তালেবানের একাল সেকাল
তালেবান নেতৃবৃন্দ - ছবি সংগৃহীত
পশতু ভাষায় তালেবান অর্থ হলো ছাত্র।
১৯৯৪ সালে পাকিস্তানের সীমান্তে কান্দাহার (দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান) প্রদেশে মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের (১৯৫৯-২০১৩) হাতে এই সংগঠন গঠিত হয়েছিল।
৮০-এর দশকের শেষ দিকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয় বরণ করে আফগান ছাড়ে তখন আফগানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধে। ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে তাদের মধ্যে ওই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ওই সময়, প্রতিটি দলের বিশ্বাস ছিল যে দেশটি শাসন করার অধিকার কেবল তাদেরই। কে কোন এলাকা শাসন করবেন- তা নিয়েই মূলত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যার কারণে তাদের মধ্যে নৈতিক দুর্নীতি প্রকাশ পায়, নিরাপত্তার চূড়ান্ত বিঘ্ন ঘটে। তখন জনগণের নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার, স্থিতিশীলতা এবং এই লঙ্ঘন রোধ করার জন্যই একদল মাদরাসা ছাত্রদের মাধ্যমে এ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। তারা তাদের আমির হিসেবে মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল। তাদের প্রথম অভিযান হয়েছিল দু'জন বালিকাকে ভূমি দস্যুদের থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে।
তালেবান আন্দোলন পশতুন বা পশতুভাষীদের মাধ্যমে শুরু হলেও বর্তমানে গোটা আফগানে তাদের সদস্য ছড়িয়ে আছেন। ধারণা করা হয়, বর্তমানে তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি।
তালেবান একটি সুন্নি ইসলামী আন্দোলন যা হানাফি চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে। আন্দোলনের অনেক সদস্য দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় (ভারতের সাহারানপুরে অবস্থিত) পড়াশোনা করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে প্রভাবিত; যা তাদের শাসন শৈলীতে প্রতিফলিত হয়।
তালেবানদের শক্তিশালী কোনো সংগঠন নেই। এর একটি সুস্পষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো নেই, তার অভ্যন্তরীণ বিষয় ও কর্মসূচী নিয়ন্ত্রণকারী কোনো নিয়ম নেই, নেই বিশেষ কোনো কর্মসূচি , এমনকি সদস্য নিবন্ধনের জন্য সদস্যপদ কার্ডও বিতরণ করা হয়নি। তারা শুধু সরকারি বিভাগগুলো সক্রিয় করে মানুষের সেবা করতে চায়।
তবে তাদের একজন বিশ্বস্ত আমির বা কমান্ডার থাকেন। যার আইনগত অধিকার আছে, আমির ধর্মের লঙ্ঘন না করা পর্যন্ত তার আদেশ মানা ফরজ। তিনি প্রত্যেক রাজ্যে একজন গভর্নর নিয়োগ দেন। এবং একটি শূরা কাউন্সিলের মাধ্যমে তারা সকল বিষয়ের পরামর্শ করেন। যেখানে সকল তালেবান সদস্যই অংশগ্রহণ করতে পারেন। সিদ্ধান্ত দেন কমান্ডার। সেজন্যে কান্দাহারে তাদের একটি 'সেন্ট্রাল ইফতা হাউস' আছে।
কঠোরতা ও জীবনযাপনের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এবং ধর্মীয় পণ্ডিতদের প্রতি সম্মান, তাদের ধারণার প্রতি আন্তরিকতা এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম– তালেবানের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
তারা সশস্ত্র অবস্থানকে প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ হিসেবে জানে। তারা রাষ্ট্রের বিষয়-আশয় উত্থাপন করার জন্য একটি সংবিধান বা প্রবিধান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন মনে করে না বরং কুরআন এবং সুন্নাহ অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানেই তারা বিশ্বাসী। সেজন্যে তাদের শাসনামলে ইসলামি আইন প্রয়োগ করা হয়। হত্যা, ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি সকল অপরাধের শাস্তি দেয়া হয় কোরআনের হুকুম অনুযায়ী। তাছাড়া প্রত্যেক মুসলমানকেই ধর্ম মেনে চলতে হয়।
প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তালেবান সর্বপ্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। তারা ক্ষমতায় এসে সফলভাবে দুর্নীতি দমন ও গৃহযুদ্ধ নির্মূলে সক্ষম হয় এবং তাদের শাসিত অঞ্চলে সবাইকে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়। ২০০১ সনের ভেতরে তারা আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশ তাদের শাসনের আয়ত্বে আনে। আমেরিকা তাদের এই আন্দোলনকে মৌলবাদী ইসলামি শক্তি বলে আখ্যায়িত করে। ২০০১ সালে তাদের ক্ষমতা আমেরিকার হাতে চলে যাওয়ার পর তারা স্বাধীনতা ও দখলদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে পূর্ণোদ্দমে রণক্ষেত্রে নামে। তাদের নেতা মোল্লা ওমরের ভবিষ্যতবাণী ছিল- ২০ বছরের মাথায় বৈদেশিক শত্রুরা আফগান ছেড়ে পালাবে এবং পরে ১০০ বছর আফগানিদের হাতেই ক্ষমতা থাকবে। তালেবান তাদের কমান্ডারের কথায় বিশ্বাসী হয়ে মরণ জয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তাদের ভাষ্য- আল্লাহই আমাদেরকে সাহায্য করবেন।
তালেবান যেভাবে ক্ষমতায় এলো
২০১৩ সালে আফগানিস্তানে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা তৈরি হয়। তখন তালেবান কাতারে একটি অফিস খোলার ঘোষণা দেয়। তারপরও উভয়পক্ষের মধ্যকার অবিশ্বাস থেকেই যায়। সাথে সহিংসতাও অব্যাহত থাকে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে তালেবান স্বীকার করে, তাদের নেতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর কথা। যা তারা দুই বছর গোপন রেখেছিল।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সনে মোল্লা ওমর পাকিস্তানের একটি হাসপাতালে মারা যান। ২০১৫ সালের আগস্টে তালেবান জানায়, তারা মোল্লা মনসুর নামে এক নতুন নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসে মোল্লা মনসুর মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হলে তার জায়গায় তালেবানের নতুন নেতা হন হাইবাতুল্লাহ আখুন্দযাদা। এখন পর্যন্ত তিনিই তালেবানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
এ ঘটনার পাঁচ বছর পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়। এরপর তালেবান তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনে।
অতঃপর নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর সময় ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবানরা আফগানের দখল পূর্ণ ভাবে ফিরে পায়। ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর তালেবান বাহিনী এখন সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে।
তালেবানের লক্ষ্য হচ্ছে- দেশে স্থিতিশীলতা, শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। পশ্চিমা সৈন্যদের চলে যাওয়া, এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন শরিয়ত আইন বা ইসলামি আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি ও অন্যান্য