মোদিবিরোধী জোট : মমতার সামনে নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ

হাসিবুর রহমান | Aug 18, 2021 06:37 pm
মমতা বন্দোপাধ্যায়

মমতা বন্দোপাধ্যায় - ছবি সংগৃহীত

 

রাজনীতির ময়দান কখনো খালি পড়ে থাকে না। অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক, শক্তি-সামর্থ্যে যতই ফারাক থাকুক- মাঠ থাকলে তাতে কেউ না কেউ খেলতে আসবেই। ক্ষমতার রশি টানাটানির খেলায় এখানে লোকের অভাব পড়ে না কখনো।

চৌদ্দর পড়ে উনিশে যখন মোদিঝড়ে ওড়ে গেল কংগ্রেসের মতো অলরাউন্ডার দল, তখন থেকেই আপাতদৃষ্টিতে খালি পড়ে ছিল ভারতের রাজনীতির ময়দান। যদিও মাঝেমধ্যে গা-ঝাড়া দিয়ে মাঠ গরমের চেষ্টা করত কংগ্রেস। কিন্তু সেটা কখনোই বিজেপিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়নি। উল্টো কংগ্রেসকে সর্বদা উইকেট টিকিয়ে রাখার জন্যই সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে।

তবে এবার সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একুশে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই রাজনীতির খালি ময়দানে প্রাণসঞ্চার ঘটতে শুরু করেছে। নিজের রাজ্যে বিজেপিকে কচুকাটা করার পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে তেড়েফুঁড়ে জাতীয় রাজনীতিতে ঢুকতে যাচ্ছেন তাতে বেশ ভালো করেই বিজেপির সাথে তার খেলার আগ্রহ টের পাওয়া যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে 'খেলা হবে' স্লোগানেও যেটা তিনি পরিষ্কার করে দিচ্ছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের মাহাত্ম্য ছিলো ব্যাপক। এর প্রতিক্রিয়া কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বরং সুদূর কাশ্মিরেও পরিলক্ষিত হয়েছে। গেরুয়াবিরোধী নেতৃবৃন্দের কন্ঠেও দলমত নির্বিশেষে শোনা গিয়েছে 'খেলা হবে' স্লোগান! ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে মোদিবিরোধী ঐক্যজোটের ভবিষ্যত। যদিও এই জয়ের ফলে নড়বড়ে হয়ে গেছে কংগ্রেসের বিরোধী আসন!

অনুমান করা কঠিন ছিলো না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জয়কে অক্সিজেনে পরিণত করে লম্বা রেসে অংশ নিতে যাচ্ছেন। আঞ্চলিক সংগঠন থেকে সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে নবজন্ম লাভ করবে যে তৃণমূল, সেটা অনুমিতই ছিল। আপাতত পরিস্থিতির চাকা ঘুরছেও সেই ধারণার লাইনে ভর করে।

মমতার বিজয়ের পরপরই ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে মোদীবিরোধী জোটের চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সেটা আরো গতি পায় গত মাসে মমতার দিল্লি-সফরের সময়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করাটা সেই সফরে রঙ চড়ালেও আদতে সেটি ছিল বিরোধীদের সংযুক্ত করারই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। যদিও মোদিবিরোধী জোট তৈরিতে মমতা বিরোধী নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাননি।

আসল কাজের ষোলো আনা পূর্ণ না হলেও সেই সফরকে অবশ্য বিশ্লেষকেরা একেবারে ব্যর্থও বলছেন না। মমতার অজানা নয় যে জাতীয় স্তরে বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলকে হারাতে কতটা সামর্থ্যের প্রয়োজন। রাজ্যের হিসেব যে কতটা আলাদা, আর কেন্দ্রের হিসেব যে কতটা আলাদা সেটাও তার ভালো জানা। বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলকে হারানো তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলের জন্য সহজ নয়। 'কাটা দিয়ে কাটা তোলা' তত্ত্বে বিশ্বাস করলে এই কাজে যে, কংগ্রেসের মতো সর্ব ভারতীয় দল যে ট্রাম্প কার্ড হবে সেটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। চাই আজকের কংগ্রেস যতই জৌলুশহীন হোক না কেন! নেতৃত্বের অঙ্ক কষতে গেলে যে আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় কংগ্রেস।

মোদিবিরোধী জোট তৈরিতে যেমন কংগ্রেসের দরকার ছিল তৃণমূলের, ঠিক তেমনি অন্দরে ফাটল মেরামতেও সোনিয়া গান্ধীর প্রয়োজন ছিলো মমতাকে। দলের বিবাদমান দুই পক্ষই মমতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। কংগ্রেসের বহির্মুখি-অন্তর্মুখি সব পক্ষেরই সমর্থন মোদিবিরোধী জোটের দিকে হেলে যাওয়ায় মমতার মাথাব্যথা কমবে নিশ্চিতরুপেই।

কংগ্রেস-তৃণমূল মৈত্রীতে জোটের পাটাতন শক্ত হলেও নেতৃত্বের চেয়ার নিয়ে কিন্তু ঠিকই পর্দার আড়ালে চলছে টানাটানি। 'অজেয়' বিজেপির বিরুদ্ধে প্রায় একহাতে বাঙালি জাতিবাদের ঝান্ডা হাতে রাজ্য জয় করা মমতার বহুদিনের ইচ্ছে দিল্লির দরবারে 'সুলতানা রাজিয়া' হওয়ার। সেজন্য নেতৃত্বের ডোরটাও নিজের হাতেই রাখতে চাইছেন তিনি। মুখে অবশ্য বলছেন না, তবে দলের নেতাদের প্রচার-প্রচারণায় রেখে নীরবে ভাত কিন্তু ঠিকই টিপে দেখছেন দিদি।

আর অস্বস্তিটা ঠিক এই জায়গাতেই। জনপ্রিয়তায় মরচে পড়ে গেলেও কংগ্রেস এত তাড়াতাড়িই মসনদ দখলের লড়াইয়ে মশালটা অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চায় না। নিজের হাতে মশাল রেখেই দৌড়াতে চায় দলটি। সেজন্য হঠাৎ করেই কিনা চনমনে ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাহুল গান্ধীর মাঝে। যা কিনা তৃণমূলেরও নজর এড়ায়নি। তাই একহাত সামনে রেখেও আরেক হাতে দলদুটি লড়ছে 'অদৃশ্য কুস্তিতে'। লোকসভায় বিরোধীদের নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্যে দুই দলের হরকতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মমতার জন্য নেতৃত্বের লড়াইটা একেবারেই নিষ্কণ্টক নয়।

বিশাল ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলোর আবেদন দিল্লি-দখলের লড়াইয়ে ভিন্ন মাত্রার। দিল্লি দখলে যেমন আঞ্চলিক দলগুলোকে হতে হয় সর্ব ভারতীয়, তেমনি সর্বভারতীয় দলগুলোকেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে দ্বারস্থ হতে হয় ছোট দলগুলোর। এই যখন সমীকরণ, তখন তৃণমূলের সামনে নিশ্চিতভাবেই অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

দিল্লি সফরে মমতা কংগ্রেসকে পাশে পেলেও আঞ্চলিক দলগুলো ঠিকই দূরত্ব বজায় রেখেছে। বর্ষীয়ান নেতা শারদ পাওয়ারের সাথে দেখা করার কথা থাকলেও পাওয়ার পড়ে আর দেখা করেননি। অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টি, টিআরএস বা আরজেডি ওয়াইএস কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলোও পাওয়ারের পন্থাই অবলম্বন করেছে।

অবস্থাদৃষ্টে যেটা মনে হচ্ছে, আঞ্চলিক দলগুলো আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের দিকেই অধিক মনোযোগী। মমতা-ম্যাজিক পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কতটা কার্যকর হবে মোদিঝড়ের মোকাবিলায়, তা নিয়ে দলগুলোর সংশয় রয়েছে ব্যাপক। বাঙালি জাতিবাদের অস্ত্র বিজেপির তৈরী করা হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদের বলয় ভাঙতে সারা ভারতে শতভাগ কার্যকর হবে তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও সন্দিহান। সেই জায়গায় ভোটের প্রায় আড়াই বছর আগে আঞ্চলিক দলগুলো এক রাজ্যের ফলাফল সামনে রেখে কেন্দ্র-জয়ের রসদ এত তাড়াতাড়ি মজুত করবেন- এমনটা ভাবা সত্যিই বাড়াবাড়ি ছিলো।

আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দের এমন মনোভাব তৃণমূলের রাডারে ধরা পড়েছে দ্রুতই। জাতীয় রাজনীতিতে আরো প্রাসঙ্গিক হতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন থেকেই বলয় বিস্তৃত করার কাজে নেমে পড়েছেন। পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে জোড়া ঘাসফুলের জন্য অনুকূল জমিন তৈরীতে তৎপর হয়ে ওঠেছে তৃণমূল। সচেষ্ট হয়ে ওঠেছেন এতদঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষের সমর্থন বাগিয়ে নিতে। সেইসাথে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকা ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন তো রয়েছেই। যেটিকে বিরোধী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন হিসেবেই নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মরিয়া হয়ে ওঠেছেন আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ ত্রিপুরাকেও নিজের দখলে আনতে।

গত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ছিল মমতার শক্তি-সামর্থ্যের অগ্নিপরীক্ষা। যাতে লেটার মার্কস পেয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। তবে দিল্লি দখলের রেসে এটা কেবলই নতুন এক অধ্যায় মাত্র। বহু আরাধ্য স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে গেলে যে এমন অনেক অধ্যায়েরই পাতা নতুন করে উল্টাতে হবে তাকে। যাতে সম্ভাবনার চেয়ে শঙ্কার মুখোমুখিই তাকে হতে হবে বেশি। মোদিবিরোধী জোটে যেমন মমতার সামনে অপেক্ষা করছে নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ, তেমনি অপেক্ষা করছে 'পশ্চিমবাংগাল ম্যা হিরো, বাহার আ-কার জিরো' অপবাদ ঘুচানোর চ্যালেঞ্জও। এই চ্যালেঞ্জে মমতাকে উৎড়াতে হলে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও করতে হবে একুশের সাফল্যের অনুবাদ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us