আরবীয় অন্তর্দেশের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। ৭০ লাখ মানুষের বাসস্থান লেবাননের আয়তন ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার। এটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে একটি, যদিও লেবাননে সভ্যতার প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় ৭০০০ বছর আগের।
লেবাননে ৪০০ বছর উসমানীয় খেলাফতের শাসন চলার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে লুজান চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব হারায় তুর্কিরা। এরপর ফরাসি প্রটেক্টরেট রাজ্যে পরিণত হয় লেবানন। ১৯৪৩ সালে স্বাধীনতার পরও লেবাননে ফরাসি প্রভাব থেকে যায়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় লেবাননে। ১৯৪৮, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের তিন দফা আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে লেবাননে আশ্রয় নেন। বিগত দশকের শুরুতে আরব বসন্তের জের ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ১৭ লাখ সিরীয় লেবাননে আশ্রয় নেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর এ অস্থিরতা লেবাননের নিরাপত্তা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর নানামুখী প্রভাব ফেলে।
লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিদেশী পক্ষের মধ্যে ইসরাইল লেবাননে সবসময় অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাখতে চায়। দক্ষিণ লেবাননে শিয়া মিলিশিয়াদের হামলার মুখে একসময় ইসরাইলকে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। হিজবুল্লাহ লেবাননে প্রভাবশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর ইসরাইলের সাথে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে আলজিহাদ ও হামাসকে সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে হিজবুল্লাহ। এ কারণে ইসরাইল সবসময় লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অবদমিত করে রাখতে চায়।
অন্য দিকে ইরানের দেশের বাইরে প্রধান প্রক্সি মিত্রশক্তি হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি তৈরি ও এর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দেয় তেহরান। সিরিয়ার ইরান মিত্র আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তার পতনের উপক্রম হলে আসাদকে রক্ষায় গ্রাউন্ডে যুদ্ধ করে হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর এই ভূমিকা সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে গ্রুপটির গ্রহণযোগ্যতা কমালেও ইরানের সমর্থন অনেক বেড়ে যায়। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সব কর্মকাণ্ড ইরানকে অনুমোদন করতে দেখা যায়। হিজবুল্লাহর প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ইরান জ্বালানি সঙ্কটে পড়া লেবাননে এখন বাকিতে তেল সরবরাহ করে যাচ্ছে।
লেবাননে সুন্নি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একসময় সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রক প্রভাব ছিল। লেবাননের বড় বড় ধনী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা লেবাননের পাশাপাশি সৌদি আরবের নাগরিকত্বও পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিসহ প্রভাবশালী সুন্নি নেতাদের ব্যবসা বাণিজ্যি রয়েছে সৌদি আরবে। মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর নিজের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সৌদি আরবের ধনকুবেরদের হোটেলে আটকে রেখে অর্থ আদায়ের কৌশল নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সাদ হারিরিকেও আটকে রাখা হয় সৌদি আরবে। এ ঘটনা লেবাননে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরে সাদ হারিরিকে লেবাননে ফিরে যেতে দেয়া হলেও সৌদি আরব দেশটির রাজনীতির ওপর প্রভাব অনেকখানি হারিয়ে ফেলে।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যর্থ সৌদি প্রচেষ্টারও অবদান ছিল। সেটি হলো রিয়াদ চেষ্টা করেছে লেবাননের সরকারি সেনাবাহিনীকে দিয়ে হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে। লেবাননের বাস্তবতায় হিজবুল্লাহর সামরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থায় সৌদি আরব ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। বরং এটি করতে গিয়ে লেবাননে রিয়াদ নিজের রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়েছে।
এ দিকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ইহুদি রাষ্ট্রটির কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশীদারে পরিণত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবুধাবি লেবাননেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। লেবাননে অনেকেই বিশ্বাস করেন, বৈরুতের তেল ট্যাংকারে বিস্ফোরণের সাথে ইসরাইলের যোগসূত্র রয়েছে। এ কারণে এই নাশকতার ঘটনার কার্যকর কোনো তদন্তও হচ্ছে না। এখন ইসরাইলের সম্পূরক ভ‚মিকায় দেখা যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে।
ফ্রান্সও এখন লেবাননে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এ ব্যাপারে দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ উল্লেখ করেছিলেন, প্যারিস যদি লেবাননে সক্রিয় না হয় তাহলে সে স্থান পূরণে এগিয়ে যাবে তুরস্ক। ফ্রান্স অর্থনৈতিক সঙ্কটে আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগসূত্র রেখে কাজ করতে চাইছে।
লেবানন ৪০০ বছর ধরে তুর্কি খেলাফতের অধীনে থাকলেও কামাল আতাতুর্কের আরব থেকে বিচ্ছিন্নতার নীতির কারণে আরব দেশগুলোতে প্রভাব থাকেনি। ২০০২ সালে এরদোগানের নেতৃত্বে একেপি ক্ষমতায় এলে বৈদেশিক নীতি বেশ কিছুটা পাল্টে যায়। সিরিয়া আজারবাইজান লিবিয়া আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়ায় সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে আঙ্কারা। এই ভ‚মিকায় সাফল্য ও ব্যর্থতা মিশ্র ফল দেখা যায়। তবে ২০২৩ সালের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরদোগান অভ্যন্তরীণ বিষয়েই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। ফলে লেবানন সঙ্কটে তুরস্কের ভূমিকা সীমিত থাকছে বলেই মনে হয়।
লেবাননকে একসময় মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং বৈরুতকে বলা হতো আরবের প্যারিস। সোনালি ঐতিহ্যের দেশটি এখন যে পরিস্থিতির মুখে পড়েছে তার মূল কারণ প্রক্সি ওয়ার বা প্রভাব বিস্তারের খেলা। এক দিকে ইসরাইল অন্য দিকে ইরান কৌশল বাস্তবায়নে লেবাননকে কাজে লাগাতে চাইছে। তবে ইসরাইল যেখানে বিপর্যস্ত লেবাননের মধ্যে স্বার্থ খুঁজে পাচ্ছে, ইরান সেখানে হিজবুল্লাহকে নিয়ন্ত্রক আসনে রেখে লেবাননকে শক্তিশালী দেখতে চায়। সৌদি আরবও এখন নিজস্ব নিরাপত্তাকে আঞ্চলিক ইস্যুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে বড় সঙ্কট হয়ে দেখা দিচ্ছে আমিরাতের ইসরাইল স্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকা।