আফগানিস্তান নিয়ে আলেকজান্ডারের যে সতর্কবার্তা কেউ মনে রাখেনি

মুজতাহিদ ফারুকী | Aug 18, 2021 05:53 pm
মহাবীর আলেকজান্ডার

মহাবীর আলেকজান্ডার - ছবি সংগৃহীত

 

আপনি যদি আফগানিস্তানে ঢুকতে চান তাহলে সেটা বেশ সহজ। কিন্তু যখন বেরিয়ে আসতে চাইবেন তখন সেটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। এরকম একটা কথা কে বলেছিলেন মনে পড়ে? বলেছিলেন ‘বিশ্ববিজয়ী’ মহাবীর আলেকজান্ডার। কথাটা তিনি সাধারণ পর্যটকদের জন্য বলেছেন এমন নয়, বলেছেন, যারা গায়ের জোরে দেশটি দখল করতে চায় তাদের উদ্দেশে। কথাটা ছিল ঠিক এরকম, “It's impossible to conquer the Afghans”...

এই গ্রিক বীর কথাটি বলেছিলেন, দু-চার বছর বা দুই একশ বছরের মধ্যে নয়। বলেছিলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে। সেই সময়ে আফগানিস্তান ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ। পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আলেকজান্ডার আফগানিস্তানে ঢুকেছিলেন। তার হাতে দারিয়ুসের বিশাল বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের পতনেরও সূচনা হয় বলে অনেকে মনে করেন। পরে ভারত আক্রমণ করে আলেকজান্ডার ব্যর্থ হয়েছেন। আরো পরে পারস্যের পূর্বপ্রান্তের প্রদেশ আফগানিস্তানে একটি গ্রিক রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের অংশ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রের নাম ছিল ব্যাক্ট্রিয়া। আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি যার নামটি একটি বিস্ময়বাক্যের মধ্যে (‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!) অমর হয়ে আছে সেই সেলুকাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্ট্রিয়ায় গ্রিকরা পরবর্তী তিন শ’ বছর ধরে শাসন জারি রাখে।

আজও আফগানিস্তানের কোনো কোনো প্রত্নখননে যে গ্রিক শহরের অবিকল নমুনা উঠে আসে তার কারণ ব্যাক্ট্রিয়ায় এই গ্রিক শাসন। আফগানিস্তানের কিছু শহরের নামে এখনো আলেকজান্ডার বেঁচে আছেন; যেমন কান্দাহার। শব্দটির উৎপত্তি ইস্কান্দাহার থেকে। যেটি আলেকজান্ডারের ফারসি উচ্চারণ ইস্কান্দার থেকে উদ্ভূত। আমাদের এই আলোচনার উদ্দেশ্য আফগানিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করা নয়। আমরা বলতে চাইছি, আলেকজান্ডারের উক্তির তাৎপর্য। এই দেশটিকে তিনি বলেছিলেন ‘অপরাজেয়’। দেশটির আরো একটি ‘ডাকনাম’ আছে। সেটি হলো, সাম্রাজ্যসমূহের গোরস্তান বা ‘graveyard of empires.’ এই নামটিও যথার্থ। কারণ যত বড় বড় বীর এই দেশটি দখল করতে গেছেন তাদের প্রায় কেউই অক্ষত ফিরতে পারেননি। দখলে রাখা তো দূরের কথা। সেই আলেকজান্ডারের সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অসংখ্য বহিঃশক্তি আফগানিস্তান দখল করেছে বা করার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু আলেকজান্ডার যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন সেটি কেউই মনে রাখেনি। একের পর এক তারা আফগানিস্তান দখল করতে গেছে। এই ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে শোচনীয় ও করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল ব্রিটিশদের। তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেপরোয়াভাবে নাক গলাবার চেষ্টা করলে যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। ১৮৪২ সালে কাবুলে ব্রিটিশের সৈন্যসামন্ত ও তাদের পরিজন মিলিয়ে ছিল ১৬ হাজারের মতো মানুষ। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বেঈমানির কারণে এরা আফগানদের হাতে আক্রান্ত হয়। আফগানরা তাদের তাড়া করে খাইবার পাসের দুর্গম রাস্তায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৬ হাজার মানুষের মধ্যে সাড়ে চার হাজার সৈনিক ছাড়া বাকিরা ছিল বেসামরিক মানুষ, শিশু, নারী। কিন্তু আফগানরা কাউকে ক্ষমা করেনি। মাত্র একজন সৈনিক ডাক্তার ব্রাইডেন ঘোড়ার পিঠে ঝুলতে ঝুলতে জালালাবাদ শহরে তাদের ঘাঁটিতে ফিরতে পেরেছিলেন। তা-ও সম্ভব হয়েছিল সম্ভবত আফগানদের ইচ্ছাতেই। তারা চাইছিল, অন্তত একজন ব্রিটিশ যেন ফিরে গিয়ে তাদের করুণ পরিণতির কথা ব্রিটিশদের কাছে রিপোর্ট করতে পারেন।

এগুলো পুরনো দিনের কথা। ব্রিটিশ জাতির সেই করুণ ইতিহাসও সাম্রাজ্যবাদীদেরকে কোনো শিক্ষা দিতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনীও আফগানিস্তান দখল করে। তাদের শোচনীয় পরিণতি আমাদের জানা। আফগানদের সর্বশেষ শিকার বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি তার সামরিক মিত্রদের নিয়ে (ন্যাটো) একটি বৃহৎ জোট গঠন করেছিল। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর পর ২০ বছর ধরে পৃথিবীর সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থশক্তি দিয়ে দেশটিকে পদানত করার চেষ্টা করে আমেরিকা। তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে একটি দেশ দখলের সেই চেষ্টা অনেক আগেই ব্যর্থ হয়ে যায় যখন ২০১১ সালে দেশটি আফগান প্রতিরোধযোদ্ধা তথা তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সূচনা করেন তালেবানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায়ের। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে উভয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আর এর মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তালেবানের সম্ভাব্য বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us