তালেবানের সামনে ৩ চ্যালেঞ্জ

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তালেবান - ছবি সংগৃহীত
তালেবান তথা ইসলামী আমিরাতের সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, তারা আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে যে সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে তা সাফল্যের সাথে শেষ করা। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা ২০ বছর যাদের সাথে লড়াই করেছে তাদেরও ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের ক্ষমার ক্যানভাসটা যে কত বড় তা তিনটি নাম উল্লেখ করলেই স্পষ্ট হয়। হামিদ কারজাই এবং আবদুল্লাহ আবদুল্লাহকে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা দিয়েছে, তাদের একজন হলেন তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গঠিত প্রথম সরকারের প্রেসিডেন্ট আর দ্বিতীয়জন হলেন ক্ষমতাচ্যুত আশরাফ গণি সরকারের দুই নাম্বার ব্যক্তিত্ব। তারা হেরাতের সাবেক গভর্নর ইসমাইল খানকে ক্ষমা করে দিয়ে তালেবানে যোগ দিতে অনুমোদনই করেনি তাকে ভবিষ্যৎ আফগান সরকারের অংশ করতে যাচ্ছে। অথচ এই খান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তালেবানের বিরুদ্ধে হেরাতে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি আর ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহকেও ক্ষমা করে দিয়ে তাদের প্রতি দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। আশরাফ গণির ভাইতো তালেবানে যোগ দিয়েছে। আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তালেবানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হলে এটি আরো স্পষ্ট হবে।
তালেবানের সামনে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো, গৃহবিবাদের অবসান ঘটানো। ২০০১-পূর্ববর্তী তালেবান আন্দোলন ছিল দেশটির জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ পশতুন প্রধান একটি আন্দোলন। এখনকার তালেবান হলো পুরো আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল তালেবান আন্দোলন। তাজিক উজবেক হাজারা তুর্কমেন তথা সব আফগান জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃস্থানীয়রা তালেবান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। গত ২০ বছরের আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট সরকারের সময় নারী শিক্ষা থেকে শুরু করে সমাজ উন্নয়নমূলক যেসব কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল তার কোনোটাই তালেবান বন্ধ করেনি। আফগানিস্তানের হাজার হাজার মানুষ আমেরিকা যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে ভিড় করছে। তালেবানের বক্তব্য হলো, যে অর্থনৈতিক দুর্গতি ও দারিদ্র্য বিগত দশকগুলোতে তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে উন্নত দেশে অভিবাসনের জন্য লোকজন এভাবে ভিড় করছে। এর সাথে তালেবানের সরকার গঠনের সম্পর্ক নেই ততটা। এর মধ্য দিয়ে এটাই বলা হচ্ছে যে, আমেরিকানরাই দেশ ছেড়ে যাওয়ার দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছে আফগানিস্তানে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা আফগানিস্তানের কেন্দ্র ও প্রাদেশিক পর্যায়ে চালু করতে পারলে ‘ইসলামী আমিরাত’ দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারবে।
তালেবানের সামনে তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি হলো, আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে সামাল দেয়া এবং সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি গতি তৈরি করা। আমাদের বিবেচনায় চ্যালেঞ্জটি তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়। আর এই চ্যালেঞ্জ জয় করে দেশটিতে স্থিতি এনে দিতে পারলে পশ্চিমা সভ্যতার দাপুটে অবস্থানে এটি শেষ পেরেকের মতো হবে।
আফগানিস্তানের অর্থনীতির আকার এখন ২২ বিলিয়ন ডলারের। প্রশ্ন হলো, দেশটিতে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতিশীল কার্যক্রম চালু করতে কতটা সক্ষম হবে নতুন সরকার? তারা কি পারবে উন্নয়ন সহায়তাকারীদের আস্থা অর্জন করতে এবং রাষ্ট্রের খনিজ সম্পদে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে সেটিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগাতে?
দুই দশক আগে আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা শাসন করত তখন অর্থনীতির আকার ছিল এখনকার এক-তৃতীয়াংশের মতো। সরকার চালানোর জন্য আশরাফ গণি প্রশাসনের যত টাকা প্রয়োজন হতো তার চেয়ে অনেক কম অর্র্থে তালেবানরা রাষ্ট্র চালাতে পারবে দুটি কারণে। প্রথমত, বিদায় হওয়া কাবুল সরকারের যে বিপুল অর্থ অপচয় ও দুর্নীতির মাধ্যমে ‘নেই’ হয়ে যেত, সে অবস্থা হবে না তালেবান প্রশাসনে। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে সেটি দেখা গেছে। অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করা গেলে প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। আফগান সেনাদের যে বেতন দেয়া হতো তার অর্ধেক পায় তালেবান মিলিশিয়ারা। ফলে ধারণা করা হয়, তিন বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে তালেবান সরকার টিকে যাবে। তালেবানরা রাষ্ট্রের পূর্ণ দখল নেয়ার আগেই তাদের হাতে এক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আয় হতো। এখন যদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তাদের পক্ষে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করা কঠিন হবে না। তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগে ঘাটে ঘাটে ‘ওয়ারলর্ড’দের চাঁদা দিতে হতো। এটি বন্ধ হওয়ার কারণে ব্যবসার খরচ অনেক কমে গেছে এবং আমদানীকৃত খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম কমে গেছে। এ অবস্থায় আফগানিস্তানের ভেতরে ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট’ প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ যদি শুরু করা যায় এবং সেই সাথে বিপুল খনিজসম্পদের উন্নয়ন ও আহরণ যদি আরম্ভ করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক সঙ্কট তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয়। তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের শেষ সময়ের পরামর্শ ছিল, আফগানিস্তান থেকে নিষিদ্ধ আফিম চাষের বিলুপ্তি ঘটানো। তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আফিম চাষ আগেই কমে গিয়েছিল। এটি তালেবান পুরোপুরি বন্ধ করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো একটি বড় উৎকণ্ঠা থেকে বেঁচে যাবে। ফলে তারা অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে রাখার মতো চূড়ান্ত ব্যবস্থা থেকে তাদের স্বার্থেই বিরত হতে পারে।
এর পরও সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে রাখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হলে বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তৈরির যে উদ্যোগ চীন, রাশিয়া নিচ্ছে তা পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এখন দেশটির সব প্রতিবেশীর কাম্য। চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান এবং মধ্য এশীয় দেশগুলো তাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থেই শান্তি চাচ্ছে। ফলে এই পথে না এসে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো তালেবান বৈরী শক্তিগুলোর খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না। আর এর মধ্যে চীন আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করার জন্য মুখিয়ে আছে। বেইজিং এই অঞ্চলে বাণিজ্য উন্নয়নের যে ‘হাব’ রুট অ্যান্ড বেল্ট উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি করতে চাইছে তার জন্য আফগানিস্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে মনে হয়, আফগানিস্তানে রক্তক্ষয় অধ্যায়ের হয়তোবা পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তালেবানরা মোল্লা ওমরের একটি ভবিষ্যৎ কথার প্রতি দৃঢভাবে আস্থা রাখে, সেটি হলো, দখলদারিত্বে ২০ বছর পূর্তির আগেই দখলদাররা বিদায় নিতে শুরু করবে আফগানিস্তান থেকে। এরপর শত বছরব্যাপী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ আফগানদের হাতে থাকবে।
mrkmmb@gmail.com