আফগান যুদ্ধে আমেরিকার সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হলো
আফগান যুদ্ধে আমেরিকার সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হলো - ছবি : সংগৃহীত
আফগান যুদ্ধের সূচনালগ্নে ওই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দম্ভভরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সবাইকে আমাদের সহযোগী হতে হবে। নিরপেক্ষদেরকে আমরা শত্রু শিবিরেই গণ্য করবো।' এজন্য মৌন সমর্থন ভিন্ন প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে হয়েছে অনেক দেশকে। বিশ্বে তখন পরাশক্তি আমেরিকার প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শনের মতো নৈতিক সাহস ও সক্ষমতা কোনো দেশের ছিল না। অথচ আজ চীন তাদেরকে আক্রমণ করে কথা বলছে। রাশিয়া তাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। উত্তর কোরিয়া তাদেরকে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। তুরস্ক তাদের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট মিত্রদের পরাজিত করছে। পাকিস্তান তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের আগ্ৰহ তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দিচ্ছে। এতসব চপেটাঘাতেও আমেরিকা কার্যত সফল কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এজন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগান যুদ্ধে আমেরিকার সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা হলো, প্রভাবে বিস্তারের আগের সেই জৌলুস তারা হারাতে বসেছে। শক্তি ও ক্ষমতার রাজনীতিতে ধারপাতের নতুন সমীকরণ যুক্ত হতে চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আমেরিকা তাতে প্রভাবশালী একটি রাষ্ট্র হিসেবেই কেবল নিজ অস্তিত্বের জানান দেবে; ঠিক অদূর অতীতের বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ স্থাপনকারী যুক্তরাজ্যের আজকের পরিণতির মতো। পরাশক্তি হিসেবে আর তার অবস্থান ধরে রাখা হয়তো সম্ভবপর হবে না। ভবিষ্যতের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে অন্য কোন দেশ। ধারণা করা হচ্ছে, চীনই সেই অবস্থান অধিকার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে।
আফগান যুদ্ধে অর্থনীতিতেও বিপুল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কোনো দেশের দেউলিয়া হওয়ার জন্য তাদের যুদ্ধে জড়ানোই যথেষ্ট। সেখানে আমেরিকা ২০ বছর আফগানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। উন্মাদনার উতরোলে নিজেদের পাশাপাশি অন্য দেশেরও ঘানি টেনেছে। বিভিন্ন বিবরণীতে উঠে এসেছে, প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এই যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে। এসময় তারা ইরাকের ফ্রন্টেও আলাদা গেইম খেলেছে। উপস্থিত থেকেছে আরো নানা ফ্রন্টেও। তাতেও কি কম খোয়াতে হয়েছে? তার ওপর করোনা যেন পালে হাওয়া দিয়েছে। ফলে ১৯৩২ সালের পর এবার আমেরিকাকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আমেরিকাকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে।
আফগান যুদ্ধে সেনা ক্ষয়ও কম ঘটেনি। বহু চেষ্টা করেও আমেরিকার পক্ষে সেনা লয়ের সংখ্যা গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট এই বিষয়ে ৩৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, আফগান যুদ্ধে তালেবানের হাতে নিহত সৈন্যদের সংখ্যা বিপুল নয়। পুরো ২০ বছরে মাত্র ৭,০৫৭ জন সৈন্য খোয়াতে হয়েছে। এটা সুখকর সংবাদ হলেও বিপত্তি বেধেছে অন্য জায়গায়। আফগান মুসলিমদের উপর মানবতাবিরোধী ও সুস্থ বিবেক পরিপন্থী নানা ধরনের অমানবিক নির্যাতনের ফলে বিবেকের দংশনে অনেক সেনা সদস্য এখন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দেহে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে 'পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেম সিনড্রম'-এর মতো ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি। এর ফলে ইতোমধ্যে অনেক সেনা সদস্য আত্মহত্যা করেছে। অনেকের ব্যাপারে আত্মহত্যার বিপুল আশঙ্কা রয়েছে। উন্নততর চিকিৎসার নিবিড় তত্ত্বাবধানেও তাদের নিরাময় মিলছে না।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান বাইয়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য বিবরণীতে লক্ষ্যহীন এই যুদ্ধে আত্মহত্যাকারী সেনাদের সংখ্যা ৩০,১৭৭ জন দেখানো হয়েছে। আফগান বা ইরাক ফেরত সেনাদের মধ্যেও ক্রমে এই রোগ প্রকাশিত হচ্ছে। ইরাক-আফগানে কর্মরত অনেক সেনাও এই রোগে আক্রান্ত বলে প্রমাণিত হচ্ছে। বাইয়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের সমীক্ষাতে তাদের সংখ্যা ৬০,০০০ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। অন্য মার্কিন সেনাদের মধ্যেও এখন ব্যাপক হারে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বাইয়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের সমীক্ষাতে তাদের সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো দেখানো হয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানটির সমীক্ষার ওপর নির্ভর করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ছয় লাখ সৈন্য হারানোর আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সৈন্য সংখ্যা হচ্ছে ১১,১২,৭০৩ জন। এখন এর থেকে যদি ছয় লক্ষ বিয়োগ করা হয়, তবে অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমেরিকার সামরিক কোমর ভেঙে গেছে। এজন্যই হয়তো আমেরিকার হুংকারকে অপরাপর শক্তিশালী দেশগুলো আর তোয়াক্কা করে না। উল্টো তাদেরকে হুংকার দেয়। কেউ আবার তাদের নিয়েই গেইম খেলার সাহস দেখায়। এজন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, সৈন্যদের মানসিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার ভাবনা আমেরিকাকে আফগান যুদ্ধের ইতি টানার প্রতি ধাবিত করেছে।
আমেরিকার শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে এখন কেবল অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপই বাকি রয়েছে। তবে তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখার ব্যাপারে এই অস্ত্র কতটুকু কাজে লাগাতে পারবে, আন্তর্জাতিক মহলে এখন তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আফগান ইস্যুতে অনেক দেশকে আমেরিকার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে চীন-রাশিয়া বলয়ে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে। যেটা মার্কিন বলয়ের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কার্যকারিতাকে বহুলাংশে হ্রাস করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইদানিং আমেরিকা কর্তৃক চীনের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পর চীন কর্তৃক আমেরিকার প্রতি পাল্টা অবরোধ আরোপ করা এই ধারণাকে আরো পাকাপোক্ত করে। এজন্য কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, আফগানের এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আমেরিকাকে অনেকটা দন্তহীন বাঘে পরিণত করেছে।