বাইডেনের তালেবান উত্থান পলিসি ভারতের জন্য একেবারেই অসহ্য
বাইডেনের তালেবান উত্থান পলিসি - ছবি সংগৃহীত
আমেরিকার এক পপুলার মিডিয়া হলো ‘এনপিআর’ রেডিও। এরই ওয়েবসাইট লিখছে, আমেরিকা নাকি ‘আফগানিস্তানে গণতন্ত্র এনে দিতে গিয়েছিল। তবে এটা করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত আমেরিকাতেই গণতন্ত্রের অভাব ঘটিয়ে ফেলেছিল, অজনপ্রিয় যুদ্ধ যেমনটা ঘটিয়ে থাকে।’ এ দেখি বিরাট এক আঁতলামো! ইদানীং আমেরিকান মিডিয়ার এমন লেখা দেখে মনে হয় তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে, তাই কথার আর ওজন থাকে না। কখন কী বলে ঠিক থাকছে না।
এ ছাড়া এ কথাটাও সত্য নয়। যেমন, বুশ দুই টার্মে ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথম টার্মে যদি ধরে নেই পাবলিক জোশে তিনি আফগানদের কড়া শাস্তি দেয়ার জন্য বোমা ফেলতে গিয়েছিলেন, মানে নাইন-ইলেভেনে টুইনটাওয়ারে হামলার শাস্তি দিচ্ছিলেন। প্রশ্ন উঠবে, তাহলে এর পরও যুদ্ধ চালু রাখতে ভোটাররা তাকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করলেন কেন? এর দায় তো তখন অবশ্যই (লোভী) ভোটারদেরও নয় কি? যারা দায়িত্ব নিতে চায়নি, বুশ কী করে দেশে টাকা আনছেন? আর বুশের পদক্ষেপ তাদের পক্ষে যাচ্ছে বলে তারা মেপেছিলেন ও আর উৎসাহ দিতে বুশকে আবার নির্বাচিত করে দিয়েছিলেন তাদের ওসব বৈষয়িক লাভ দিয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাদের বিচারে আমেরিকান সমাজে ‘কাজ-কাম’ আর ‘মানি সার্কুলেশন’ বেড়েছিল দেখেই তো তারা সিদ্ধান্তে গিয়েছিলেন... ‘কাজেই বুশকেই আবার জিতিয়ে দাও’। তাই তারা জিতিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যুদ্ধে আমেরিকান জনগোষ্ঠী ও অর্থনীতিকে জড়ানোর কারণে এই মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি পেয়েছিল- যেটা ছিল এক জবরদস্তি বৃদ্ধি। আর যুদ্ধ তো ঠিক কোনো ব্যবসা বা বাণিজ্য নয়। তাই যুদ্ধ শেষে কিছু রিটার্ন এলে আসতেও পারে, যার ওপর কেউ ভরসা করে থাকে না; তবু এলে সেটা বাড়তি লাভ বলে হাত পেতে চুপচাপ নিয়ে নেয়।
যুদ্ধ দেশকে বিশেষ কোনো সুবিধা (অ-মানিটারি সুবিধা) কখনো কখনো এনে দিতে পারে। যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সবার উপরে সাবধান থাকতে হয়, কোনো যুদ্ধের খরচ যেন দেশের বইবার সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি দাবি না করে বসে। সে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যুদ্ধ করেও টিকে গিয়েছিল। আমেরিকা ইউরোপ (এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ) ও
এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার ওপর একই গ্লোবাল কর্তৃত্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তান-ইরাকের যুদ্ধের ব্যয় ছিল লাগামছাড়া আর বিপুল খরচের তুলনায় রিটার্ন এমন বড় কিছু নয়। ইতোমধ্যেই যুদ্ধের সাত বছর পেরোতেই বেহিসাবি খরচের ভারে শুধু ‘আমেরিকান ইকোনমি’ নয় এর নেতৃত্বে ও সাথে থাকা ইউরোপসহ সারা গ্লোবাল ইকোনমিও মহামন্দার (২০০৮) কবলে পড়ে যায়। এভাবে আমেরিকান ব্যবসাদার ও ভোটার সবপক্ষেরই যুদ্ধের শখ মিটিয়ে দিয়েছিল। কারণ, গ্লোবাল মন্দার মধ্যে আর আফগান-ইরাক যুদ্ধও তো এক সাথে দুনিয়াতে কখনো চলতে পারেনি।
এর পরের ওবামা দু-টার্ম বা পরে ট্রাম্প- দু’জনেই তাদের কালের যুদ্ধের উল্টা- যুদ্ধের খরচ কমানোর নায়ক সাজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুখকর খুব কিছু হয়নি। আর বিবেচনাহীনভাবে যুদ্ধের দায় ফেলে পালিয়ে যাবেন- এই সস্তা শর্টকাট বেকুবির পথ নিয়েছিলেন ট্রাম্প। এমনকি চুক্তিও সম্পন্ন করেছিলেন একা ট্রাম্প নিজেই। ফলে তালেবান-চুক্তি করার মূল দায়ভার এককভাবে ট্রাম্পের। কিন্তু বাইডেন তা বাস্তবায়নে গেছেন বলে সব দায় এখন তিনি বাইডেনের ওপর চাপাচ্ছেন। এটাই বড় তামাশার।
আবার বাইডেন তালেবানদের ক্ষমতায় এনে নিজের প্রত্যাহার নিশ্চিত করবেন এমন বাস্তবায়ক প্রেসিডেন্ট হতে দায় নেয়া যে খুবই রিস্কি তা তারও অজানা ছিল না। কিন্তু তবু তিনি রাজি হয়েছিলেন; কারণ সেনা প্রত্যাহার তার সরকারের পরিচালনা খরচ কমাবে। কারণ, এখনকার আমেরিকা মানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাব, সেই প্রাচুর্যের আমেরিকা আজ আর নেই। কিন্তু তার অর্থ দরকার। কারণ, এ দিকে সোর্সের খবর না রেখে তিনি সারা ইউরোপ আর জাপানের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, চীনের পাল্টা ব্যাপক বিনিয়োগ সক্ষমতা, পাল্টা বেল্ট-রোড খাড়া করার সক্ষমতা হাজির করবেনই। এখন আফগান ফ্রন্ট থেকে সেনা প্রত্যাহার যদি বাইডেনকে কিছু বিনিয়োগ সক্ষমতার উৎস দেখায় যদিও শেষে এসবই গল্প হয়ে থেকে যাবে!
কিন্তু এর আগেই ট্রাম্প দান মারার চেষ্টা করেছেন। তিনিও আগামী নির্বাচনের হিসাব মোতাবেক এখন উল্টা বাইডেনের ওপর নিজেরই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের দায় চাপিয়ে নিজে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন। তাই বলা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্টরা মাত্রই আসলে দায়দায়িত্ব নিতে না চাওয়া অপরচুনিস্ট। আর বাইডেন ইতোমধ্যেই তালেবান ক্ষমতা দখল নিয়ে নেয়ায় নৈতিক দিক থেকে ঘায়েল হয়ে গেছেন; আমেরিকান মানসিক-নৈতিক দিক দুর্বল করে ফেলেছেন।
এ দিকে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের একগুঁয়ে নীতি বাইডেন চুপে অনুসরণ করে যেতে চেয়েছিলেন। চীনা পণ্যের আমেরিকায় আমদানিতে ট্রাম্পের বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করেছিলেন ২৫ শতাংশ। সেটা চালু রেখেছিলেন বাইডেন। সেটা এখন বাইডেনের ওপরই শাস্তি হিসেবে আসা শুরু করেছে। যেটা বাইডেন আগে বদল করতে যাননি, ‘কম দেশপ্রেমী’ হতে চাননি বলে হয়তো। কিন্তু সেটাই বাইডেনকে আমেরিকার আগামী মিডটার্ম নির্বাচনে পরাজয়ের স্বাদ দিতে উদ্যত হচ্ছে বলে খবর চাউর হচ্ছে। এটাও ট্রাম্পের এক ফায়দা।
ওদিকে বাইডেনের তালেবান উত্থান পলিসি ভারতের জন্য একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠেছে। মূল কারণ, পাকিস্তানের কাছে ভারতের নৈতিক পরাজয়। পাকিস্তানকে আর ‘জঙ্গি দেশ’ দেখাতে পারছে না। গত ২০ বছর ধরে প্রপাগান্ডায়- যেন পাকিস্তানই আফগানিস্তানের মা-বাপ; সব ইসলামী রাজনীতিক বা সশস্ত্র ধারার উৎস। গত ২০ বছর আমেরিকার যুদ্ধ যেন আফগানিস্তানের তালেবানসহ অন্যান্য সশস্ত্র গ্রæপের বিরুদ্ধে ছিল না, যেন আমেরিকার যুদ্ধ চলছিল (জঙ্গি) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমেরিকা যেন ভারতকে পাকিস্তানি ইসলামী জঙ্গি থেকে মুক্ত করতে লড়ছিল। বিশেষ করে এত দিনের আফগানিস্তান যেন ছিল নারীমুক্তির ঘাঁটি- এমন এক বিরাট কারখানা। আর এখন তালেবানদের আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল নয়- ‘পাকিস্তানের কারণে’ এই নারীমুক্তি কারখানা এখন যেন বন্ধ হয়ে যাবে। আফগান নারীরা বিভিন্ন দেশে আমেরিকান স্কলারশিপে যে পড়তে গিয়েছিল তা তালেবানদের দ্বারা নয়, পাকিস্তানের কারণে যেন বন্ধ হয়ে যাবে। এই ক্যাম্পেইন এতদিন কানে কানে বলার মতো করে চালিয়েছিল ভারত। বিশেষ করে ইউরোপের স্কানডিনেভিয়ান দেশগুলোর কথা বেশি এসেছে।
আর ভারত এ কাজ হাতে নিয়েছিল আরেক কারণে। রাশিয়া, চীন ও আমেরিকাকে সাথে নিয়ে তালেবানের ওপর শক্ত গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেমের মধ্যে তাদেরকে আসতে বাধ্য করার জন্য ত্রয়কা গঠন করেছিল যাতে এই তিন দেশের বিরল কমন ও শক্ত অবস্থান তালেবানদের দেখানো এবং মানতে চাপ দেয়া যে তাদের কমন অবস্থান ও বক্তব্য আবার নিরাপত্তা পরিষদেরই প্রস্তাব। এর বাইরের কারো বা কোনো প্রস্তাব নয়। আর এ কাজ বাস্তবায়ন করতেই তারা পাকিস্তানকে ত্রয়কার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল, যার নয়া নাম দিয়েছিল ‘ত্রয়কা প্লাস’। আর এতেই ভারতের সব পাকিস্তানবিরোধী প্রপাগান্ডা পানি হয়ে গিয়েছিল। এসবেরই প্রতিশোধ হিসেবে ভারত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আফগান নারীদের মধ্যে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে যে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ পাকিস্তান। পাকিস্তানই তালেবানদের পরিচালক। অতঃএব আফগান নারীরা যেন পাকিস্তানের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য জাতিসঙ্ঘে পিটিশন লিখে আবেদন জানায়। অথচ বাস্তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুনিয়ার কোনো সরকারের এমন কোনো অভিযোগই নেই। জাতিসঙ্ঘসহ কোনো ফোরামেই এমন কিছু নেই। কিন্তু ভারত ইউরোপের ক্যাম্পাসগুলোতে আফগান বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন পিটিশন স্বাক্ষর ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেই।
গতকালের আনন্দবাজার পত্রিকা এক মজার খবর দিয়েছে, ভারতীয় অ্যাম্বাসির সর্বশেষ দেড় শ’ জনের যে দলটা কাবুল থেকে ফেরত এসেছেন তারা ফিরে এসেছেন তালেবানের নিরাপত্তা সহায়তায়। তারা দেশে নিরাপদে ফিরতে চান বলে স্থানীয় তালেবান কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করলে কমান্ডার ভারতীয় অ্যাম্বাসির ২২টি গাড়ির কনভয়-বহর পাহারা দিয়ে এয়ারপোর্টে নিরাপদে পৌঁছে দেন।