তালেবানের বিজয়ে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে চীন ও পাকিস্তান
তালেবানের বিজয় - ছবি : সংগৃহীত
তালেবানের বিজয়ের পেছনে তাদের বীরত্ব, যুদ্ধ-কৌশল, দেশপ্রেম এবং আল্লাহ প্রদত্ত ভৌগোলিক সুবিধার পাশাপাশি রাশিয়া-ইরান-চীনসহ আরো অনেক দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। যুদ্ধকালীন এসব সহযোগিতা নিয়ে কানাঘুষা হতো বটে- কিন্তু যুদ্ধের শেষপ্রান্তে তালেবান যখন বিজয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ঠিক সেই সময়ে তাদের সাথে চীনের দহরম মহরম বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে। সবাই ধারণা করছেন, অনাগত দিনে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে চীন হবে তাদের কৌশলগত প্রধান অংশীদার। এর ফলে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও পাকিস্তান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে ভারত- তারপর মার্কিনিরা এবং শেষমেশ রাশিয়া। বিপদে পড়বে মিসর ও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত। ইরান-তুরস্ক এবং বাংলাদেশ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
তালেবান শাসকরা যদি আফগানিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতা চীনের সহযোগিতায় পাকাপোক্ত করে ফেলতে পারে তবে প্রথম চার-পাঁচ বছর ধরে উল্লিখিত সমীকরণেই যে বিশ্ব রাজনীতি আবর্তিত হবে তা রাজনীতির সাধারণ বিশ্লেষকও বলে দিতে পারেন। কিন্তু তালেবানের বিজয়ের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে যে প্রাকৃতিক প্রতিশোধ শুরু হয়ে যাবে তা সবার আগে ইউরোপ-আমেরিকাকে ভোগাতে পারে। আলোচনার শুরুতেই প্রাকৃতিক প্রতিশোধ সম্পর্কে বলছিলাম। চীনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই জাতিটি সুদীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা জাতিগোষ্ঠী দ্বারা নানাভাবে জুলুম নির্যাতন ও নাজেহালের শিকার হয়েছে। প্রকৃতির দয়ায় পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। ফলে চীন তার সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব দিয়ে পশ্চিমা দুনিয়াকে যেভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে তা যদি অনাগত দিনে আরো বেড়ে যায় তবে অনেক দেশের মানচিত্রই পাল্টে যেতে পারে। চীন সাম্প্রতিক সময়ে যা করছে তার বেশির ভাগই অর্থনীতির জোরে করছে। ফলে তাদের দ্বারা সাধারণত যুদ্ধময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে না। অন্য দিকে উইঘুর মুসিলমদের সাথে তারা সঠিক ব্যবহার করছে না। এ দিকে মিয়ানমার সরকার আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে চীনের আনুকূল্য বন্ধ হলে তা তারা করতে পারত না।
আমরা সবাই জানি, উইঘুর মুসলিমরা হাজার বছর ধরে মধ্য এশিয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে যারা ঐতিহ্যগতভাবে মধ্য-এশিয়া অথবা পারস্যের মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিলেন। ইতিহাসের একটা সময়ে তারা আটোমানদের দ্বারাও শাসিত হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উইঘুর সম্প্রদায়ের একটি অংশ ভৌগোলিকভাবে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা হতে বাধ্য হয়। বাকিরা কমিউনিস্ট সোভিয়েত সরকারের কবলে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কাজিকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, কিরঘিজস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমরাই ওই সব দেশের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে পড়ে। এই কারণে চীন সরকার তাদের দেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ জিনজিয়াং প্রদেশটি চীনের সবচেয়ে দুর্গম এবং সবচেয়ে বড় প্রদেশ যেটির চার সীমান্তে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো রয়েছে। মধ্য এশিয়ার উইঘুর সম্প্রদায়ের কোটি কোটি মুসলমান চীনে বসবাসরত তাদের বংশীয় লোকদের ব্যাপারে সংবেদনশীল। চীন যদি গায়ের জোরে কিছু করতে যায় তবে জনমত উইঘুরদের পক্ষে ঝুঁকেবে। সেটি হবে আমেরিকা-রাশিয়াসহ চীন-বিরোধী পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি সুযোগ।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য