‘সাম্প্রদায়িক’ সহিংসতা : ভূমিদস্যুতা ও রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ!

‘সাম্প্রদায়িক’ সহিংসতা : ভূমিদস্যুতা ও রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ! - ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি খুলনার রূপসা উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি মন্দির ও হিন্দু মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর হয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিবিসি বাংলা বলছে, ‘তবে মামলাটিতে কাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা স্পষ্ট করেনি পুলিশ’ (৮ আগস্ট ২০২১)।
পুলিশ কেন গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় প্রকাশ করেনি, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কারণ অতীতের মতো সর্ষের ভেতরের ‘ভূত’ বের হয়ে যেতে পারে, যা সম্ভবত কোনো ক্ষমতাধর রাজনৈতিক মহলের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, খুলনার রূপসার ঘটনাটিতে শতাধিক দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র (রামদা, চাপাতি ও কুড়াল) নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালায়। কিন্তু তদন্তের আগে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত ও গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় প্রকাশ করবে না বলে জানিয়েছে সেখানকার প্রশাসন।
অন্যদিকে, রূপসা উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও হামলার ঘটনার দায়ের করা মামলার বাদী শক্তিপদ বসুর কাছে ডয়চে ভেলে কারা হামলা করেছে জানতে চাইলে তিনি কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই পাশের একটি গ্রামের জামায়াত-বিএনপির সমর্থকদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতায় এবার সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের তথাকথিত সাম্প্রদায়িক ব্লেইম গেইমের ফাঁদে পা দেয়নি। কারণ এ বছরের মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে লুটপাট ও হামলার ঘটনায় প্রথমদিকে দেশের মূলধারার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম হামলাকারীদের ‘হেফাজতের সমর্থক’ বলে প্রচার করলেও পরে হামলার মূল হোতার রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর সেসব গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও পেশাগত নৈতিকতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তবে লক্ষণীয়ভাবে এবার খুলনার রূপসার ঘটনায় সেসব গণমাধ্যম তথাকথিত সাম্প্রদায়িক ব্লেইম গেইম পরিহার করে হামলাকারীদের ‘দুর্বৃত্ত’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের এবারের এই সতর্কতা পেশাগত দিক থেকে অবশ্যই ইতিবাচক বলে মনে করি।
যাই হোক, কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া ও সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে সময়ান্তরে ঘটে যাওয়া ‘সাম্প্রদায়িক’ হামলাগুলোর বিচার আজও হয়নি। বিগত এক দশকে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটা উল্লেখযোগ্য কোনো হামলার বিচারই কার্যত করা সম্ভব হয়নি। এমন অভিযোগ ও ধারণা ইতোমধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি কায়েমি ভূমিদস্যু চক্র সংখ্যালঘুদের জমি দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে তাদের ভিটেমাটিতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। আবার এহেন জঘন্য উদ্দেশ্য আড়াল করতে প্রধান বিরোধী দলসহ ইসলামপন্থীদের ওপর সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে ক্ষমতাসীনরা। এই সুযোগে একটি তথাকথিত প্রগতিশীল ও সেকুলার গোষ্ঠীও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘মৌলবাদ’-এর হুজুগ তুলে দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো শুরু করে। বস্তুতপক্ষে, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর অভিমুখ এই ত্রি-চক্রের বৃত্তেই এখনো আটকে আছে। সুতরাং, এসব হামলার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে আসা যৌক্তিক হয়ে পড়ে যে, সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর হামলাগুলো নিছক সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং এর নেপথ্যে মূলত দুটি বিষয় জড়িত : ভূমিদস্যুতা ও রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের নেপথ্যে ভূমিদস্যুতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন প্রথম আলোতে একটি কলামে লিখেছেন : “প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এগুলো ঝোঁকের মাথায় নিছক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনে থাকে মূলত ভূমি দখলের রাজনীতি। হামলাকারীরাও ‘সাধারণ’ কোনো মানুষ না, ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় যাদের মূল লক্ষ্য থাকে ভূমি দখল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পেয়েছি, রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরা প্রশ্রয় পায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে উৎসাহিত করে, যে পর্যন্ত না তারা ভূমি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় সেই হামলাকারীদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে জমিটি বেচে দেয় তারা। ক্ষমতার ক্রমাগত চাপে এবং তাপে তত দিনে তারা জেনে যায়, বাপ-দাদার ভিটাবাড়িতে তারা আর থাকতে পারবে না” (২২ মার্চ ২০২১, প্রথম আলো)।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা তুলে ধরেন, কিভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর নানারকম অত্যাচার চালিয়ে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে উচ্ছেদপূর্বক তাদের ভিটেমাটি ও সম্পত্তি জবরদখল করা হয়। এক্ষেত্রে সংগঠনটি বর্তমান সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের নাম ও পরিচয়সহ একটি তালিকা প্রকাশ করে। এর ফলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত তখন প্রশাসনিকভাবে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগও করেন। বাংলা ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রানা দাসগুপ্ত বলেছিলেন, 'সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে দুর্বৃত্তরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, জায়গা-জমি, দেবোত্তর সম্পত্তি, গির্জা ও বিহারের সম্পত্তি জবরদখলের উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে। এ জবরদখলের সঙ্গে সরকারি দলের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্যের নাম বেরিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না' (২৪ আগস্ট ২০১৫, ডয়চে ভেলে)।
সুনামগঞ্জের শাল্লায় আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। সেখানে সংখ্যালঘু নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক ডজন বাড়িঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে হামলাকালীন কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজ না থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের আগেই মূলধারার গণমাধ্যমে ‘হেফাজতের সমর্থকদের হামলা’ বলে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু পরে পিবিআই-এর তদন্তে বেরিয়ে এলো ভিন্ন বাস্তবতা! শাল্লার ঘটনার মূল হোতা শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে স্থানীয় ইউপি সদস্য এবং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। তাকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ জানায়, শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার পেছনে ‘জলমহাল’ নামে একটি ইজারাকৃত দিঘীর দখল সংক্রান্ত বিরোধ ছিল মূল কারণ (২০ মার্চ ২০২১, ঢাকা ট্রিবিউন)। সুতরাং, কারা সংখ্যালঘু নির্যাতক এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি দখল করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এছাড়া রামু, নাসিরনগর থেকে সর্বশেষ শাল্লার ঘটনার একটি লক্ষণীয় মিল হলো, হামলার ঠিক আগে অমুসলিম কোনো যুবকের তথাকথিত ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বিতর্ক ও উত্তেজনা তৈরি করে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার পথ সুগম করা হয়। অথচ পরে সেসব বিতর্কিত ফেসবুক পোস্ট কিংবা পোস্টদাতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না! শাল্লায় হামলার আগের দিন ধৃত হিন্দু যুবক ঝুমন দাসের ছবি কিংবা তার সেই বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টের কোনো স্ক্রিনশট আজ পর্যন্ত মূলধারার গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। প্রতিটি হামলার ঘটনায় এ ধরনের ফেসবুক পোস্ট ও সংশ্লিষ্ট আইডির মালিক রহস্যই থেকে গেছে।
ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণেই হোক বা পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই হোক, এ দেশে কোনো সাধারণ অমুসলিম ব্যক্তির পক্ষে ইসলাম-অবমাননা করে পাবলিকলি ফেসবুক পোস্ট দেয়ার ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়। তথাপি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাই এটা ধরে নেয়া সঙ্গত যে কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর স্যাবোট্যাজ বা অন্তর্ঘাতমূলক হামলার পরিকল্পনারই অংশ এ ধরনের বিতর্কিত ফেসবুক পোস্ট– যার অস্তিত্ব পরে খোদ আদালতেও প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা যার ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হয়েছিল, সেই রসরাজ দাসের আইনজীবী মো. নাসির মিয়ার বক্তব্য হলো, 'রিপোর্ট অনুযায়ী ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তীতে যেহেতু ক্ষমা চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়। তাই ধারণা করা যায় অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। তবে সেই স্ট্যাটাস কে দিয়েছে তা নিশ্চিত নয়। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে অপরাধী চিহ্নিত হয়ে রসরাজ দাস নির্দোষ প্রমাণিত হবেন' (২১ অক্টো. ২০১৮, মানবজমিন)। এক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য ‘জজমিয়া নাটক’ সাজানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
অন্যদিকে, আমাদের দেশের মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যথেষ্ট উদার মানসিকতা বিদ্যমান। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা ঘটলেও তারা সরকার ও প্রশাসনের কাছে বিচার দাবি করে আইনিভাবে সেটার সুরাহা হোক তা চায়। অন্ততপক্ষে ফেসবুক পোস্টের জের ধরে সদলবলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও জানমালের ওপর হামলা-ভাঙচুর তারা করার কথা নয়। কেননা বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে হামলাগুলো সংগঠিত করে মূলত কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক চক্র, যাদের উদ্দেশ্য অসহায় সংখ্যালঘুদের জমি দখল করা।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ঈর্ষণীয়। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে অতর্কিতভাবে সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। অন্তরালের বাস্তবতা বিবেচনায় এসব হামলাকে ঢালাওভাবে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ হিসেবে দেখার অবকাশ আর নেই। কারণ এ ধরনের হামলাকে ভিন্নভাবে দেখার বাস্তবতা হাজির রয়েছে, যদিও একশ্রেণীর সেকুলার মিডিয়া ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘মৌলবাদে’র হুজুগ তুলে এ ধরনের হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য, অনুঘটক ও সংঘটনকারীদের প্রকারান্তরে আড়াল করে দেয়। এতে মূলত কায়েমি স্বার্থান্বেষীদেরই পোয়াবারো। ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়না।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
tareqislampt@gmail.com