বজ্র-বুজুর্গ-বুজরুকি-বজরা : ইরান থেকে বাংলায়
বজরা - ছবি : সংগৃহীত
চাঁদব্রহ্ম
ওপর, উঁচু, টপ বোঝাতে চাঁদ কথাটা এককালে খুব চলত। (চাঁদোয়া নিয়ে আমার একটা লেখাতে এ নিয়ে অনেক বলেছি)। চাঁদ ইন্দো-ইরানি কথা, যা এদেশে চন্দ্র, চন্দা হয়ে আগে থেকেই ছিল, সুলতান বাদশাহদের হাত ধরে এদেশে পারসি ভাষা জাঁকিয়ে বসলে চাঁদ নতুন করে জেগে ওঠে। লালচাঁদ মানে রেডমুন নয়, লালচাঁদ মানে লালাশ্রেষ্ঠ। কোত্থেকে এলেন সোনাচাঁদ আমার? এখানেও চাঁদশ্রেষ্ঠ অর্থে, তবে সারকাস্টিক। উমিচাঁদ, আমীরচাঁদ, সুলতানচাঁদ, চাঁদসদাগর, কথাগুলো পারসি প্রভাবে তৈরি। নামের মধ্যে কারণে-অকারণে যে চন্দ্র ব্যবহার হতো তা ওই পারসি চাঁদ থেকেই, শ্রেষ্ঠ মানেতে। সুভাষ চন্দ্র মানে শ্রেষ্ঠ সু-ভাষী। চাঁদ মানে ওপর- এটা পাড়ার মস্তানরা ভালো বুঝত- বউদি, দাদা এলে বলে দেবেন ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে একটু পেস্টিজ দিয়ে কথা বলতে, নয়তো একদম ওপরে পাঠিয়ে দেব, নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দেব।
ওপরে চলে গেছেন বোঝাতে আমরা এখনও নামের আাগে ৺ লাগাই।
উঁচু, টপ, লেবেলের হাই-এস্টিম্ড বোঝাতে ব্রহ্ম কথাটা খুব চলত। ব্রহ্মা, ব্রহ্মাসুর, ব্রহ্মদেব, ব্রহ্মস্ফুট, ব্রহ্মগুপ্ত, এরকম অজস্র কথা। এসব চাঁদ ওঠার আগের কথা। চাঁদের আলোকে কিছু ব্রহ্মশব্দ তৈরিও হয়েছিল- চাঁদিজমি, ব্রহ্মডাঙ্গা, মাথার চাঁদি, ব্রহ্মতালু ইত্যাদি। বাঙালির মুখে পশ্চিমের ব্রহ্ম তরলিত হয়ে হয়েছিল বেম্ভ, বোম্বা, ভোম্বা- বেম্ভজ্ঞান, বেম্ভদত্যি, বোম্বাই- আম ভোম্বাচাক ভোম্বল বুঝভোম্বল।
বজ্র, বজরা
চাঁদ, ব্রহ্ম, ছাড়া আর একটা ইন্দো-ইরানি সুপারলেটিভ হচ্ছে বজ্র। ডিকশনারিতে বজ্রর প্রায় ৫০ রকম মানে দিয়েছে, আর প্রায় ৯০টা যৌগশব্দ আলাদা এণ্ট্রিতে দিয়েছে। বেণীমাধব দ্র.। এত মানের মধ্যে প্রাইমারি ইরানি মানেটা ধরা রয়েছে- বিশাল, বৃহৎ, লার্জ, গ্রেট, কলোসাস আর প্রাইমারি ইন্ডিয়ান মানেটা ধরা রয়েছে– দৃঢ়, কঠিন, টাফ, রিজিড, হার্ড, ইমপেনেট্রেবল। বাকি বেশির ভাগ মানে দুতরফ থেকে ইম্প্লায়েড ডিরাইভ্ড।
দৃঢ়, কঠিন মানেতে আমাদের বাংলা কথা- বজ্র আঁটুনি ফসকা গেঁরো। বজ্রকণ্ঠ মানে কড়া গলা। তেমনি বজ্রকঠিন-দৃষ্টি বজ্রমুষ্ঠি বজ্রনখ।
রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ থেকে দুটো উদাহরণ -
বজ্রনখ দিয়া শিব জোনি ছেদ কৈল।
করিয়া কৌতুকে ফুড়ে বজ্জ নখে।
বিজয় গুপ্ত পদ্মাপুরাণে লিখেছেন -
বুকে পৃষ্ঠে মারে দেবী বজ্র চাপড়।
মারনের ঘায় পদ্মা করে থরথর॥
টাফ বলেই ডায়ামন্ডকে বলত বজ্রমণি-হীরা বা বজ্র। কঠিন বলেই লোহা ইস্পাত বলতে বজ্র বলত।
বজ্রবাঁটুল মানে বেঁটে, কিন্তু টাফ শক্তসমর্থ। হিন্দিতে একেই বলে বজরবট্টু। এখন বজরবট্টুর তিনটি মানে হয়েছে, যাদের গভীরে জেনেরিক মানেটা ঠিকই আছে। হিন্দি বজরং আসলে বজ্রাঙ্গ টাফবডি। আবেস্তার বজ্র আর ইন্দ্রের বজ্র একই জিনিস- লৌহকঠিন মেস। আসাবরদারের আসা।
বাংলায় খুব নির্মম কঠিনহৃদয় মেয়েকে বলা হতো বজরাবুকি মেয়ে।
বজ্রকবজ়র্গ
বজ্রর আদি ইরানি রুটটা ছিলো ৱজ়্রক মানে বিরাট। ইদানীং ইরানিতে তা হয়েছে بزرگ বজ়র্গ বোজ়োর্গ বুজ়ুর্গ। মানে বড়, বিশাল, বৃহৎ। খানা-ই বজ়র্গ মানে বড় বাড়ি। কুহ্-ই বজ়র্গ মানে বড় পাহাড়। আদম্-ই বজ়র্গ মানে বড় মানুষ। শর্কাত-ই বজ়র্গ মানে বড় শরীকী মানে বড় কোম্পানি। ইরান, আফগানিস্তানে বড় শহরের নামেও বুজ়ুর্গ থাকে। ইরানিতে বজ়র্গ শব্দটার -তর -তম তারতম্যও আছে – বজ়র্গ্ বজ়র্গ্তর্ বজ়র্গ্তরিন্ বৃহৎ বৃহত্তর বৃহত্তম।
বজ্র, বজ্রক-র, প্রত্ন-ইন্দো-ইরানি রূপটা ধরা হয়েছে *ৱেগ্ ৱেজ্ মানে ডাঁটো চাঙ্গা। মানে পণ্ডিতরা দৃঢ় কঠিন মানেটাকেই আদিমতম মানে এই ইঙ্গিত করছেন যা ইণ্ডিয়াতে ধরা রয়েছে। কিন্তু বজ্রক যখন পারসি বজ়র্গ রূপে এদেশে এলো তার বড় মানেটাই বড় হয়ে দেখা দিলো। মারাঠিতে একই নামের কাছাকাছি দুটি গ্রাম বা নদী-নালা-রাস্তার পারাপারি দুটি গ্রাম থাকলে বড়টার নামে বুদরুক্ আর ছোটটার নামে খুর্দ কথাটা বসায়। খুর্দ হচ্ছে ক্ষুদ্রর পারসি রূপ। পুনে-র দুটি গ্রাম শিরোলি খুর্দ আর শিরোলি বুদ্রুক।
উর্দুতে বজ়র্গ-এর মানেটা পাহাড়, শহর, গ্রাম ছেড়ে শুধু মানুষের ঘাড়ে চেপে বসল। বুজ়ুর্গ মানে হলো বিশাল মাপের মানুষ গ্রেট ম্যান। তারপর বুজ়ুর্গ-এর মানে হলো জ্ঞানবৃদ্ধ। এখন হিন্দি উর্দুতে বুজ়ুর্গ মানে হয়েছে বয়োবৃদ্ধ। বেটি কি শাদী এক বুজ়ুর্গ সে কিয়া– মানে বয়সে বড় কোনো বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। অবশ্য বৃদ্ধ বুড়ো এদেরও মূল মানে বড়ো।
বজরা বাজরা
বজ্র মানে বড়- এই ইরানি মানেটা হিন্দি বাংলায় আছে বজরা নৌকোতে। মানে বড় নৌকো, ভড়। এটা যাত্রীবাহী ছাউনি দেয়া কাঠের কামরাঅলা নৌকো, লঞ্চের দাদা। বজরা বার্জ পিনেস তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, আমাদের কোষকাররা সব এক করে ফেলেছেন। বজরাকে আগে বজর বজ্রঅ বলা হতো। সাহেবরা বজরঅ-কে budgerow লিখত।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠিক উল্টোটা বলছেন, অথচ বলছেন এটা বঙ্গের নিজস্ব। মানেও দিয়েছেন বার্জ বজরা পাঞ্চ করে। আবার একই জিনিস বাজরা এণ্ট্রিতে অন্য ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন। হরিচরণও মোটামুটি তাই। আঞ্চলিকে দিয়েছে বয্রা কচা গাছ মানে খুব বড় গাছ। যব, গমের শিষ পাতা উচ্চতার চেয়ে বাজরা গাছের শিষ পাতা উচ্চতা বড় হয়। মনে হয় একারণেই একে হিন্দিতে ৱজরা বাংলায় বাজরা বলে।
বুজ়ুর্গ্বুজ়ুর্গী
বাংলায় ইসলামের খিল খুলেছে খিলজি ঢোকার প্রায় ৬০০ বছর আগে থেকে। মোহাম্মদ সা. বেঁচে থাকতেই (মৃত্যু ৬৩২)। ওনার মামা ৬২০ সালে বাংলায় আসেন এবং পাঁচ বছর থাকেন। এদেশে মুসলিম শাসনআমল (৭১২-১৮৫৭) শুরু হতে আরো ১০০ বছর দূর অস্ত্। আরবদের পায়ে পায়ে ইরানি মিশনারিরা আসতে শুরু করে। বাংলাতে মুসলমানি ঢেউ আনার মূল কারিগর ইরানি সুফি পীর দরবেশরা। বাংলার বহু মুসলমান গ্রামে একটা করে পীরের দরগা আছে। বাংলাতে তখন চলছে প্রাকৃতিক লৌকিক তান্ত্রিক ধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্ম তখন যাই যাই করছে। ইসলামের প্রসারে অর্থ সমাজ রাজনীতি জাতপাত আঁতেঘাত সাম্যবাদ ইত্যাদি বহুমাত্রিক কারণ ছাড়াও ব্যক্তি পীরদের ব্যক্তিত্ব, মাহাত্ম্য, কৃতিত্ব সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। এমনিতেই কেলোকুঁদো বাঙালির চেয়ে ইরানি আর্যরা দর্জির ফিতেতেও ধড়ে-ডাগরে বড় মাপেরই মানুষ ছিলেন। তবে এদের নম্র ব্যবহার, সৌম্য দরশন আর সাম্য দর্শন সামাজিক মানুষকে কাছে টেনেছে। সাধারণ মানুষ এদেরকে জ্ঞানঋদ্ধ মহান মানুষ গ্রেট ম্যান মেনেছে। তাই এদের ভাষাতেই এদেরকে বুজ়ুর্গ্ বলতে শিখেছে। এদেরকে ওলি আউলিয়ার মর্যাদা দিয়েছে। এদের কবরকে দরগা বানিয়েছে। বুজ়ুর্গের আচার বিচার ব্যবহার বিদ্যাকে মানুষ বলেছে বুজ়ুর্গী।
১৭৪৩-এ মানোএল লিখেছেন, buzorqui বুজ়োর্কি মানে dignidade ডিগনিটি মর্যাদা। অর্থাৎ ভালো মানেতেই বাঙালি জিভে বুজ়রকি শব্দটা ছিল। ১৮২৫-এ কেরি সাহেব বুজরগী মানে দিয়েছেন greatness, honourableness, ১৮৩৩-এ হটন বলছেন, বুজুর্গী মানে greatness eminence, noblity। কেরি বা হটনে বুজরুক, বুজরুকি বলে কোনো এন্ট্রি নেই। ১৭৪৩ থেকে শুরু করে মানোএল কেরি, হটন সাহেবের পর দেড় শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঙালি অভিধানকাররা যাবনিক বুজরগী নিয়ে টানা টুপটাপ স্পিকটি নট। ১৯০৬-এ সুবলমিত্রে দেখা গেল বুজরুকি। বুজ়ুর্গী শব্দটা পচে বুজরুকি হলে তবে কোষকাররা বগল বাজিয়ে নেমে পড়েছেন, শুধু বুজরুকিটাকে এন্ট্রি দিয়ে শুধুই পচে যাওয়া মানেটাই দিয়েছেন। যদিও ১৮৬১তেও হুতোম বুজরুক বুজরুকি দুটি কথাই ভালো মানেতে ব্যবহার করেছেন।
বুজরুক বুজরুকি
বিদেশি পীর ওলিদের কাছে দীক্ষিত হয়ে কিছু লোকাল লোকও পীর হতো। এর মধ্যে কিছু চ্যাংড়া পোঁদপাকাও ঢুকে যেত, কিছু আশারাম, রামরহিমও ঢুকত। নিজ ধর্মে চটজলদি লোক টানার জন্য সব ধর্মই মিথ, জাদু, কেরামতি, তিলিস্মাতি, অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়েছে। ভেকধারী পক্ক প্রচারকদের কেউ কেউ সস্তা চমক গিমিকে ঐশী শক্তির ভান করে ভক্তি ভাইরাল করার চেষ্টা করত। সাধারণ মানুষ এদের জাল ফরেব ধরতে পারলেও মুখের ওপর কিছু বলত না, কিন্তু আড়ালে এই জালি-জাদু তুচ্ছ-তিলিসমাত দেখানো লোকদের লোকে বুজ়ুর্গ না বলে তাচ্ছিল্য করে বুজরুক্ বলতে শুরু করল, আর তাদের ভণ্ডামি ভাঁড়ামিকে বুজরুকি বলে দেগে দিলো। পরে যারা জাদু, মায়া, কুহক, ভেলকি করে লোক ঠকাত তাদেরও বুজরুক বলা হতে লাগল। বুজ়ুর্গ বলতে জ্ঞানবৃদ্ধও বোঝাত। তাই বিদ্যেবুদ্ধি ছাড়াও বিদ্যার বোলচাল দিয়ে পোঁদপাকামি করাকেও বুজরুকি করা বলা হতে থাকল। এখন বুজরুকির তিনটি মানে চলে - ভেকধারী-বাবা জাল-জ্যোতিষদের জাদু-জোচ্চুরি, ফাঁপা-পণ্ডিতের ফক্কুড়ি আর ফালতু ফাটবাজদের বাতিল-বাতেলা।
আসল জ্ঞানবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ, সম্মাননীয়দের এখনো বুজ়ুর্গই বলা হয়, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে।
মস্তান, ফাজ়িল, বুজ়ুর্গ- তিনটিই ভালো কথা ছিল। শ্লেষ সারকাজ়ম সন্দেহের পাল্লায় পড়ে আজ এগুলোর সম্মানের মানেগুলো নেই।
ykyusufkhan@gmail.com