তিউনিসিয়ার ব্যাপারে রশীদ ঘানুসির প্রত্যয়

রশীদ ঘানুসি | Aug 12, 2021 04:26 pm
রশীদ ঘানুসি

রশীদ ঘানুসি - ছবি সংগৃহীত

 

২৬ জুলাই সকালে আমি এবং আমার সহকর্মীরা (আমরা সবাই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য) দেখতে পেলাম তিউনিসের উপকণ্ঠে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবন সেনাসদস্যরা ট্যাংক দিয়ে ঘিরে রেখেছে এবং প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদের নির্দেশে আমাদের পার্লামেন্টে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে।

আগের রাতে এক টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট সাঈদ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা দেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অত্যন্ত চমকপ্রদ বিষয়টি হলো- নির্বাচিত পার্লামেন্টের কার্যক্রম স্থগিত করা। তিনি পার্লামেন্ট সদস্যদের তাদের পার্লামেন্টারি দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেন। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেন। এই পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে দশকব্যাপী তিউনিসিয়ানরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে তার ফলাফলকে ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন কায়েস সাঈদ। আমি মনে করি, তার এই পদক্ষেপ অগণতান্ত্রিক এবং তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী।

তার এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অবস্থান গ্রহণ করি। কিন্তু পরে ওই অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং অন্যদেরকে একইভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়েছি। কারণ যেকোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তপাতের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমি উদ্বিগ্ন।

প্রায় একটি সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং আমরা এখনো একটি অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছি। পার্লামেন্টের বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে এই সঙ্কটের সমাধানের আশায় এই নিবন্ধ লিখছি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতার ব্যাপারে তিউনিসিয়ার জনগণের অসন্তোষ বৈধ। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ও মৃত্যু বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সঙ্কট মোকাবেলায় ইতিবাচক ফলাফলের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমরা একটি কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক সঙ্কটেরও মোকাবেলা করছি। এক দশকের বহু আগে তিউনিসিয়ার ফল ও সবজি বিক্রেতা মুহাম্মদ বুআজিজি নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মাহুতির মাধ্যমে আরব বসন্তের পক্ষে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার জীবনদানের মাধ্যমে আরব বসন্তের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশটির পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। স্বৈরশাসনামলে তিউনিসিয়া, অবাধ দুর্নীতি, ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন এবং অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত অবস্থায় নিপতিত হয়েছিল। এখনকার অসন্তোষ স্বাধীনতার জন্য নয় বরং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপারে অসন্তুষ্টির কারণে।

বুআজিজি এবং সব ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হাজার হাজার তিউনিসিয়ান কিসের জন্য সংগ্রাম করেছিল আমাদের অবশ্যই তা কখনো ভুলে গেলে চলবে না। আইনের শাসন এবং ক্ষমতার বিভাজনকে নিশ্চিত করে আমরা একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে চাই। ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরা নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই এবং সর্বোপরি, আমরা ব্যালট বাক্সের প্রতি সম্মান জানানোর ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিউনিশিয়ার ২০১৪ সালের সংবিধান আরব বিশ্বের মধ্যে অত্যন্ত প্রগতিশীল একটি সংবিধান হিসেবে প্রশংসিত। কিন্তু বর্তমানে এই সংবিধানকে কায়েস সাঈদ ছিন্নভিন্ন করে ফেলছেন।

জনাব সাঈদ বলেছেন, দেশে সামাজিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এই পদক্ষেপগুলো অস্থায়ী। পক্ষান্তরে, এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ অনুসরণ করা হয়েছে। তিনি সংবিধানের ৮০ নং ধারা বা বিধির উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আসন্ন বিপদের’ মাধ্যমে দেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার বিরুদ্ধে তাকে অতিরিক্ত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ৮০ ধারায় বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে তাকে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী এও স্পিকারের সাথে আলোচনা করতে হবে এবং এই সময়ে প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করার জন্য পার্লামেন্টকে অবশ্যই অধিবেশন অব্যাহত রাখতে হবে। পার্লামেন্ট স্থগিত করে তিনি, ওই ধারার অধীনে যে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় কথা বলা হয়েছে সেটাকে অসম্ভব করে তুলেছেন।

তিউনিসিয়ার জনগণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল প্রেসিডেন্টের তৎপরতার মাধ্যমে সেটাকে ছিন্ন করা হয়েছে।

কিছু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধী পক্ষ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং ইসলামপন্থীদের মধ্যকার আদর্শিক মতপার্থক্যের ধুয়া তুলে এই অসাংবিধানিক ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। দু’পক্ষই যোগ্য নয়। আমরা আমাদের দল আন নাহদাকে একটি মুসলিম গণতান্ত্রিক পার্টি হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু এখানে যে টার্গেট করা হয়েছে সেটা সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলকে নয় বরং সেটা হলো- পুরোপুরিভাবে গণতন্ত্রকে।

সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হচ্ছে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর একটি হামলা। এ ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে তীব্র নিন্দা জানাতে হবে। আরব বসন্তের মাধ্যমে তিউনিসিয়ায় একমাত্র গণতন্ত্রের অভ্যুদয় ঘটেছে এবং তা অব্যাহত ছিল- অনেক আরববাসীর জন্য গণতন্ত্রের ব্যাপারে এটা একটা আশার সঞ্চার করেছিল।

তিউনিসিয়ায় অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা গভীরভাবে গেড়ে বসা কাঠামোগত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে গিয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিশাল কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা একটি নির্বাচনী আইনের সাথে লড়ে যাচ্ছিলাম। ওই আইনে একটি পার্লামেন্ট গঠিত হয়। এর ফলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার প্রয়োজন হয়। গণতন্ত্র বিনির্মাণ বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং করোনা মহামারী মোকাবেলার গতি ছিল ধীর। কিন্তু এসব সঙ্কটের কারণে সংবিধান ছিন্নভিন্ন করা এবং গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তোলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এক ব্যক্তির শাসন আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান নয়। একনায়কতন্ত্র অধিকতর দুর্নীতি, ব্যক্তি অধিকার খর্ব এবং অসাম্যের সৃষ্টি করে।

আন্তরিকভাবে আশা করি, জনাব সাঈদ তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। এখন তিনি কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ওই সব পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তিউনিসিয়ার পশ্চিমা ও আঞ্চলিক মিত্রদের অবশ্যই তাকে সমর্থন করা উচিত।

পার্লামেন্টকে অবশ্যই কাজ করতে দিতে হবে যাতে ভোটের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার মহামারী এবং বেকারত্ব মোকাবেলায় অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আমি আশা করি, বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি সর্বোত্তম পথ বের করার জন্য কায়েস সাঈদ জাতীয় সংলাপ শুরু করবেন।

গণতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলার পরিবর্তে, আমাদের অবশ্যই আমরা যা অর্জন করেছি তা রক্ষা করতে হবে। আমরা আগে দেখেছি, এক ব্যক্তির হাতে কিভাবে সব ক্ষমতা একত্রিত বা কেন্দ্রীভূত করে আমাদের দেশকে হতাশাগ্রস্ত একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। তিউনিসিয়া অতীতে জাতীয় সংলাপ বা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যার সমাধান করেছে। আমরা সঙ্কট নিরসনে পুনরায় সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম।

লেখক : ২০১৯ সালে তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন। তিনি আন নাহদা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us