বেহায়া লকডাউন
লকডাউন - ছবি : সংগৃহীত
এক.
২০২১ সালের কোরবানির ঈদ। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে আরিচা-কাজিরহাট ঘাট পার হয়ে পাবনা যাব। ঈদের দুদিন আগে রাত ৯টায় মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে একটা বাসে উঠে বসলাম। মতিঝিল থেকে গাবতলীর ভাড়া ৫০ টাকা। স্বাভাবিক সময় ভাড়া নেয় ২৫-৩০ টাকা। দুই সিটে একজন করে বসতে হবে। মতিঝিল থেকে গুলিস্তান গিয়ে বাসটি প্রায় ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠাতে লাগল। দুই সিটে একজন হিসেবে সব সিটেই যাত্রী বসা শেষ। কিন্তু এখনো যাত্রী উঠছেই। বাসের ড্রাইভার ঘোষণা দিলেন দুই সিটে একজন নয়; এক সিটে একজন করে বসেন। ভাড়া কিন্তু ৫০ টাকাই। ঘোষণা শুনে বেশ কয়েকজন যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। তাদের মধ্যে আমিও।
তিনটা বাস পরিবর্তন করে প্রায় ২ ঘন্টা ধরে কলেজ গেট পর্যন্ত গেলাম। এরপর শুরু হলো জ্যাম। সামনে যত দূর দেখা যায় তাতে বুঝলাম, এই জ্যাম গাবতলী পর্যন্ত আছে। তাই সময় নষ্ট না করে কলেজ গেট থেকেই হাঁটা শুরু করলাম। অনেকেই হাঁটছে। হেঁটে হেঁটে যখন গাবতলী পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটাতে তখন রাত ১২টা। কিন্তু পুরো ঢাকা যেন তখনো ভর দুপুর। প্রতিটি রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ।
গাবতলী টু আরিচা ঘাটের একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ভাড়া ৩০০ টাকা। স্বভাবিক সময় ভাড়া নেয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ভাড়া নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। বাসে উঠতে পারাটাই কথা। ইঞ্জিন কাভারেও তিনজন বসল। সামনে তাকিয়ে দেখলাম ড্রাইভার ট্রাফিক পুলিশের সাথে কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছে। সিট থেকে উঠে গিয়ে দেখলাম ড্রাইভারের হাতে ১০০ টাকার একটা নোট। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ ১০০ টাকা নেবে না। জানতে চাইলাম, পুলিশ টাকা যাচ্ছে কেন? ড্রাইভার জানালেন, বাসের ছাদে কয়েকজন লোক উঠেছে তাই পুলিশ টাকা চাচ্ছে।
ড্রাইভারকে বললাম, ভাই গাড়ির যে কন্ডিশন তাতে ছাদে লোক নেয়া কি ঠিক হবে? ড্রাইভার নীরব থাকলেন। পুলিশকে ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে দিলেন। মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে গাড়ির সবাইকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ি কর্তৃপক্ষ টাকার লোভে প্রতি সিটেই লোক নিয়েছে আবার ছাদেও লোক তুলেছে। এই অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্র বেতন দিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ প্রশাসন নিয়োগ করেছে। কিন্তু ওই রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা সামান্য কিছু অবৈধ টাকার বিনিময়ে কোনো চিন্তা ছাড়াই এতগুলো মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন। বিষয়টি নিয়ে কেউ প্রতিবাদও করলো না। নিজেও কোনো প্রতিবাদ না দিয়ে আল্লাহকে বল্লাম, সবাইকে ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছে দিও মাওলা।
রাত বাজে ৩টা। আরিচা ঘাটে গিয়ে নামার সাথে সাথেই দুই ব্যক্তি ফেরির টিকেট নিয়ে হাজির। টিকেট হাতে নিলাম। টিকেটের গায়ে লেখা আছে ২৫ টাকা। কিন্তু এরা নিচ্ছে ৩০ টাকা। কারো কাছে হয়তো বেশিও নিচ্ছে। আমি ২৫ টাকাই দিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাড়ি পৌঁছালাম কোনো রকম বিপদ-আপদ ছাড়াই। আল-হামদুলিল্লাহ।
দুই.
লকডাউনে সবার অফিস বন্ধ থাকলেও সাংবাদিকের কোনো বন্ধ নেই। শরীরের কন্ডিশন ভালো না থাকায় ঢাকায় ফিরতে দুদিন দেরি করেছি। ঈদের পর লকডাউনের তৃতীয় দিনে পাবনা থেকে কাজির হাটে আসতে রাস্তায় কমপক্ষে ৫ জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট। পুলিশের একদম কাছাকাছি গিয়ে ভ্যান-রিকশা যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে। চেকপোস্ট পার হয়ে অন্য রিকশায় উঠতে হচ্ছে। নারী, শিশু, বয়স্ক মানুষের ভোগান্তির ভয়াবহ দৃশ্য বসে বসে দেখছে পুলিশ। এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে শিশু সন্তান। খুব কষ্ট করে পুলিশের চেকপোস্ট পার হচ্ছে অনেক নারী।
পুলিশের সামইেন এক রিকশা থেকে নামা আর অন্য রিকশায় ওঠা। মনে হলো মানুষের এতটুকু ভোগান্তি নিশ্চিত করতেই রাস্তায় চেকপোস্ট বাসিয়েছে রাষ্ট্র। কারণ যে উদ্দেশ্যে লকডাউন দেয়া হয়েছে বাস্তবে তার উল্টো হচ্ছে। শারীরিক দূরত্ব মানছে না কেউ। রাস্তায় গাড়ি বলতে রিকশা-ভ্যান ছাড়া কিছু নেই। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি যাত্রী নিয়ে চলছে সব রিকশা-ভ্যান। সে বিষয়ে পুলিশের কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি হলো গাড়িতে উঠে চেকপোস্ট পার হওয়া যাবে না। হেঁটে হেঁটে পার হচ্ছে শত শত মানুষ। একই দৃশ্য দেখলাম পাবনা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার গাবতলী পর্যন্ত। কাঠফাটা রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে আমিন বাজার থেকে গাবতলী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে শত শত মানুষ। সারাদেশেই কম বেশি একই চিত্র দেখা গেছে। হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছেছে হাজার হাজার মানুষ।
তিন.
লকডাউনের সপ্তম দিনে একজন শিল্পপতির সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য মতিঝিল থেকে উত্তরায় যাব। অফিসের গাড়ি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় রিকশা করে রওনা হলাম। যাওয়া আসার ৭০০ টাকা খরচ হলো। করোনায় কমেছে বেতন। কিন্তু বেড়েছে খরচ। কী কষ্টে আছে মানুষ সেটা নিয়ে যেন কারো চিন্তাই নেই। শুধু লকডাউন আর লকডাউন। কিন্তু লকডাউন তো কার্যকর হয় না। শুধু খরচটা বেড়ে যায়। লকডাউন কার্যকর করার সক্ষমতা না থাকলে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কারণ লকডাউন কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রের পেশি শক্তি যথেষ্ট নয় বলে মনে করি। মানুষের পেটে খাবার দিতে না পারলে শুধু পেশি শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মতো অসম আয়ের দেশে লকডাউন কার্যকর হবে না; এটাই স্বাভাবিক।
চার.
লকডাউনের অষ্টম দিন। হেঁটে হেঁটে অফিসে যাচ্ছি। দুপুরের খাবার সাধারণত হোটেল থেকে নিয়ে অফিসে বসে খাই। কিন্তু আজ অনুসন্ধানের জন্য হোটেলে বসেই খাওয়ার ইচ্ছে করলাম। হোটেল মালিককে বললাম, ভাই এখানে খাওয়া যাবে না? তিনি বললেন, ওই কোনার দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যান।
ভেতরে গিয়ে দেখলাম, এক টেবিলে ছয়জন বসে খাচ্ছে। স্বাভাবিক সময় যেখানে তিনজন বসে। পুরো বিষটি বুঝতে হলে আরো কিছু সময় থাকতে হবে। তাই সিট ফাঁকা হলে হাত ধুয়ে আমিও খাবার টেবিলে বসলাম। খাওয়া শুরু করতেই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ। ওয়েটার ঘোষণা দিলেন, সবাই আস্তে কথা বলেন। পুলিশ যাচ্ছে।
খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাগলা গোছের লোক। বয়স ২৫-৩০ হবে। ওয়েটার লোকটিকে বার বার চলে যেতে বলছে। কিন্তু পাগল লোকটি হাতের ইশারায় বারবার খাবার খেতে যাচ্ছে। মনে হলো লোকটি কথা বলতে পারে না। সবাই খাচ্ছে। পাগলের দিকে কারো নজর নেই। হঠাৎ একজন লোক ওয়েটারকে বললেন, ‘ওই ছেলেটাকে (পাগল) দুই প্লেট ভাত আর একটা ডিম দাও।’ এতক্ষণে পাগলের মুখে হাসি ফুটেছে। আমার পাশে একটা সিট ফাঁকা হতেই পাগল বসে পড়ল। ডিম দিয়ে এক প্লেট ভাত খাওয়া প্রায় শেষ।
আমি ভর্তা দিয়ে খাওয়া শেষ করেছি। মাছের অর্ডার দিলাম। খেয়াল করে দেখলাম পাগলের ডিম শেষ। এখনো কিছুটা ভাত প্লেটে আছে। চিন্তা করলাম, আমার মাছের অর্ধেকটা পাগলকে দিয়ে দেব। অর্ধেক মাছ বাটিতে রেখে বাকিটুকু দিয়ে খাচ্ছি। আবার চিন্তা করলাম, এতগুলো মানুষের মধ্যে একটা বোবা পাগলকে অর্ধেক মাছ কিভাবে দেব? আর পকেটে এত বেশি টাকাও নেই যে পাগলকে পুরো একটা মাছ খাওয়াব। আরো কী কী চিন্তা করতে করতে বোবা পাগল বলে উঠল, ‘তোমার মাছটা আমারে দিবা।’ অন্য কিছু চিন্তা করার আগে বললাম, ‘নিয়ে নাও।’ এর পর ভাবলাম, আমি যারে বোবা পাগল ভেবেছি সে আসলে শেয়ানা পাগল। আরো এক প্লেট ভাত আর ঝোল নিয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল পাগল। খেয়াল করে দেখলাম, প্রায় এক প্লেট ভাত নষ্ট করেছে পাগল। কিছুক্ষণ আগে এক প্লেট ভাতের জন্য বোবার অভিনয় করেছে যে মানুষটি; মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ওই মানুষটি এক প্লেট ভাত নষ্ট করল।
লেখক : সাংবাদিক
saifullahhimel@gmail.com