কারা থাকতে পারেন তালেবান সরকারে?

রাহাত খান রাছি | Aug 22, 2021 09:09 am
কারা থাকতে পারেন তালেবান সরকারে?

কারা থাকতে পারেন তালেবান সরকারে? - ছবি : সংগৃহীত

 

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিস্ময় তালেবান। আর ভাবনার চেয়ে দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়েছে তালেবানের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। কিছু কিছু স্থানে তারা প্রতিরোধের মুখে পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সামনে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে আধুনিক সাজে সজ্জিত আফগান সেনাবাহিনী।

প্রবল জনসমর্থন নিয়ে তালেবান অবিশ্বাস্য গতিতে সারা আফগানিস্তানের সামরিক দখল বুঝে নিলেও তাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্র পরিচালনা। এক্ষেত্রে কেমন হতে পারে তাদের সরকার এ সম্পর্কিত একটি ধারণা নিম্নে আলোচনা করা হলো-

সরকারের ধরণ

ইসলামিক রিপাবলিক ইরানের অনুকরণ করে সরকার গঠন করতে পারে তালেবান। অবশ্য, তাদের সরকারের ধরন ও নাম হবে আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাত (Islamic Emirate of Afghanistan)।

এক্ষেত্রে আমির হবেন দেশটির সাংবিধানিক প্রধান ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী হবেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী এই নেতার হাতে হয়তো আইন ও প্রতিরক্ষার সার্বিক দায়িত্ব থাকতে পারে।

আর প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হবেন সরকারপ্রধান। তার অবস্থান অনেকটা ওয়েষ্ট মিনিষ্টার গভর্নমেন্টের প্রধানমন্ত্রীর মতো। তিনি প্রতিনিধি পরিষদ ও নাগরিকদের মধ্যে থেকে তার পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠন করবেন।

বর্তমান লয়া জিরগা শিগগিরই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে এবং লয়া জিরগার বদলে আফগানিস্তান পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী সামরিক কামান্ডার, রাজনৈতিক দল, আঞ্চলিক জাতি গোষ্ঠী, উপজাতীয় প্রতিনিধি নিয়ে একটি পর্ষদ গঠন করা হতে পারে, যেখানে আফগান প্রতিটি অঞ্চল ও জাতির প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার নাম মজলিশে শূরা হবার সম্ভাবনা বেশি।

সরকারের পদাধিকারী

হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা আমিরুল মুমেনিন পদ অলংকৃত করতে পারেন (যেখানে শিয়া ইরানের ইমামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ সুন্নি পদবি)। ইসলামী ধর্মশাস্ত্র ও আইন বিশেষজ্ঞ এই তালেবান শীর্ষ নেতা হবেন আফগানিস্তান আমিরাতের সাংবিধানিক ও আধ্যাত্মিক নেতা।

তার ডেপুটি হিসেবে থাকতে পারেন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন তরুণ নেতা ও তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের সন্তান মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব। তালেবানপ্রধান মোল্লা আখতার মনসুরের হত্যাকাণ্ড পরে তাকে তালেবানপ্রধান ঘোষণার উদ্যোগ নিলে তিনি নিজে তা প্রত্যাখ্যান করেন ও হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি তালেবানর উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে পরবর্তী আমিরুল মুমেনিন হিসাবে দেখতে চায় বেশীর ভাগ তালেবান মুজাহিদ।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তালেবান প্রাথমিকভাবে মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারের নাম ঘোষণা করেছে। তিনি হয়তো হবেন সরকারের কার্যকরী ও নির্বাহী প্রধান। মার্কিন আগ্রাসন-পরবর্তী তালেবানের পুনর্গঠন, দোহা আলোচনা ও পরবর্তী চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় পরিপক্ষতা ও অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে তিনি এক বিশাল অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। আফগান ঐতিহ্য আর মৌলিকত্বের সাথে স্মার্ট ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এক নতুন তালেবানের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করছে।

উপ-রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী (রাজনৈতিক সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ) হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। মার্কিন আগ্রাসন-পরবর্তী তালেবানের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এই সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। তাছাড়া দুঃসময়ে তালেবানদের কোষাধ্যক্ষ হিসাবে ও তিনি নিজের সফল ও স্বচ্ছ অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। এই মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে তার পিতা-ভাইসহ পরিবারের অনেক সদস্য শাহাদাতপ্রাপ্ত হন। এখানে উল্লেখ্য যে আফগান ভূখণ্ডে আমানতদার ও ব্যবসায়ী হিসেবে একটা ভালো সুপরিচিতি আছে এই হাক্কানি পরিবারের।

আইন ও বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে আবদুল হাকিম প্রথম পছন্দ। আখুন্দজাদার প্রিয়পাত্র এই তালেবান নেতা দোহা আলোচনার প্রারম্ভিক সময়ে প্রধান দায়িত্বশীল প্রধান ছিলেন।

পররাষ্ট্র বিষয়াবলী সংক্রান্ত দায়িত্ব পাবার সম্ভাবনা বেশি শের মোহাম্মদ আব্বাস স্টানিকজাইয়ের। তালেবান সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী স্টানিকজাই প্রায় এক দশক দোহায় বসবাস করেছেন। তিনি দলটির রাজনৈতিক দফতরের প্রধান হিসেবে ২০১৫ সালে নিযুক্ত হন। তিনি আফগান সরকারের সাথে একাধিক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সফরে তালেবানদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

তরুণ নেতা তালেবানের প্রধান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ ও দোহা রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র শাহীন সোহেল ও সরকারের অংশ হবার সম্ভাবনা আছে।

বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর হিসেবে আগের মতো সর্বক্ষেত্রে পশতুন প্রাধান্যের পরিবর্তে স্থানীয় জাতি গোষ্ঠীর নেতাদেরই প্রাধান্য দেয়া হবে, বিশেষ করে তাজিক, উজবেক ও হাজরা তালেবান সমর্থক নেতাদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সরকারের অংশীদারিত্ব আলোচনা

নতুন সরকারে তালেবান ছাড়া ও অংশ নিতে পারে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এ ব্যাপারে দোহা ও কাবুল উভয় স্থানেই আলোচনা চলছে। যেমন সরকার গঠন-সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিতে কাতারে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও হিজব-ই-ইসলামী নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, আফগানিস্তানের ন্যাশনাল সলিডারিটি পার্টির প্রধান প্রবীণ আফগান রাজনীতিবিদ সৈয়দ ইসহাক গাইলানি, কাবুল সিভিল সোসাইটির পরিচিত ব্যাক্তিত্ব আহমেদ ফরিদ, ফজল রাবি প্রমুখ।

তেমনই কাবুলে নতুন সরকার গঠন আলোচনায় ছোট ছোট দল ও গোষ্ঠীর সাথে জড়িত আছেন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ। এছাড়া এ আলোচনায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানি সমর্থকদেরও নিয়ে আসার কথা হচ্ছে ।

এ প্রসঙ্গে তালেবানদের মুখপাত্র শাহিন সোহেল বলেন, আফগানিস্তানে এখন যে সরকার গঠিত হবে তাতে শুধু তালেবান সদস্যরা থাকবেন না বরং সেখানে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, আফগানিস্তানের বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নয়া সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তালেবান ।

তুলনামূলক উদারপন্থী দর্শন

নতুন তালেবান সরকার আগের তালেবান সরকারের তুলনায় আধুনিক ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তারা তাদের নব্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বলয় বহুমুখীকরণে সচেষ্ট যাতে যথেষ্ট বাস্তবতা বিবেচনা করা হচ্ছে ।

এবারের কাবুল বিজয়ের পর তালেবান যথেষ্ট উদার পন্থার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। যেমন তারা ঘোষণা দিয়ে নারী শিক্ষা ও কর্মজীবী নারীর অধিকার মেনে নিচ্ছে, যা বিশাল ব্যাপার । সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এক নারী উপস্থাপকের কাছে জনৈক তালেবান নেতার সাক্ষাৎকার বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে।
যদি ও সমাজের যেকোনো স্তরে এই নারী স্বাধীনতার সামাজীকিকরণ তালেবান সরকারের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

তারা সাবেক আফগান সরকারের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে কাজে লাগানোর চিন্তা ভাবনা করছে । তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠা আফগান সেনা ও বিমানবাহিনীও আত্মীকরণের চিন্তা ভাবনা করছে যারা তুলনামূলক আধুনিক সামরিক জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী। তাছাড়া মাল এ গনিমত হিসেবে পাওয়া এইসব সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র চালনা করতে ও তাদের দরকার এই আফগান সামরিক (সেনা ও বিমান) বাহিনীকে।

সরকারের চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে তালেবানদের সরকার পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার একজন সুযোগ্য ও দক্ষ অর্থমন্ত্রী যিনি হবেন একাধারে অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে আটকে থাকা আফগান জনগণের টাকা পুনরুদ্ধার তার সামনে যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি তার সামনে রয়েছে আফগান ভূগর্ভস্থ সম্পদের সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ।

পশ্চিমা দেশগুলোর বিরাগভাজন তালেবান নেতৃত্বের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের প্রতিষ্ঠা করা। যদিও রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান বলয় সম্ভাব্য সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। তারপরও বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সমর্থন লাভ তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হবে বলেই মনে হচ্ছে।

আর আমার ধারণা, তালেবান সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সদা যুদ্ধংদেহী আফগান সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতিষ্ঠা। যুদ্ধবাজ জাতি গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শান্তিময় আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us