তালেবানের সাথে কেমন সম্পর্ক রাখবে চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান?
তালেবানের সাথে কেমন সম্পর্ক রাখবে চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান? - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান ফিরে আসার পর বাকি বিশ্ব যখন দেশটির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কিত, তখন বেইজিং, মস্কো ও ইসলামাবাদে দেখা যাচ্ছে কিছুটা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।
বেশিরভাগ দেশ যখন কাবুলে তাদের দূতাবাস থেকে জরুরি ভিত্তিতে দেশে ফিরিয়ে আনছে তাদের কূটনীতিকদের, তখন এই তিন দেশ আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত এরই মধ্যে দিয়ে রেখেছে।
চীন বলেছে, তারা আফগানিস্তানের সাথে তাদের 'বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক' সম্পর্ক আরো গভীর করতে প্রস্তুত। রাশিয়া বলেছে, কাবুল থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো এমন মন্তব্য করে বসেছেন যে, আফগানিস্তানের জনগণ অবশেষে 'দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে।'
তালেবান যখন ১৯৯৬ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল, তখন দেশটি ছিল আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় একঘরে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সেরকম নাও হতে পারে, সেরকম ইঙ্গিত এখনই দেখা যাচ্ছে।
চীন : 'সম্পর্ক গভীর করতে প্রস্তুত'
বিবিসি মনিটরিং-এর চীনা মিডিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক কেরি অ্যালেন লিখেছেন, আফগানিস্তানে যা ঘটছে তাই এখন চীনা গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় আফগানরা কিরকম 'বিশ্বাসঘাতকতার শিকার' হয়েছে বলে বোধ করছে, সেটাই প্রাধান্য পাচ্ছে চীনা গণমাধ্যমের খবরে।
আফগানিস্তানের চীনা দূতাবাস সেখানে কোনো চীনা নাগরিক হতাহত হওয়ার খবর পায়নি বলে জানিয়েছে। তবে চীনা দূতাবাস এই মূহুর্তে আফগানিস্তানে তাদের নাগরিকদের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকা খবর দিচ্ছে, দূতাবাস কর্মীদের ফিরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে বেইজিংয়ের নেই।
তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর চীনের এক সরকারি মুখপাত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, চীন আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে প্রস্তুত।
পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হুয়া চুনিইং গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "আফগানিস্তানের জনগণের ইচ্ছা এবং পছন্দকে চীন শ্রদ্ধা করে, তবে চীন অব্যাহতভাবে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।"
চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা লিখেছে, চীন বিশেষভাবে নজর রাখবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যেন শিনজিয়াং প্রদেশে কোন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। এই স্বশাসিত অঞ্চলটি আফগানিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন।
মস্কোতে দুশ্চিন্তা
বিবিসির মস্কো সংবাদদাতা স্টিভ রোজেনবার্গ জানাচ্ছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের জয়যাত্রা রুশ গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম দখল করে আছে। তবে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই বিষয়টি।
একটি সরকারি সংবাদপত্রে লেখা এক কলামে রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পীকার কনস্টান্টিন কোশাচেভ বলেছেন, ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী যে সিরিয়া এবং ইরাকে পরাজিত হওয়ার পর এখন আফগানিস্তান এবং সেন্ট্রাল এশিয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। তিনি আরও লিখেছেন, ইসলামিক স্টেট তালেবানের সঙ্গে কোন সমঝোতায় পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, রাশিয়া এবং তার মিত্রদের জন্য যে ঝুঁকি বাড়বে, সেটা মোটেই উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আফগানবিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ রুশ সংবাদপত্র ইজভেস্তিয়াকে বলেছেন, সমস্যাটা হচ্ছে, তালেবান আগেও অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদের সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, এখনো করছে। কাজেই তাদের বিজয়ের পর এমন আশঙ্কা আছে যে আফগানিস্তান আবার সন্ত্রাসবাদ এবং মাদক চোরাচালানের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
আরেকটি রুশ সংবাদপত্র কোমারসান্ট বলছে, কাবুলের পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও সেখানে রুশ দূতাবাস দেখে বেশ শান্ত বলেই মনে হচ্ছে। দূতাবাস বলছে, অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মতো তারা তাদের কূটনীতিক এবং কর্মীদের উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন দেখছে না। তালেবানের সাথে রুশ দূতাবাস যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে, এমন ইঙ্গিত আছে রুশ গণমাধ্যমে।
এক রুশ কূটনীতিক কমসোমস্কোয়া প্রাভদা পত্রিকাকে বলেছেন, তালেবানের যেহেতু দেশ চালাতে হবে, তাই তাদের বাইরে কিছু দেশের সহযোগিতা লাগবে, বিনিয়োগ লাগবে। বিশেষ করে খাদ্য সংকটের সুরাহা করতে হবে। আর মস্কোকেও কিছু সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে, বিশেষ করে আফগানিস্তানের সঙ্গে তাজিকস্তান এবং উজবেকিস্তানের সীমান্তের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সাহায্য করতে হবে।
পাকিস্তান : 'আফগানরা দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে'
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানিস্তানের তালেবানের বিজয় সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা বেশ আলোচিত হচ্ছে।
বিবিসি উর্দূর সারাহ আতিক জানান, ইমরান খান পাকিস্তানে ইংরেজি শিক্ষার সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্যটি করেন। তিনি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে বক্তৃতায় বলেন, আফগানরা 'দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে।'
১৯৯৬ সালে মাত্র যে তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, পাকিস্তান ছিল তার একটি। তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সভাপতিত্ব করবেন। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের দুটি প্রধান ধর্মভিত্তিক দল, জামায়াতে ইসলামী ও জেইউআই-এফ এরই মধ্যে আফগান তালেবানকে তাদের বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। তারা পূর্ণ সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব দলের সদস্যরা তালেবানের বিজয়ে মিষ্টিও বিতরণ করে।
সূত্র : বিবিসি