আফগানিস্তানের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
আফগানিস্তানের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ - ছবি সংগৃহীত
বিশ্লেষক গ্রাহাম ই ফুলার মনে করেন, আফগানিস্তানে ওয়াশিংটন যে নীতি অবলম্বন করেছে তা সম্পূর্ণ অবাস্তব উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দুর্বল নীতি বাস্তবায়ন দ্বারা চালিত। এই কারণে বর্তমান পরিণতি দীর্ঘ দিন ধরে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। নব্য-সাম্রাজ্যবাদী নিউ কনজারভেটিভরা যুক্তি দেন যে, আমেরিকান প্রস্থান এবং পরবর্তী কাবুল সরকারের পতন বিশ্বের একটি পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকান ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ গভীরভাবে নষ্ট করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি অন্তর্নিহিত আদর্শ এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বত্র বৈশ্বিক পুলিশ হিসেবে কাজ করতে হবে এবং এটি করতে ব্যর্থ হওয়া দুর্বলতা এবং পতনের লক্ষণ।
তবে এটি ঠিক যে আমেরিকার সামগ্রিকভাবে পতন দেশীয় এবং ভূরাজনৈতিকভাবে তার গভীর দুর্বলতার প্রতীকী চিহ্ন; ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ধারণা রয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়ে অস্বীকারের একটি ফ্যান্টাসি বুদ্বুদে বাস করছে। যদি আফগানিস্তানে ২০ বছরের মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রকৃতপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের দিকে অগ্রগতি দেখায়, তবে এই একটি জিনিসই হবে।
মানবিক স্তরে অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে নতুন তালেবান সরকারের অধীনে আফগানরা কেমন ভাগ্যের মুখোমুখি হবে। আফগান জনগণ ১৯৭৮ সাল থেকে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং সামরিক হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। আফগান কমিউনিস্টদের একটি অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সোভিয়েত আক্রমণ, পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমর্থিত মুজাহিদীন গোষ্ঠী দ্বারা সোভিয়েতদের বিতাড়িত করার লড়াই, পরবর্তীকালে মুজাহিদীনদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়া এবং অবশেষে তালেবানরা জাতীয় শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করে একটি সরকার গঠন পর্যন্ত এটি ঘটেছে।
বাস্তবে আফগানিস্তানের প্রতি ওয়াশিংটনের মনোযোগ আফগানদের জন্য একটি উন্নত এবং অধিকতর ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে খুব কমই জড়িত ছিল। আফগানিস্তানে আলকায়েদার উপস্থিতি ধ্বংস করার জন্য আমেরিকান আক্রমণের কথা বলা হয়। কিন্তু আমেরিকান আক্রমণ এবং দীর্ঘ দখলের গভীর এবং অধিকতর গভীর কারণ ছিল রাশিয়া এবং চীনের সীমান্তে মধ্য এশিয়ায় সামরিক ও ভূরাজনৈতিক উপস্থিতি তৈরি করা। সেই উচ্চাকাক্সক্ষা কখনোই নগ্নভাবে প্রকাশ করা হয়নি কিন্তু সব আঞ্চলিক শক্তি স্পষ্টভাবে তা বুঝতে পেরেছিল। আমেরিকান দখলের ‘জাতি-নির্মাণ এবং মানবিক’ দিকগুলো ছিল মূলত ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করার উইন্ডো ড্রেসিং। আমেরিকান নিওকন এবং উদার হস্তক্ষেপকারীদের মধ্যে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো এখনো পুরোপুরি মারা যায়নি।
ভালো লাগুক বা না লাগুক, সম্ভাব্য ‘আমেরিকান পরবর্তী ভূরাজনীতির’ একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে বিশ্বব্যাপী যেখানে একাধিক খেলোয়াড় নিযুক্ত সেখানে ঐতিহাসিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা। আর এই ক্ষেত্রে, একাধিক খেলোয়াড় আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইরান, রাশিয়া এবং চীন এই যে তিনটি দেশকে শত্রু মনে করে তারা আসলে সবাই ওয়াশিংটনের সাথে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য একই প্রধান লক্ষ্যকে ভাগ করে নেয় : সেটি হলো স্থিতিশীলতা, রক্তপাত এবং আদর্শ রফতানির অবসান। কিন্তু এই তিনটি দেশই আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায় আমেরিকান হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্যের তীব্র বিরোধিতায় একত্রিত হয়।
আগে, তালেবান হয়তো এই প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খুব কমই চিন্তা করত, আজ মধ্য এশিয়া একটি ভিন্ন জায়গা। আফগানিস্তান ভেঙে পড়েছে এবং তালেবানের সামাজিক নীতি যাই হোক না কেন, তাদের দেশকে ন্যূনতম সমৃদ্ধি এবং শান্তিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে সাহায্য করার জন্য চীনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ায় বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের চীনা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত হয়ে নিজের পুনঃনির্মাণ করতে পারে। চীন তালেবানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং তাদের আন্দোলনের যে কোনো বিস্তার এড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে, যা কেবল জিনজিয়াংয়ে চীনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে না, বরং ককেসাস ও মধ্য এশিয়ার রাশিয়া এবং শিয়া ইরানের নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করে।
ইরান, চীন বা রাশিয়া- এ রাষ্ট্রগুলোর কেউই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের আঙিনায় তথা সামরিকভাবে মধ্য এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় না। মধ্য এশিয়ার কেন্দ্র থেকে মার্কিন সামরিক প্রভাব দূর হয়ে গেলে, একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল আফগানিস্তান আসতে পারে সবার ইচ্ছা ও স্বার্থে।
mrkmmb@gmail.com