কী হতে যাচ্ছে আফগানিস্তানে?

তানসেন রোজ | Aug 11, 2021 07:13 am
কী হতে যাচ্ছে আফগানিস্তানে?

কী হতে যাচ্ছে আফগানিস্তানে? - ছবি : সংগৃহীত

 

আফগানিস্তান হামলার ২০ বছর পূর্তির আগেই আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সেনারা আফগান ত্যাগ করছে। বলা যায়, এক প্রকারে লেজ গুটিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে সৈন্যরা।

আফগানে যুক্তরাষ্ট্রের কী অর্জন?

টুইন টাওয়ার হামলার পর আল কায়েদাকে সন্দেহভাজন হিসেবে শত্রুজ্ঞান করে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে জুনিয়র বুশ নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী আফগান যুদ্ধের যুক্তরাষ্ট্রের খরচ গত ২০ বছরে ৮২২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া পাকিস্তানে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার তিন শ' বারোজন সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ হাজার ৬৬ জন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো সৈন্য নিহত না হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি।

আফগানিস্তানে জড়ানোর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল দুটি। তালেবানকে ক্ষমতা থেকে নামানো, আর আল কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করা। আপাতত দৃষ্টিতে দুটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র সফল। আল কায়েদার উত্থান রুখে দেয়ার পাশাপাশি ওসামা বিন লাদেনকেও হত্যা করার সম্ভব হয়েছে। তালেবানকেও ক্ষমতা থেকে নামিয়ে পশ্চিমামদদপুষ্ট একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সফলতা কতটুকু ভঙ্গুর?

আফগান থেকে সেনা সরানোর ঘোষণার পরপরই তালেবান হামলা জোরদার করেছে। তালেবানের দাবি অনুযায়ী, ৮০ ভাগ আফগানিস্তান দখল করেছে। যদিও আফগান সরকার তাদের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।

মাত্র পাঁচ দিনে আটটি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন ঘটেছে তালেবানের হাতে। এর মাঝে রয়েছে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কুন্দুজ নগরী। আফগান সরকার পুনরায় দখলের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও তাদের সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

অবশিষ্ট ন্যাটো সৈন্য মাঝে মাঝে বিমান হামলা করলেও তালেবানের অগ্রযাত্রা রুখতে তা যথেষ্ট নয়। সিআইএর ফাঁস করা তথ্য ছয় মাসের মধ্যে তালেবানের আফগান দখলের কথা বললেও তার চেয়েও অনেক দ্রুতই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এভাবে হামলা চালাতে থাকলে এ বছরের মাঝেই পুরো দেশ দখল করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তালেবানের।

আল কায়েদা কতটুকু নিশ্চিহ্ন হয়েছে তা এখনই বলা মুশকিল। আল কায়েদার বর্তমান খুব বেশি আনাগোনা না থাকলেও তারা যে তালেবানকে সাহায্য করছে না সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

বাইডেন কি চায়?

আমেরিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়েই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা নিয়ে কাজ শুরু হয়। তালেবানের সাথে আলোচনা শুরুর কাজও ট্রাম্পই করেছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পূর্বসূরির পথেই হাঁটছেন। আফগানিস্তান এখন আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। তালেবানও এখন আর তত বেশি হুমকি নয়। বাইডেন বলেছেন 'আফগানিস্তানের সমস্যা তারাই মিটিয়ে ফেলতে পারবে।'

যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রত্যাশার সাথে বাস্তবতার মিল নেই। অন্যদিকে জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যানেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাওয়ার ফের আফগানিস্তানে জার্মান সৈন্য প্রেরণের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। কাবুলে স্বল্প সংখ্যক রাখবেন কি না সেটাও পরিষ্কার করছে না ন্যাটো জোট।

বাইডেনের সামনে এখন আরো বড় হুমকি এসে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন, তারপর ইসলামিক যোদ্ধা এবং এখন নতুন হুমকি চীন ও রাশিয়া। চীনকে মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্য থেকেও সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে ফেলছেন। ইরাক থেকে প্রত্যাহার করে ফেলবেন খুব দ্রুতই।

বাইডেনের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ : ট্রাম্পের আমেরিকা বিচ্ছিন্নকরণ নীতি থেকে বের করে পূর্বের বন্ধুদের সাথে আবারো সম্পর্ক উন্নয়ন, দ্বিতীয়ত, চীন রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস। কারণ এই প্রভাব সিরিয়া, লিবিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এমনকি এশিয়াতে যেভাবে বাড়ছে, অতিশিগগিরই তা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যথেষ্ট।

একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ক্রেতারা যেভাবে চীন, রাশিয়ার সস্তা কিন্তু সমমানসম্পন্ন অস্ত্রের দিকে যেভাবে ঝুঁকছে, তা আমেরিকার অস্ত্রের বাজার হুমকির মুখে ফেলবে। বিপরীতে আফগানিস্তান তার খরচের প্রতিদান দিতে পারবে না।

আফগানিস্তানে কী হতে যাচ্ছে?

এটা সহজেই অনুমেয় এভাবে চলতে থাকলে তালেবানের হাতে আফগানিস্তানের পতন অনিবার্য। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি তালেবানবিরোধী মিলিশিয়াদেরকে তালেবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেও এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়ার খবর মিলেনি।

কিছু এলাকায় স্থানীয় অসামরিক মানুষরা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। কিন্তু আক্রমণাত্মক তালেবানের সামনে তা অপ্রতুল। ধীরে ধীরে হয়তো আরো বেশি সাধারণ মানুষ যুক্ত হবেন তালেবানবিরোধী যুদ্ধে। তার সাথে তালেবানবিরোধী যোদ্ধারাও মাঠে নামলে লড়াই হবে চতুর্মুখী।

আফগানিস্তানে তখন গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে সিরিয়ার মতো। তার আঁচ যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও লাগবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান, ভারত ও মধ্য এশিয়া উত্তপ্ত হতে পারে আবারো।

শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কী করবে?

আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট আগামী এক মাসের মাথায় চলে যাওয়ার পর আপাতত আর এমুখো হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাঝে মাঝে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালাতে পারে। এয়ারবেস হিসেবে মধ্য এশিয়ার কোনো একটি ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে।

চীন ইতোমধ্যেই তালেবানের সাথে বৈঠক করেছে। উইঘুর জনগোষ্ঠীকে তালেবানের পক্ষ হতে কোনো সমর্থন যেন না দেয়া হয় সেই নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে। আপাতত চীন ও রাশিয়া চুপ থাকার মাঝেই নিজেদের কল্যাণ দেখছে। যারা আফগানিস্তান দখল করবে এ দু'রাষ্ট্র তাদেরকেই সমর্থন করবে।

তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত হলেও তারা কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগানের সাথে বাইডেন একমত হলেও এখনো সবুজ সংকেত দেয়া হয়নি। পাকিস্তান ও হাঙ্গেরিকে নিয়ে তুরস্কের পরিকল্পনার কথা এখনো জানা যায়নি।

পাকিস্তানের ইমরান খান ইতোমধ্যে সাক্ষাতকারে বলেছেন, তালেবান আফগানিস্তান দখল নিলে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হবে। সিআইএ থেকে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি চাইলেও নাকচ করে দেয়া হয়েছে।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে ভারত। ভারতের অর্থায়নে নির্মিতব্য বাঁধে একাধিকবার হামলা করেছে তালেবান। তাদের প্রায় চার শ' প্রজেক্ট রয়েছে আফগানিস্তানে। তালেবান ক্ষমতা দখল করলে এসব প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে ভারত শঙ্কিত।

আফগানিস্তানে তালেবানের জয় ও দখল কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদেরকেও উস্কে দিতে পারে। এমনকি তালেবানের পক্ষ হতে সাহায্যও আসতে পারে কাশ্মিরে। এ ভয়ও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভারতকে। ভারতীয় লোকজনকে আফগানিস্তান ছাড়ার অনুরোধ করা হয়েছে ইতোমধ্যেই।

আফগান সমস্যার সমাধান কোন পথে?

আফগান সমস্যার চর্মদৃষ্টিতে কোনো সমাধান নেই। সিরিয়ার লিবিয়ার পর আফগানিস্তান হতে পারে শক্তিশালী দেশগুলোর পাঞ্জা খেলার জায়গা। যদিও আমেরিকা চলে যাচ্ছে, তবে চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করলে আবারো ফিরবে কি না তা ভবিষ্যৎই বলে দিবে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গুরুত্বারোপ করেছেন তালেবান ও বর্তমান সরকারের মাঝে সমঝোতার মাধ্যমে দুই পক্ষের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনে। তবে অপরিমেয় তালেবান এই প্রস্তাব কতটুকু মানবে তাও পরিষ্কার না।

ইরানের নেতৃত্বাধীন তালেবান-আফগান সরকার সমঝোতাও ভণ্ডুল হয়ে গেছে। কারণ তালেবানের চাহিদা এখন অনেক। তারা সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ চায়। তবে তালেবান যাদেরকে পছন্দ করে যেমন- কাতার, পাকিস্তান, চীন, ইরান এমন দেশগুলোকে নিয়ে সংলাপে বসলে হয়তো রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে।

তালেবান এখন বাস্তবতা। ফলে তাদেরকে রাজনৈতিক দল তৈরি করে সাধারণ মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষই সিদ্ধান্ত নিবে তারা তালেবানকে প্রত্যাখান করবে নাকি গ্রহণ করবে।

আফগানিস্তানে আর সামরিক সমাধান নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে ফের শান্তি আসবে কি না তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমাধানের ওপর। তবে আফগান সরকার ও তালেবানের লড়াইয়ের মাঝে পরাশক্তিরাও নাক গলালে নতুন উনুন হবে এ দেশটি।

ফলে, শান্তি শব্দটি অধরাই থেকে যাবে দেশটির জনগণের।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us