তালেবানবিরোধী বিক্ষোভের নেপথ্যে কারা?
তালেবানবিরোধী বিক্ষোভের নেপথ্যে কারা? - ছবি : সংগৃহীত
জালালাবাদসহ পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি শহরে জাতীয় পতাকা নিয়ে বুধবার তালেবানবিরোধী বিক্ষোভে অন্তত দুজন নিহত হলেও পরদিনই বৃহস্পতিবার রাজধানী কাবুলেও একই ধরনের মিছিল হয়েছে।
আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৯ আগস্ট। এই উপলক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে কাবুলের মিছিলে গুলি না চালালেও দ্রুত তা ছত্রভঙ্গ করে দেয় তালেবান যোদ্ধারা।
তবে পূর্বাঞ্চলীয় শহর আসাদাবাদে স্বাধীনতা দিবসের এক জমায়েতে লোকজন জাতীয় পতাকা ওড়ালে তালেবান গুলি চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টর্স।
জাতীয় পতাকা সরিয়ে সেখানে তালেবানের সাদা-কালো পতাকা উঠিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় এই বিক্ষোভের মাত্রা তেমন কিছু না হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু আফগান সোচ্চার হয়েছেন।
পাশাপাশি, কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়া আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ তার গোপন আস্তানা থেকে ঘোষণা করেছেন দেশের সংবিধান অনুযায়ী তিনিই এখন আফগানিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্ট এবং তিনি তালেবানের সরকার মানবেন না।
সালেহ, যিনি একসময় আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন, তালেবানের বিরুদ্ধে জোট তৈরি করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার সাথে রয়েছেন পরলোকগত তালেবান বিরোধী কিংবদন্তী তাজিক নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদ এবং সাবেক আফগান সেনা প্রধান ইয়াসিন জিয়া।
টুইটারে এক পোস্টে আমরুল্লাহ সালেহ জাতীয় পতাকা নিয়ে এসব মিছিলের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন, 'যারা জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিবাদ করছে তাদের প্রতি স্যালুট।'
ধারণা করা হচ্ছে সালেহ এবং তার সহযোগীরা পরলোকগত আহমেদ শাহ মাসুদের দুর্গ হিসাবে পরিচিতি উত্তরের পাঞ্জশির উপত্যকায় রয়েছেন।
কাবুলের উত্তরে জাতিগত তাজিক অধ্যুষিত দুর্গম এই জায়গাটি ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত বিরোধী এবং পরে ৯০-এর দেশকে তালেবানবিরোধী প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখনো অঞ্চলটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে নেই।
শহরে তালেবান বিরোধিতা
কিন্তু গত দুদিনে কয়েকটি শহরে সাহস করে কিছু মানুষ যে তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তা কতটা ছড়াতে পারে? কজন আফগান রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে হুমকি দিচ্ছেন তালেবানের জন্য তা কতটা উদ্বেগের?
ইসলামাবাদে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আমির রানা বলছেন, আফগানিস্তানের বড় শহরগুলোতে তালেবানবিরোধী যে মনোভাব রয়েছে, গত দুদিনের জাতীয় পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ তারই প্রতিফলন।
'তালেবান এত দ্রুত সব কব্জা করে নেবে শহুরে আফগানরা তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বড় বড় শহরে প্রচুর আবেগ ও ক্রোধ। ঘটনাচক্রে ১৯ আগস্ট আফগান স্বাধীনতা দিবস। ফলে অনেকে তা চেপে রাখতে পারছে না,' বিবিসি বাংলাকে বলেন পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব পিস স্টাডিজের পরিচালক মি. রানা।
এই ক্ষোভ কতটা ছড়াতে পারে? রানা বলেন, 'বলা মুশকিল কারণ শক্তি এখন তালেবানের হাতে এবং কড়া হাতে এই ক্ষোভ দমনের চেষ্টা তারা করবে এবং করছে।'
কিন্তু, তিনি বলেন, জাতীয় পতাকা শহুরে আফগানদের জন্য আবেগের একটি ইস্যু এবং ভবিষ্যৎ আফগান সরকারকে এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ সরকারে হামিদ কারজাই এবং ড. আব্দাল্লাহ আব্দাল্লাহ‘র মত রাজনীতিকরা যদি জায়গা পান তাহলে শহরাঞ্চলে প্রবল তালেবান বিরোধিতা এবং তালেবানকে নিয়ে শঙ্কা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
আমরুল্লাহ সালেহ কতটা হুমকি
কিন্তু তালেবান বিরোধী প্রতিরোধের যে হুমকি সাবেক আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ দিচ্ছেন তা কতটা হালে পানি পেতে পারে?
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন তালেবানের এখন যে শক্তি তাতে মি সালেহ বা তার হুমকিকে তাদের গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ নেই।
তাছাড়া, ৯০ এর দশকে যখন পাঞ্জশির কেন্দ্র করে নর্দার্ন অ্যাল্যায়ান্স নামে তালেবানবিরোধী যে সামরিক জোট গড়ে উঠেছিল তখনকার সাথে বর্তমানের বাস্তবতার অনেক ফারাক। ওই সময় তালেবানবিরোধী নেতারা উত্তরের সীমান্ত পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে লড়াইয়ের জন্য সরবরাহ পেতে তাদের অনেক সুবিধা হতো।
কিন্তু এখন পাঞ্জশির উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও উত্তরের প্রধান প্রধান শহর এবং সীমান্ত এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। ঐ সব এলাকার বহু জাতিগত তাজিক এবং উজবেক গোষ্ঠী নেতা কাবুলের সরকারের ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে গত বছরগুলোতে তালেবানে যোগ দিয়েছেন।
তাছাড়া, সালেহ এবং তার সহযোগীদের হাতে শক্তিই বা কত? সাবেক আফগান কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে নিই ইয়র্ক টাইমস বলছে, পাঞ্জশির উপত্যকায় তালেবানবিরোধী বড় জোর ২,০০০ থেকে ২,৫০০ যোদ্ধা আছে এবং তাদের হাতে সাধারণ হালকা রাইফেল ছাড়া তেমন কোনো অস্ত্র নেই।
পাশাপাশি, আহমেদ শাহ মাসুদের যে সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল আমরুল্লাহ সালেহ বা মাসুদের ছেলের তা নেই। বিভিন্ন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এমন সব খবর বেরুচ্ছে যে সালেহর সাথে কোনো জোট তৈরির সম্ভাবনা অস্বীকার করেছেন আহমেদ মাসুদ।
তালেবানের বাস্তবতা
সবেচেয়ে বড় কথা, বলেন আমির রানা, এই মুহূর্তে আমরুল্লাহ সালেহ‘র পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
'পশ্চিমারা ছাড়াও প্রতিবেশী সবগুলো দেশ এখন তালেবানের বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। তারা এখন মানবাধিকার, নারী অধিকার এবং সন্ত্রাস বন্ধ নিয়ে তালেবানের সাথে দেন-দরবার করছে। এ সময় কোনো দেশই তালেবান বিরোধী কোনো তৎপরতা উস্কে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইবে না,' বলেন রানা।
এমনকি তালেবানের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পাকিস্তানও তালেবানের ওপর চাপ দিচ্ছে সরকারে তালেবান ছাড়াও অন্য রাজনীতিক এবং পশতুন ছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখতে হবে। এ সপ্তাহের প্রথম দিকে সাবেক নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ইসলামাবাদ সফর করে গেছেন। পাকিস্তানের সরকার এবং সেনা কর্মকর্তাদের সাথে তারা কাবুলে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলেছেন।
রানা বলেন, 'সাধারণ যে ধারণা পাকিস্তান তার উল্টোটা করছে। পাকিস্তান কাবুলে এমন কোনো সরকার চাইছে না যেখানে শুধু তালেবান থাকুক। কারণ, পাকিস্তান মনে করে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার না থাকলে আফগানিস্তানে দ্রুত আবারো অরাজকতা শুরু হবে।'
পাকিস্তান এ কারণে তালেবানকে কোনো স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে না। একটি দেশও দেয়নি।
পাকিস্তান ছাড়াও যে দেশগুলোর স্বীকৃতি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তালেবানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ – যেমন চীন, রাশিয়া, ইরান তুরস্ক- তারাও প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সরকারের জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।
আমরুল্লাহ সালেহর মতো তালেবানবিরোধী আফগান নেতা ভবিষ্যতে কতটা সুবিধা করতে পারবেন অথবা ৯০-এর দশকের মতো তালেবানের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ কোনো সামরিক প্রতিরোধ মাথাচাড়া দেবে কিনা– তা অনেকটাই নির্ভর করছে কাবুলে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে তালেবান কতটা ছাড় দেয় তার ওপর।
সূত্র : বিবিসি