গনি : আফগানিস্তানের কলঙ্ক
আশরাফ গনি - ছবি : সংগৃহীত
রাজনীতি নয়, আগ্রহী ছিলেন মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে। কিন্তু সাত বছর ক্ষমতায় থাকলেও, আফগানিস্তানের বিবর্তনের ইতিহাসটা তিনি পড়ে দেখেননি বলে অভিযোগ। তাই দেশের চার কোটি নাগরিকের চোখে এক মুহূর্তেই অপরাধী হয়ে গেলেন আশরফ গনি। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সাফাই দিয়েছেন, রক্তপাত এড়াতে এ ছাড়া কোcbf উপায় ছিল না। কিন্তু গনি যদি খোলসের মধ্যে ঢুকে না থাকতেন, তা হলে অনেক আগেই বিকল্প উপায় বার করা যেত বলে মনে করছেন তার ঘনিষ্ঠরাই।
রোববার তালিবানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হওয়ার পর, গনি রাতেই আফগানিস্তান ছেড়ে পালান। এর পর ফেসবুকে লেখেন, ‘২০ বছর ধরে বুক চিতিয়ে যে দেশকে রক্ষা করেছি, যে মানুষদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি, তাদের বাঁচাতে এ ছাড়া উপায় ছিল না।’ কিন্তু এতে সমব্যথী হওয়া তো দূরে থাক, ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন তার একসময়ের সহযোগীরাই। তাদের দাবি, দম্ভ ছেড়ে আফগানবাসীর চাওয়া-পাওয়ার দিকে নজর দিলে, চোখের সামনে অঘটন ঘটতে দেখেও নির্লিপ্ত না থাকলে, আজ সর্বসমক্ষে এমন সাফাই দিতে হত না সদ্য প্রাক্তন আফগান প্রেসিডেন্টকে।
১৯৪৯ সালে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশে আহমদজাই পাশতুন পরিবারে গনির জন্ম। তবে বড় হওয়া পশ্চিমি শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতেই। পড়াশোনা শুরু আমেরিকার অরগান লেক ওসউইগো হাইস্কুলে। স্কুলের পর প্রথমে আইন পড়বেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু মনুষ্যজাতির বিবর্তন জানতে তার আগ্রহ ছিল ছোট থেকে। সেই ঝোঁকে শেষ পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিজ্ঞান বেছে নেন। বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পর কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখান থেকেই পিএইচডি। সেখানেই স্ত্রী রুলা সাদের সঙ্গে আলাপ এবং পরবর্তীকালে বিয়ে। দুই সন্তান। মেয়ে মরিয়ম এবং ছেলে তারিক, দু’জনেই আমেরিকার নাগরিক। লেবানিজ স্ত্রীও এখন আমেরিকার নাগরিক। ৫২ বছর বয়সে গনি আফগানিস্তানে ফিরলেও, স্ত্রী এবং সন্তানরা আমেরিকা ছাড়েননি।
গনির কর্মজীবনও রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। কাবুল ইউনিভার্সিটি, ডেনমার্কের আরহুস ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কলি এবং জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা করেছেন। হার্ভার্ড ইনসিড এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-স্ট্যানফওর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের লিডারশিপ ট্রেনি প্রোগ্রামেও অংশ নেন গনি। ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাংকের পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে নিযুক্ত হন। ওই একই সময়ে জাতিসঙ্ঘের এশিয়া সংক্রান্ত বিভাগেও কাজ করেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়, সে বছর ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসঙ্ঘ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রায় ২৪ বছর পর দেশে ফেরেন গনি। তালিবানকে হটিয়ে সেই সময় আমেরিকার সহযোগিতায় আফগানিস্তানের মসনদে হামিদ কারজাই। তার মুখ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হন গনি। কারজাইকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গনির। কারজাই সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলান। এর পাশাপাশি আমেরিকার বার কাউন্সিল, জাতিসঙ্ঘ এবং বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন বৈঠকেও সমান ভাবে অংশ নিতে দেখা যায় তাকে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস-এর মতো পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও চালিয়ে যান।
২০০৬ সালে কফি আনানের উত্তরসূরি হিসেবে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব পদে গনির নাম আলোচনায় এসেছিল। ২০১০ সালে ‘ফরেন পলিসি’ পত্রিকার বিচারে বিশ্বের সেরা ১০০ চিন্তাবিদের তালিকায় ঠাঁই পান গনি। কিন্তু মেধা এবং প্রতিভার নিরিখে অনেকের থেকে এগিয়ে থাকলেও বদমেজাজি স্বভাব, অতিরিক্ত চাহিদা, কারো কথা না শোনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বোপরি দেশবাসীকে গুরুত্ব না দিয়ে আমেরিকার হাতের ‘পুতুল’ হয়ে থাকাটা পূর্বসূরিদের থেকে তাকে অনেকটাই দুর্বল করে তুলেছিল বলে মত সমালোচকদের। তাদের মতে, সোভিয়েত শাসনের সময়কার ঝড়-ঝাপটা, গৃহযুদ্ধ, তালিবানি রাজত্ব- বিদেশে বাস করে এ সবের কোনো আঁচই পাননি গনি। তাই আফগানবাসীর সাথে কখনো পুরোপুরি একাত্ম হতে পারেননি তিনি।
যে কারজাই সরকারের হাত ধরে আফগানিস্তানে ফেরেন গনি, পরবর্তীকালে সেই কারজাইয়ের সঙ্গেও মতবিরোধ দেখা দেয় তার। এর পর ২০০৯ সালে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাম লেখান গনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাশতুনদের সমর্থন পেতে ওই সময় নামের পাশে জন্মসূত্রে পাওয়া পাশতুন পদবি ‘আহমদজাই’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু সে বারের নির্বাচনে চতুর্থ স্থান পান। সাংবিধানিক বিধিনিষেধের জন্য ২০১৪ সালে তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নাম লেখাতে পারেননি কারজাই। সেই সুযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন গনি। ওই সময় আমেরিকা এবং আফগানিস্তান, দু’দেশেরই নাগরিক ছিলেন তিনি। আফগানবাসীর মন জয় করতে আমেরিকার নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন।
২০১৪ সালে প্রতিপক্ষ আবদুল্লা আবদুল্লাহর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জয়ী হন গনি। কিন্তু দেদার ছাপ্পাভোট করিয়ে গনি জয়ী হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি কাবুলে উপস্থিত হন। আমেরিকার আর্থিক সাহায্যে ‘স্বাধীন নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয় আফগানিস্তানে। তিন মাস ধরে হিসেবনিকেশ করে তারা গনিকেই প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে হাত দেন গনি। পররাষ্ট্র সম্পর্ক, শিক্ষা ও অর্থনীতিকে মজবুত করতে একাধিক পদক্ষেপও করেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত, একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘন মামলায় অভিযুক্ত জেনারেল আবদুল রশিদ দোস্তামকে উপরাষ্ট্রপতি করে আফগানদের একটা অংশের বিরাগভাজন হন।
তার পরও ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গনি। কিন্তু আফগানবাসীর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নন, আমেরিকার হাতের পুতুল হিসেবে তিনি সরকার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন বিরোধীরা। এক বার বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে গনি বলেন, ‘‘আফগানবাসীরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবেন। টেবিলে বসে যারা দিনরাত খুটখাট করেন এবং দিবাস্বপ্ন দেখেন, তারা নন।’’ কিন্তু মুখে এ কথা বললেও, শেষ কয়েক বছরে গনি আসলে নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন করছিলেন বলে মত কূটনীতিকদের। তাদের দাবি, গনিকে এড়িয়ে সরাসরি তালিবানের সাথে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করে আমেরিকা। তার সরকারকে ৫ হাজারের বেশি জেলবন্দি তালিবান যোদ্ধার মুক্তিতে বাধ্য করে আমেরিকা এবং ন্যাটো জোট।
তালিবানের সাথে চুক্তি অনুযায়ী, আমেরিকা যখন সেনা সরাতে শুরু করে, তখনো আইনশৃঙ্খলা হাতে রাখতে ব্যর্থ হন গনি। পেন্টাগনের সিদ্ধান্ত মেনে আমেরিকার সেনা তালিবানের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাত থেকে সরে আসে। সেই পরিস্থিতিতে তালিবান একের পর এক প্রদেশ দখল করতে শুরু করে। একের পর এক প্রদেশের গভর্নর আত্মসমর্পণ করেন। ২০ বছর ধরে তিলে তিলে সাজানো আফগান সেনা থেকে দলে দলে তালিবানে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ভবিষ্যত্ আঁচ করে, আলাদা করে তালিবান নেতৃত্বের সাথে বৈঠক শুরু করে দেয় চীন এবং রাশিয়ার মতো দেশ।
নব্বইয়ের দশকে পাকস্থলির ক্যানসারে আক্রান্ত হন গনি। সেই থেকে কড়া নিয়মে থাকেন। কখনো পেট ভরে খেতে পারেন না। স্ত্রী-সন্তানরাও দূরে। কিন্তু নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মানতে নারাজ তিনি। একবার সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘আমার জীবন কখনো নিঃসঙ্গ হয়ে কাটবে না।’ কিন্তু আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়া বিশেষজ্ঞ তথা বিশিষ্ট লেখক আহমেদ রশিদের কথায়, ‘কখনো কাউকে কাছে আসতেই দেন না গনি। সবসময় একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেন, সে আফগান নাগরিক হোন বা অত্যন্ত পরিচিত কেউ। অল্পেতে রেগেও যান। অহঙ্কারি হিসেবেই আফগানিস্তানে তার ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।’
রোববার আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় গনি জানান, আফগানবাসীর কথা ভেবেই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু আসলে আফগানবাসীর কাছে গনির আর ফেরার রাস্তা নেই বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। গনি চলে যাওয়ার পর তার একসময়ের প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ বলেন, ‘প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। উপরওয়ালার কাছে রেহাই পাবেন না। জবাব দিতেই হবে তাকে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের পূর্বাঞ্চলের এক রাজনীতিক সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘আফগানিস্তানের কলঙ্ক গনি। গোটা সময় ধরে দেশের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছেন। তালিবান আগ্রাসন নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছিলেন দেশবাসীকে।’
কাবুল দখল হয়ে যাওয়ার আগে শনিবার টেলিভিশন বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গনি। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাবুলে ঢোকার দুই প্রদেশ মাজার-ই-শরিফ এবং জালালাবাদ দখল করে নেয় তালিবান। এ ব্যাপারে গনি কিছু জানতেন না, এমনটা হতে পারে না বলে দাবি বালখ প্রদেশে আফগান সেনার প্রাক্তন কমান্ডার আতা মোহাম্মদ নূর। তিনি বলেন, ‘আগাগোড়া গোটাটাই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল। কাপুরুষের মতো আচরণ করেছেন গনি।’ তার অভিযোগ, ‘সরকার এমন ভাব করছিল যেন, তালিবানের একের পর এক প্রদেশ দখল তাদের রণকৌশলের অংশ। সঠিক সময়ে প্রতিহত করা হবে। আসলে ভিতরে ভিতরে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তাই একটি শব্দও খরচ না করে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন গনি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আফগানিস্তানের এক প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‘ইতিহাসও তাকে করুণা করবে না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেক আগেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন উনি। চাইলে সুষ্ঠুভাবে অনেক আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারতেন। তা না করে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাগরিকদের অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। তার পর সময় বুঝে নিজে সরে পড়েছেন।’
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা