নতুন আফগানিস্তানে কোন দেশের কোন সমস্যা
নতুন আফগানিস্তানে কোন দেশের কোন সমস্যা - ছবি সংগৃহীত
রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানের বেশ ক’টি শক্তিমান কূটনৈতিক অংশীদার পক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বৃহৎ বৈশ্বিক শক্তি আমেরিকা চীন ও রাশিয়া। এই তিন পক্ষের তিনটি ভিন্ন নিরাপত্তাগত উদ্বেগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে আলকায়েদা ও আইএস-এর মতো উগ্রবাদী শক্তি যারা আমেরিকার স্বার্থে আঘাত হানতে চায়। এ ধরনের শক্তি যাতে আফগানিস্তানে প্রশ্রয় না পেতে পারে তার জন্য য়ুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি হয়েছে। মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাবুলে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বীকৃতি এখনো দেয়নি আর পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারাও বলতে অস্বীকার করেছেন যে, আমেরিকা এখনো আশরাফ গনিকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কি না। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ভবিষ্যতের আফগান সম্পর্ক তালেবানের কর্মের ওপর নির্ভর করবে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে কেবল তখনই স্বীকৃতি দেয়া হবে যদি সরকার নারীর অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং ‘সন্ত্রাসীদের’ থেকে দূরে থাকে।
চীনের প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো জিংজিয়াং। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ তাদের একই বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর সদস্য আর ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিন্নতা। যুক্তরাষ্ট্র এই চীনা উইঘুরদের সমর্থনের জন্য আফগানিস্তানের ভূমিকে অতীতে ব্যবহার করেছে। সেটি যাতে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে তালেবানরা চেিনর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাশিয়ার উদ্বেগ হলো মধ্য এশিয়া এবং তার ককেসাস অংশ নিয়ে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী তুর্কি জাতিগোষ্ঠী ধারার এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সুন্নি মুসলিম। আফগানিস্তানকে যাতে এই অঞ্চলের কোনো শক্তি ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত হতে চায়, যেটি আমেরিকার একটি কৌশলগত কাজের অংশ হতে পারে বলে মস্কোর আশঙ্কা রয়েছে। তালেবানরা মস্কোর এই নিরাপত্তা উদ্বেগের ব্যাপারেও প্রতিশ্রতিবদ্ধ।
অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ইরানের নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো দেশ দু’টির অন্তর্ঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া। আগের শাসনে পাকিস্তানের প্রধান উদ্বেগ ছিল আফগান ফ্রন্ট। এখান থেকে মদদ নিয়ে খাইবারপাখতুন খোয়ায় টিটিপি ও বেলুচিস্তানে বালুচ বিদ্রোহীরা অন্তর্ঘাতী কাজ চালিয়ে গেছে। তালেবান সরকার কোনোভাবেই এ ধরনের কোনো সুযোগ দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর ইরানের বেলুচদের মধ্যে যে বিদ্রোহী তৎপরতা রয়েছে তারাও যাতে কাবুল সরকারের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদ না পায় সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
কিছুটা দূরবর্তী প্রতিবেশী ভারতের সাথে তালেবানের কোনো আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হওয়ার কথা এখনো জানা যায়নি। তবে তালেবান দিল্লির প্রতি যে বার্তা দিয়েছে সেটি হলো তারা ভারত আফগানিস্তানের উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে সেটিকে স্বাগত জানায়। তবে একই সাথে ভারত যদি আফগানিস্তানের কোনো শত্রুকে এ দেশে অস্থিরতা তৈরির কোনো তৎপরতায় ইন্ধন না দেয় তাহলে আফগানিস্তানও তার মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কাজে ব্যবহার হতে দেবে না। ভারতের সাথে তালেবানের সম্পর্কের বিষয়টি রিসিপ্রোকাল বা পরস্পরমুখী।
ক্ষমতা নেয়ার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে সব পক্ষের কূটনৈতিক অংশীদার বা বিদেশী শক্তির কাছে যে অঙ্গীকার দেয়া হয়েছে সেটি রক্ষা করা। এটি করতে হলে অভ্যন্তরীণ জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সহনশীল ও সমন্বয়ের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সামাজিক ক্ষোভ ও বিরোধের বিষয়গুলো যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্য বেশ ক’টি দেশ আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের নীতিনির্ধারণের কথা বলেছে। কেউ কেউ সর্বাত্মক অবরোধের হুমকিও দিয়েছে। অবরোধ বা প্রক্সি-যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মতো কোনো নীতি বা পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় তার জন্য কঠোর থাকতে হবে তালেবান নেতৃত্বকে। তবে এ কথা সত্যি, যে আদর্শ ও মূল্যবোধ তালেবানকে ২০ বছরের কঠিন যুদ্ধে বিজয়ের এই পর্যন্ত এনে দিয়েছে সেটি তারা পরিত্যাগ করবে না।
এটি ঠিক যে, আফগানিস্তানে তালেবান শাসিত সরকারের প্রকৃতি কেমন হতে পারে তা বলা মুশকিল, কিন্তু এটি তালেবান নেতাদের একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, যারা ব্যাপক ভ্রমণ করেছে, বিশ্ব দেখেছে এবং অন্যান্য অনেক সরকারের সাথে আলোচনা করেছে। যে কেউ আশা করবে যে তারা তাদের নির্বাসনের সময় অনেক কিছু শিখেছে; প্রধানত অমুসলিম শক্তির আন্তর্জাতিক পরিবেশে বসবাসের বাস্তবতাকে স্বীকার করা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
mrkmmb@gmail.com