গল্পটা ভিন্ন
গল্পটা ভিন্ন - ছবি : সংগৃহীত
◾রাত পোহালেই বিয়ে, উত্তেজনায় ঘুম আসছে না নুসরাতের। চোখে এলেমেলো স্বপ্ন, মাথায় ঘুরপাক নানা ভাবনার। দীর্ঘ আট বছরের অপেক্ষা শেষে ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেতে যাচ্ছে। ভালোবাসার শুরুটা অবশ্য আবির ক্রিকেটার হবার আগেই। আজ যখন আবির লাল-সবুজের ওই জার্সিটা গায়ে জড়িয়েছে, তখন পরিবার থেকেও আর বাধা আসেনি।
খানিকটা আগেও আবির ফোন দিয়েছিল, বলল কাল ওর পছন্দের ফুল দিয়েই ঘরটা সাজাবে। হঠাৎ কী ভেবে যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠল নুসরাত। সেই ভাবনার মোহনায় চোখে ঘুম নেমে এলো; হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে!
◾দুই বন্ধু মিলে অপর বন্ধুকে বুঝাচ্ছে। ঠিক বোঝাচ্ছে না, বলতে হয় সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু বন্ধুটি শান্ত না হয়ে, একটু পর পরই ফুপিয়ে কেঁদে ওঠছে। বন্ধু দু'জন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার বলছে- দেখ আশিক, কান্নার কিছু নেই বন্ধু। বোঝার চেষ্টা করো,আজ হয়নি তাই বলে কি কাল হবে না? কাল যেন হয় সেই চেষ্টা কর, অবশ্যই হবে।
কাল আমরা চলে গেলেও তোকে ভুলব না, ওখানে গিয়ে তোর অপেক্ষায় থাকব; তুই আসবি বলে পথ চেয়ে থাকব। ইনশাআল্লাহ নেক্সট সিলেকশনে তুই টিকে যাবি, চলে আসবি আমাদের মাঝে; তোর স্বপ্নের বিকেএসপিতে। কেমন?
◾রফিক সাহেব দু'দিন আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছেন। আগামী কাল বেতনটা পেয়েই বাড়ির পথ ধরবেন। দুপুরে বাড়িতে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কার কী লাগবে? অবশ্য ছেলেটা আগেই বলে রেখেছিল আসার সময় যেন একটা ব্যাট নিয়ে আসে।
ছেলের বায়না কি না মেনে পারা যায়? অগত্যা কাল একবার মার্কেট হয়েই আসতে হবে। বউটাও অন্তঃসত্ত্বা, সাত মাস হতে চলল। তার জন্যও তো কিছু নেয়া চাই।
◾বাইশ গজের ওই ক্রিকেটারদের কে না চেনে? চেনে সংশ্লিষ্ট অনেককেই। কিন্তু মাঠের ওই বলবয়দের ক'জন চেনে? তাদের গল্প কি কখনো কাগজে ছাপে?
তেমনি এক বলবয় রাশেদ, তার বুড়ো বাবাটার জন্য শেষ বয়সে কিছু করতে চাচ্ছে; চাচ্ছে বাবাকে হজে পাঠাতে। গত কয়েক বছরে সামান্য আয় থেকে কিছু কিছু করে খানিকটা অর্থ জমিয়েছে। সে স্বপ্ন পূরণে আগামীকাল হজ্ব ক্যাম্পের দিকে পা বাড়াবেন বাবাকে নিয়ে৷
◾আজ ১২ বছর হতে চলল শাকিলের বাবা মারা গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারাও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। দুই সন্তানের মুখে আহার জোগাতে শাকিলের মাকে ঘরে ঘরে কাজ করতে হয়েছে, যদিও মাঝে কিছু দিন গার্মেন্টসে ছিল। ওই সময়ে শাকিলের বোন রাহিমারও বিয়ে দিয়েছেন।
আজ চার দিন হতে চলল মায়ের খুব জ্বর। পাড়ার ডাক্তার ওষুধ দিলেও সারেনি। মনে হচ্ছে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু হাতে তো পয়সা নেই, এখন উপায়? তখনই পাশের বাড়ির রাকিব ডাক দিয়ে বলল- ওই শাকিল! কাল খেলতে যাবি? কিছু টাকা পাওয়া যাইব।
◾রিক্সাচালক মোসলেম আলী আজ রাতেই কোথায় যেন শুনলেন কাল বাংলাদেশের খেলা। দুই চোখ তার খুশিতে ঝলমল করে উঠল। জীবন নামক এক বাস্তবতাকে রিক্সার প্যাডেলে টানতে টানতেই তার সময় যায়, সেখানে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার মতো বিলাসিতা পূরণের সুযোগ কই?
তবুও, ঠিক করলেন এবার স্টেডিয়ামে যাবেন। ওই বাঘেদের অর্জনে গর্জন দিয়ে উঠবেন। সাকিব, তামিমদের নিজের চোখে দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন। তবে তো কাল সকালের বাস ধরতে হবে...
__এমনই নানা ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নে শেষ হলো রাতটা। যথারীতি রফিক সাহেব ছেলের জন্য ব্যাটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে বাড়ির পথ ধরলেন। উঠলেন সাদিয়া পরিবহনের বাসটায়। উঠে চমকে গেলেন গাউস আলিকে দেখে। গাউস আলি আর রফিক সাহেবের এলাকা পাশাপাশি, ফলে উভয়েই উভয়কে চেনেন। যদিও, গাউস আলির স্বভাব সম্পর্কে রফিক সাহেব অবগত তবুও তার পাশেই গিয়ে বসলেন। উদ্দেশ্য, আলাপ-আলোচনা করে সময় কাটানো।
বাস ছেড়ে দিবে তখনই দৌড়ে এসে বাসে উঠলেন সেই রিকশাচালক মোসলেম। লক্ষ্য বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাওয়া। বাসে ফ্যানের বাতাসে বসে যাবার সাধ্যি তার নেই, পকেটের দিকে তাকিয়ে ওই মুড়ির টিনের চারকোনায় বন্দি হয়ে, এক পাশে ঝেঁকে বসেছে। পয়সা বাঁচাতে হবে, নয়তো টিকিট কেনা হবে না।
সামনের স্টপে বাস থামতেই বিকেএসপিতে যাবার উদ্দেশ্যে বাসে উঠল ওই দুই বন্ধু। বন্ধুদের বিদায় জানাতে স্টপে এসেছিল আরেক বন্ধু আশিকও। বাস ছুটে চলছে, আশিক এখনো হাত নেড়েই যাচ্ছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রুও হয়তো গড়িয়ে পড়ছিল।
এক জায়গায় একজন নামবে বলে বাস থামাতেই হঠাৎই হৈহল্লা করে ৭/৮ জন বাসে উঠে গেল। সিট না পাওয়ায় দাঁড়িয়েই আছে ওরা সবাই। তাদের মাঝে সেই শাকিলও আছে। মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে পাশের জেলায় খেপ খেলতে যাচ্ছে সে। আনমনে ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা জায়গাটায়।
অপরদিকে বিয়ের সাজে আবির তার গাড়ি নিয়ে ছুটে চলছে নুসরাতের বাড়ি পানে। সামনের ব্রিজটা পার হলেই ঘণ্টাখানেকের রাস্তা মাত্র। নুসরাত হয়তো এতক্ষণে বউ সেজে তার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে! এমন সময় আবির ভাবল, একটা কল দিয়ে দেখি ও কী করছে?
এই ভেবে যেই না ফোনটা বের করতে যাবেন ঠিক তখনই কী যেন ঘটে গেলো, আবিরের পৃথিবী ঘোলাটে হয়ে এলো। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, সামনে থেকে ছুটে আসা বাসটা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার গাড়িতে আঘাত করেছে। চিৎকারটা আর মুখ থেকে বের হতে পারেনি...
নিয়ন্ত্রণহীন বাসটা আবিরের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজের রেলিং ভেঙে ততক্ষণে গভীর নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। দুই-একজনকে ছিটকে পড়তেও দেখা গেলো বাস থেকে।
▶ঘটনার তিন বছর পর......
রফিক সাহেবের ওই ছেলেটা আজ বিকেএসপিতে এসেছে ট্রায়াল দিতে। তবে বাবার হাত ধরে আসেনি; এসেছে দাদা ভাইয়ের হাত ধরে। হঠাৎ ওই দূরে চোখ গেল দাদা ভাইয়ের, দেখলেন একটা ছেলে অনবরত অনুশীলন করে যাচ্ছে। মনে মনে বললেন, ছেলেটা একদিন অনেক বড় হবে।
কিন্তু দাদা ভাই কি জানত পেছনের গল্পটা? তিন বছর আগে যে ছেলেটা বিকেএসপির ট্রায়ালে সফল হতে না পেরে কেঁদেছিল, আর তার বন্ধুরা সুযোগ পেয়েছিল সেদিন বিকেএসপিতে। আজ প্রিয় বন্ধুরা তাকে একা ফেলে পাড়ি দিয়েছে অসীম শূন্যতায়। বিকেএসপিতে পৌছুতে পারেনি ওরা; স্বপ্ন তলিয়ে গিয়েছিল নদীর জলে৷ আজ তাকে যে বড় হতেই হবে, নিজের জন্য নয়; প্রিয় বন্ধুদের জন্যে।
তবে শাকিল এখনো বন্ধুদের ভুলতে পারে না। সে ছাড়া বাসে থাকা তার সকল বন্ধু আজ আঁধার কবরে। তার মাও যে চলে গেছে মাসখানেকের ব্যবধানে। সেদিনের পর শাকিল আর কখনোই ব্যাট ছুঁয়ে দেখেনি। ব্যাট বল দেখা মাত্রই ঠুকরে কেঁদে উঠে সে, হাহাকার করে হৃদয়। হায়! বন্ধুরা কোথায়...
বলবয় রাশেদ ও তার বাবা সেদিন বেঁচে গেলেও পঙ্গু জীবন মেনে নিতে হয়েছে রাশেদকে। যদিও পা ঠিক হবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছে না। বিসিবির কাছে চিঠির পর চিঠি দিয়েও তেমন সাড়া পায়নি। শেষ ভরসায়, শেষ চিঠিটা লিখছে সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশনের ঠিকানায়। অবশ্য, এক বন্ধু কথা দিয়েছে, মাশরাফীর কাছে ওর কথা খুলে বলবে সে।
রিকশাচালক মোসলেম বেঁচে আছে। এখন তার ঠিকানা স্টেডিয়াম চত্বরেই। রিকশা চালাতে পারেন নহ, পা দুটো নেই বলে। আজ তার পরিচয় ভিখিরি! তার সঙ্গী বাসের আরেক যাত্রী আকবর আলিও। তবে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা কমেনি আজো। বাঘেদের খেলার দিনে যেভাবেই হোক একটা টিকিট কিনে অর্জনে গর্জন দিতে অকুতোভয় সে।
আর আবির? আবির আজও ক্রিকেট খেলে। বাইশ গজ আবারো দাপিয়ে বেড়ায়। তবে,আজ আর সাকিব, তামিম, মুশফিকের সাথে নয়; আজ সে ক্রিকেট খেলে জাতীয় হুইলচেয়ার দলের হয়ে। অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেও বাঁ পা আর পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তাই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা থমকে দাঁড়ায় মাত্র দু-দুটো ম্যাচে। অবশ্য, নুসরাত ওর পাশে আছে আজও। হয় আবারো ভালোবাসার জয়।
* গল্পটা হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এমন গল্প যে বাস্তবে নেই তাও বলা যায় না। হয়তো, একসাথের চরিত্র গলো হয়তো নেই। কিন্তু অসংখ্য নুসরাত, আবির, আশিক, মোসলেম, কিংবা শাকিলরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তরে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য জীবন; অগণিত স্বপ্ন!