পরমাণু অস্ত্রের হালচাল

ইকতেদার আহমেদ | Aug 09, 2021 08:01 pm
পরমাণু অস্ত্র

পরমাণু অস্ত্র - ছবি : সংগৃহীত

 

পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিটির সংক্ষিপ্ত নাম এনপিটি (Non-Proliferation Treaty or NPT)। এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। এ চুক্তিটি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিস্তার রোধ এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতা বৃদ্ধি। জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের জন্য ১৯৬৮ সালে চুক্তিটি উন্মুক্ত করা হয় এবং এর দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৭০ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার ২৫ বছর পর ১৯৯৫ সালে এটিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো মিলিত হয় এবং চুক্তিটির কার্যকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বর্ধিত করতে সম্মত হয়। অস্ত্র সীমিতকরণ ও নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে অন্য যেকোনো চুক্তির চেয়ে এ চুক্তিটির প্রতি অধিকসংখ্যক দেশ সমর্থন ব্যক্ত করায় এর মধ্য দিয়ে এ চুক্তিটির তাৎপর্য স্বীকৃত হয়।

২০১৬ সাল অবধি ১৯১টি রাষ্ট্র চুক্তিটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। উত্তর কোরিয়া ১৯৮৫ সালে চুক্তিটির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেও এটি মেনে চলার ব্যাপারে কখনো একনিষ্ঠ ছিল না, বরং চুক্তিটির বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ-পরবর্তী ২০০৩ সালে চুক্তিটি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। জাতিসঙ্ঘের চারটি সদস্যরাষ্ট্র কখনো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিটিকে গ্রহণ করেনি। এ চারটি রাষ্ট্রের তিনটি যথা ভারত, ইসরাইল ও পাকিস্তান। ধারণা করা হয় ইসরাইলের কাছেও পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ সুদান রাষ্ট্রটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে যোগ দেয়নি।

চুক্তিটিতে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ বলতে যেসব দেশ ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারির আগে পারমাণবিক বোমা প্রস্তুত ও এর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেসব রাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছে। এসব রাষ্ট্র হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন। অন্য যে চারটি রাষ্ট্রের কাছে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, সেগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া।
পরমাণু অস্ত্রধারী নয় এমন দেশগুলো কখনো পরমাণু অস্ত্র অর্জন করবে না এ বিষয়ে সম্মত হওয়ার প্রেক্ষিতে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা হস্তান্তর এবং পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার চূড়ান্তভাবে অপসারণে নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বিষয়ে সম্মত হয়।

প্রতি পাঁচ বছর পরপর চুক্তিটি পুনর্বিবেচনা করা হয়। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিটি বাস্তবায়নকালীন পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ২৫-৩০টি দেশ পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়া বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলেও ৪০ বছর পর দেখা গেল পাঁচটি দেশ পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরদান থেকে বিরত। এর মধ্যে চারটি দেশে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে এমন ধারণা করা হয়।
পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বিষয়ে সমালোচকদের অভিমত- চুক্তিটি এক দিকে যেমন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধে সক্ষম হবে না, অন্য দিকে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলোকে প্রেরণা জোগানো থেকে নিবৃত্ত করবে না। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সীমিত অগ্রগতি হওয়ায় সমালোচকদের পক্ষ থেকে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয় স্বীকৃত পরমাণু অস্ত্রধারী পাঁচটি দেশের সম্মিলিত অস্ত্রভাণ্ডারে ২২ হাজারের বেশি পরমাণু অস্ত্র মজুদ রয়েছে এবং এগুলোর নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে তারা খুব একটা যে ইচ্ছুক তাদের কার্যকলাপে, তা লক্ষ করা যায় না। জাতিসঙ্ঘের কিছু পদস্থ কর্মকর্তার অভিমত পরমাণু চুল্লি ব্যবহার করে এমন দেশগুলোকে পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন থেকে বিরত রাখতে তাদের পদক্ষেপ মোটেই ফলপ্রদ নয়।

চুক্তিটিতে প্রস্তাবনাসহ ১১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এটি অন্তর্নিহিত ভারসাম্য বিশিষ্ট ১. পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ, ২. নিরস্ত্রীকরণ ও ৩. পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার এ তিনটি স্তম্ভ সমন্বয়ে গঠিত। এসব স্তম্ভ একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পারস্পরিক শক্তি বৃদ্ধির সহায়ক।

চুক্তিভুক্ত সদস্য দেশগুলোর সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি ফলপ্রদ বিস্তার রোধ ব্যবস্থা, যা এক দিকে নিরস্ত্রীকরণ অগ্রগতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ভিত রচনা করবে অন্য দিকে পরমাণু অস্ত্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ে বৃহৎ সহযোগিতা সম্ভব করে তুলবে।

চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি এমন দেশ ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ১৯৯৮ সালে পুনঃবিস্ফোরণ ঘটায়। ধারণা করা হয়, ভারতের কাছে ১৫০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ভারত যদিও প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না এমন নীতিতে বিশ্বাসী, কিন্তু সম্প্রতি ভারতের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পরমাণু অস্ত্রধারী নয় এমন দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারত প্রথম পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতি মেনে চলবে। ভারতের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টার এ বক্তব্য দ্বারা প্রতিভাত যে, তার প্রতিবেশী পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ পাকিস্তান বা চীন দ্বারা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্র দু’টির বিরুদ্ধে প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে ভারত কোনোরূপ দ্বিধা করবে না। ভারতের দাবি চুক্তিটিতে ভারত স্বাক্ষর না করার অর্থ এ নয় যে, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ নয়, বরং ভারত মনে করে চুক্তিটি ত্রুটিপূর্ণ এবং এটি সর্বজনীন অবৈষম্যমূলক যাচাই ও পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সমর্থন করে না।

পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে দু’টি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ধারণা করা হয় দেশটির কাছে ১২০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ভারতের মতো পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিটি বৈষম্যমূলক। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সুস্পষ্ট অবস্থান তার সাথে বিবাদে লিপ্ত ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ায় পাকিস্তানের নিজেকে সুরক্ষার অধিকার রয়েছে আর তাই পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর দেশটির বিবেচনায় যথার্থ নয়। ২০১০ সালে অবধি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারত পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে পাকিস্তানও চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে- এ কথাটি বলা হলেও পরবর্তীতে পাকিস্তান এ অবস্থান হতে সরে এসে দাবি করে আসছে যে, তাকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেই কেবল দেশটি পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে।

ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর দেশ হলেও দেশ দু’টির কোনোটিই পরমাণু সরবরাহকারী দেশের (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত নয়। এ দু’টি দেশ বিভিন্নভাবে এনএসজিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়ে তৎপরতা চালালেও একটির ক্ষেত্রে চীন এবং অন্যটির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে ইসরাইল নিজেকে স্বীকার না করলেও ধারণা করা হয় দেশটির অস্ত্রভাণ্ডারে ১০০-২০০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইসরাইলের হেফাজতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা বিষয়ে সবসময় নমনীয় অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে। তাদের এ নমনীয় অবস্থানের স্বপক্ষে এ দেশটির নেতৃবৃন্দের যুক্তি দেশটি বৈরী প্রতিকূল অবস্থানে থাকায় নিজের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার স্বার্থে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ব্যত্যয় ঘটলেও তাকে সহনীয় হিসেবেই দেখতে হবে।

২০০৫ সালে উত্তর কোরিয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় যে, তার হেফাজতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। দেশটির দাবি যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একঘরে ও পঙ্গু করতে তার মিত্রদের সাথে একাট্টা এমন বাস্তবতায় আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে হলে তার জন্য পরমাণু অস্ত্রধারী না হওয়ার বিকল্প নেই। দেশটি এরই মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের পাঁচটি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা একদা নিজেকে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে স্বীকার করেছিল, পরে স্বীয় উপলব্ধি হতে এটি নিজের হেফাজতে থাকা সব পরমাণু অস্ত্র বিনষ্টের ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে দেশটির হেফাজতে থাকা সব পারমাণবিক অস্ত্র বিনষ্ট করা হয়।
ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও দেশটি পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সচেষ্ট যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আনীত এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির ওপর দীর্ঘকালব্যাপী অর্থনৈতিক অবরোধ বলবৎ ছিল। দৃশ্যত এ অর্থনৈতিক অবরোধ দেশটিকে সামরিক সরঞ্জামাদির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পরবর্তী দেখা গেল দেশটির হেফাজতে নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ও প্রস্তুতকৃত দেড় লক্ষাধিক অপারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশটির চির বৈরী ইসরাইলকে সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাৎ করে দিতে সক্ষম।

চুক্তি-পরবর্তী প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলো অদ্যাবধি পারমাণবিক অস্ত্র উন্নীত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পরমাণু অস্ত্রধারী নয় অথচ পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এমন দেশ যথা ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি স্বীকৃত পরমাণু অস্ত্রধারী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা যেভাবে আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়ে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা উত্তর কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তানের মতো পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রকে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হওয়ার শক্তি ও সাহস জোগায়। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি একটি বৈষম্যমূলক চুক্তি। এ চুক্তিটি যে পাঁচটি রাষ্ট্রকে পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার নৈতিক ভিত্তি বাস্তবতাবিবর্জিত। পরমাণু অস্ত্রধারী স্বীকৃত পাঁচটি রাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে ভবিষ্যতে ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো অন্ততপক্ষে ১০-১২টি রাষ্ট্র যে পরমাণু অস্ত্রধারী হতে সচেষ্ট হবে, সে প্রশ্নে কোনো সংশয় নেই। সুতরাং স্বীকৃত এ স্ববিরোধী চুক্তিটিকে মানবতা ও বিশ্ব শান্তির জন্য ফলদায়ক করতে হলে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের একমাত্র চাওয়া হতে পারে স্বীকৃত ও স্বীকৃত নয় এমন সব পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলোর হেফাজতে থাকা সব পারমাণবিক অস্ত্রের বিনষ্টীকরণ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

iktederahmed@yahoo.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us