মুসলিম হয়ে যেভাবে হালাকু খানকে রুখে দিয়েছিলেন বার্কে খান

বার্কে খান - ছবি : সংগৃহীত
পারস্য দেশে মার্কসেস নামে বিখ্যাত এক সম্রাট ছিলেন। তার পিতা মহান দারায়ুস নামে ইতিহাসে সমধিক পরিচিত। প্রাচীন দুনিয়া তো বটেই এমনকি সর্বকালের ইতিহাসে সম্রাট দারায়ুসের মতো অতবড় সুসংগঠিত সাম্রাজ্য অন্য কোনো সম্রাট প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। দারায়ুসের মৃত্যুর পর তার সন্তান প্রথম মার্কসেস ৪৮৬ খ্রি: পূর্বাব্দের অক্টোবর মাসে সিংহাসনে বসেন। এর তিন বছর পর তিনি গ্রিস বিজয়ের জন্য দুনিয়ার সর্বকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। হিরোডোটাসের বর্ণনা মতে, প্রায় ৫৩ লাখ সৈনিক এবং অন্যান্য লোকজনসহ প্রায় সোয়া কোটি লোকের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি পুরো গ্রিস তছনছ করেন এবং তৎকালীন দুনিয়ার এক নম্বর কসমোপলিটান নগরী এথেন্স ধ্বংস করেন।
উল্লিখিত ঘটনার মাত্র ১৫৩ বছর পর অর্থাৎ ৩৩০ খ্রি: পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসকে পরাজিত করে রাজধানী পার্সিপোলিস দখল করেন যা ছিল তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমকপূর্ণ মহানগরী। আলেকজান্ডার পুরো শহরে আগুন লাগিয়ে সম্রাট প্রথম দারায়ুস ও সম্রাট প্রথম মার্কসেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্যের গর্বের ধন এই মহানগরীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। মার্কসেস যেভাবে এথেন্স ধ্বংস করেছিলেন তাতে পরবর্তী গ্রিক সম্রাটরা নগরীটি ধাপে ধাপে পুনঃনির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আলেকজান্ডার পার্সিপোলিসকে এমনভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন যা আর কখনো পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়নি।
পার্সিপোলিসের মতো আরেকটি বিখ্যাত শহরের নাম ছিল গুরগঞ্জ। মধ্যযুগের মিসরীয় মামলুকরা যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তা বর্তমানকালের ইরান-মিসর-সমগ্র মধ্য এশিয়া-আফগানিস্তান এবং চীনের বিরাট অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই বংশের বাদশাহ, যার উপাধি ছিল শাহ তারা- সমসাময়িক দুনিয়ার অন্য কোনো বাদশাহকে নিজেদের কর্মচারী হিসেবে ধ্যানজ্ঞান করতেন। খাওরেজম শাহ দ্বিতীয় মোহাম্মদের সাথে মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খানের বিরোধ বেধে যায় মূলত খাওরেজম শাহের একজন ক্রীতদাসের বেঈমানির কারণে। ফলে প্রায় আট লাখ সৈন্য নিয়ে চেঙ্গিস খান বিশাল এই সাম্রাজ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে প্রায় দেড় কোটি লোককে হত্যা করেন। এরপর তিনি রাজধানী গুরগঞ্জকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যার অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
উপরোক্ত ঘটনার প্রাকৃতিক প্রতিশোধ কিভাবে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করব। প্রথমত, চেঙ্গিস খানের রাজধানী ছিল কারাকোরাম, যার পরিণতি গুরগঞ্জের চেয়েও ভয়াবহ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, খাওরেজম সাম্রাজ্য আক্রমণকালে তার দুই আত্মীয় বার্কে খান এবং হালাকু খানের মধ্যে যে সঙ্ঘাত দেখা দেয় তার ফলে তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে যায়। বার্কে খান মধ্য এশিয়ার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য দিকে হালাকু খান বাগদাদের মুসলিম খিলাফত ধ্বংস করার পর আজকের ইরাক-ইরানের পুরো অংশ এবং তুরস্কের কিয়দংশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হালাকুর সাথে বিরোধিতার একপর্যায়ে বার্কে খান বুঝলেন যে, স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য ছাড়া হালাকুর মোকাবেলা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি তার দলবল নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।
বার্কে খানের ইসলাম গ্রহণের খবরে হালাকু খুশি হলেন এবং মনে করলেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় মোঙ্গল শাসক বা গ্র্যান্ড খানের সহযোগিতা নিয়ে বার্কে খানকে দমন করবেন। কিন্তু বাস্তবে পুরো পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে চলে গেল। কারণ বেজিং-এ প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রধান খান মঙ্গু এবং তারপরে কুবলাই উভয় সম্রাটই কোনো ধর্মের ব্যাপারে দুর্বল ছিলেন না কিংবা ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের কথা মাথায় রেখে হালাকু খান যখন বার্কে খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তখন যুদ্ধের ময়দানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। বার্কে খানের পক্ষে মোঙ্গল বাহিনী ছাড়াও খাওরেজম শাহের সেনাবাহিনীতে কাজ করত এমন অভিজ্ঞ মুসলিম যোদ্ধারা দলে দলে যোগদান করল। ফলে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে হালাকু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পারস্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন!
বার্কে খানের সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বেজিংয়ের কাছে হালাকুর গুরুত্ব কমে গেল। এ অবস্থায় তিনি তার বিজিত এলাকায় টিকে থাকার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতা শুরু করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীরা সদলবলে মুসলিম হয়ে গেলেন এবং নিজেদের মোঙ্গল পরিচয় কবর দিয়ে ইলখানী পরিচয় ধারণ করলেন। এর ফলে বার্কে খানের বংশধর ও হালাকু খানের বংশধররা নির্বিবাদে বহু বছর রাজত্ব করতে থাকেন। এমনকি-চেঙ্গিস খান প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পরও বার্কে খান ও হালাকু খানের বংশধরেরা মধ্য ও পারস্যে নির্বিবাদে রাজত্ব করেছিল বহু দিন।