মানবিক তালেবানের কাছে হেরে গেছে পাশ্চাত্য মিডিয়াও!

সংবাদ সম্মেলন করছেন তালেবান মুখপাত্র - ছবি : সংগৃহীত
শরিয়াহ মোতাবেক নারীদের সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলেছেন তালেবানের সংস্কৃতি কমিশনের সদস্য এনামুল্লাহ সামনগামি। এছাড়া, মঙ্গলবার কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান বলেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন খাতে তারা নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেবেন; তবে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে।
অথচ 'নারীবিদ্বেষী' বা 'নারীবিরোধী' ট্যাগ দিয়ে তালেবানকে যারা এত দিন 'সাব-হিউম্যান' বা 'হাফ-হিউম্যান' বলে ডিহিউম্যানাইজ ও ভিলিফাই করতেন, তারা এখন কী বলবেন? তালেবান সম্পর্কে তারা কি তাদের আগের নেতিবাচক মনোভাব এখন পরিবর্তন করবেন?
ওয়েস্টার্ন মিডিয়া যারপরনাই প্রপাগান্ডা চালিয়ে তালেবানকে ডিহিউম্যানাইজ ও ভিলিফাই করার চেষ্টা করে গেছে। সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রপাগান্ডা অনেককে ব্রেইনওয়াশ করেছে। অনেকেই সেসব প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু তালেবান তাদের বিগত শাসনামলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এবং ঘর থেকে বেরুনোর ক্ষেত্রে কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেটা অনেকেই খতিয়ে চিন্তা করেনি। বরং ওয়েস্টার্ন মিডিয়া আমাদের যা গিলিয়েছে, আমরা অনেকেই তা পেট ভরে খেয়েছি।
দখলদার সোভিয়েতরা ভেগে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এরমধ্যে তালেবান আফগানিস্তানের ৮৫ ভাগ ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেটার ওপরই ইসলামিক আমিরাত গঠন করে। আর বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকে তালেবানের প্রতিপক্ষ নর্দার্ন এলায়েন্সের হাতে। নর্দার্ন এলায়েন্স তালেবানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করছিল।
ঠিক এরকম অস্থির গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে মেয়েদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের স্কুলে যাওয়া ও ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ওই সময়ের তালেবানের ইসলামিক আমিরাত৷
অথচ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া একদিকে তালেবানকে ভয়েসলেস করে রাখল, অন্য দিকে হলুদ সাংবাদিকতা ও অব্যাহত প্রপাগান্ডার মাধ্যমে তালেবানকে ডিহিউম্যানাইজ ও ডেমোনাইজ করতে লাগলো। আর আমরা অনেকেই তাতে বিভ্রান্ত হতে থাকলাম।
অথচ আমেরিকার হাতে বন্দি একজন মুসলিম নারী স্কলার ড. আফিয়া সিদ্দিকী জেলে মার্কিন সৈন্যদের হাতে কিভাবে দিনের পর দিন ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন আমরা সকলেই জানি।
আমরা এটাও জানি, ইভান রিডলে নামে এক নারী ব্রিটিশ সাংবাদিক তালেবানের হাতে বন্দি অবস্থায় কেমন আচরণ পেয়েছিলেন।
একজন অসহায় বন্দি নারী সত্ত্বেও তালেবানের সম্মানজনক সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি এমনকি পরে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণও করেন; তার নতুন নাম মারিয়ম রিডলে। মুক্তির পর তাকে তার বন্দিদশা সম্পর্কে জিগেস করা হলে তিনি বলেন, 'They (the Taliban) treated me with respect and courtesy' (8 Oct. 2001, CNN)। এছাড়া মুক্তির পর তাকে বিধ্বস্ত নয়, বরং বেশ খোশমেজাজেই দেখা যায়।
তবুও ওয়েস্টার্ন মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় তাড়িত হয়ে অবলীলায় তালেবানকে সাব-হিউম্যান বা হাফ-হিউম্যান বলে অবজ্ঞা করতে অনেকের দ্বিধা হয় না।
এছাড়া, তালেবান বাহিনী সুদীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধ করে দেশ দখলমুক্ত করার পর তাদের দেশের একটা দালালকেও হেনস্তা করেনি এখনতক। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। কাউকে শাস্তির কোনো হুমকিও দেয়নি৷ কাবুলের কেনো সাধারণ নাগরিকের ঘরবাড়িতেও হানা দেয়নি। জ্বালাও-পোড়াও করেনি। তবুও দখলদার আমেরিকার দোসর দালাল আফগানরা এবং কিছু নাগরিক কেন পালাচ্ছে সেটার দুটি কারণ : সুযোগে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর লোভ, আর নয়তো তালেবান সম্পর্কে প্রপাগান্ডা-তাড়িত অতিরিক্ত আতঙ্ক।
ইতিহাসে দেখা যায়, বিজয়ীরা কিভাবে পরাজিতের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়। ফরাসি বিপ্লবের পর বিজয়ী বিপ্লবীরা তাদের প্রতিপক্ষের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়; গিলোটিনে রেখে বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো বিনা বিচারে। এই নির্মম সময়কে ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বা রেইন অব টেরর বলে অভিহিত করা হয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষসময়ে জার্মানির বার্লিন দখল করার পর সোভিয়েত, আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসি ও পোলিশ সৈন্যরা ২০-৩০ লক্ষ জার্মান নারীকে গণধর্ষণ করে। এমন অনেক ইতিহাস আছে।
অথচ এখন পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো কলঙ্ক নেই। এমনকি সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ বিজয়পূর্বক ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করার পর যখন পরাজিত ভূমির অধিবাসী খ্রিস্টানরা ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল, ছোটাছুটি করছিল এবং দিকবিদিক পালাচ্ছিল, তখন তিনি তাদের সবার প্রতি ক্ষমা, সহানুভূতি ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। নিজ সৈন্যদের তিনি কোনো লুটপাট ও অরাজকতা করা থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ঠিক একইভাবে তালেবানের কাবুল দখলে নেয়ার পর আমেরিকার দোসররা আতঙ্কিত হয়ে দিকবিদিক পালাতে থাকলে তালেবান তাদের মুজাহিদিনদের নির্দেশ দিয়েছে বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ না করতে এবং নাগরিকদের সম্মান ও সহায়-সম্পত্তি রক্ষা করতে। তারা সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে এবং সবার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ এখন পর্যন্ত তালেবানের কোনো সদস্য কর্তৃক কোনো বিচ্ছিন্ন অঘটনও ঘটেনি।
মিডিয়া যেভাবে তালেবানকে এত বছর ডেমোনাইজ করেছে, সেই তালেবানই আফগান দালালদের প্রতি এমন মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতা প্রদর্শন করবে তা ছিল ভাবনাতীত। কিন্তু তারা তো তালেবুল ইলম। তারা ইলমের চর্চার মধ্যদিয়ে রাসূল সা.-এর মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতার শিক্ষা লাভ করেছে। ফলে তাদের কাছ থেকে এমন মহানুভবতা পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
মিডিয়ায় তালেবানকে ভয়েসলেস করে রাখার ফলে এত বছর তালেবানের বিরুদ্ধে বিনা বাদ-প্রতিবাদে একচেটিয়া প্রপাগান্ডা চালানো সম্ভব হয়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তালেবানকে মিডিয়ায় স্পেস দেয়া হচ্ছে। তাই তাদের বক্তব্য আমরা এখন শুনতে পারছি। টানা দুই দশকের প্রপাগান্ডার বিপরীতে তারা তাদের অবস্থান তুলে ধরছে। মানবিক তালেবানের কাছে পাশ্চাত্য মিডিয়াও আজ হেরে গেছে।
শরিয়াপন্থী তালেবান যথেষ্ট মানবিক বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। তারা পাশ্চাত্যের মতো মানবতার ভেকধারী নয়। পাশ্চাত্য বিশেষত ইউরোপের প্রায় ডজন খানেক দেশে সেকুলার মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে আইন প্রবর্তিত আছে, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলে তালেবান আইন করে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করলে তাতে এত বেশি উদ্বেগ দেখানোর কী আছে!
এখন তালেবানের প্রতি প্রপাগান্ডা-প্রভাবিত আমাদের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পরিবর্তনের সময় এসেছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tareqislampt@gmail.com