বাঘের গর্জনে ক্যাঙ্গারুর কম্পন

আফফান উসামা | Aug 07, 2021 02:39 pm
বাঘের গর্জনে ক্যাঙ্গারুর কম্পন

বাঘের গর্জনে ক্যাঙ্গারুর কম্পন - ছবি : সংগৃহীত

 

আমরা করব জয়,

আমরা করব জয়,
আমরা করব জয়, একদিন...
আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়,
আমরা করব জয়, একদিন...।

গানটা যেন বাংলাদেশেরর ক্রিকেটের সাথে মিশে গেছে। প্রতিটি জয়ের পর আনন্দ ভাগ করে নিতে, বা কখনো পরাজয় ভুলে অনুপ্রেরণা পেতে, সাজঘরে বা টিম হোটেলে প্রায়ই খালি কণ্ঠে ক্রিকেটাররা গেয়ে উঠেন সমস্বরে। বুকে প্রত্যয়, চোখে স্বপ্ন, আর মুখেতে ‘আমরা করবো জয়' স্লোগানে নিজেদের উজ্জীবিত করেন নতুন শক্তিতে।

মুখে জয়ের গানে সুর তুলে শুধুই বসে থাকেনি ওরা। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে বলে নিজেদের সঁপে দিয়ে, চেষ্টা শ্রম আর সাধনার বিনিময়ে উড়িয়েছেন অসংখ্য বিজয় নিশান। কখনো জয় এসেছে হেসেখেলে, খুবই সহজে। আবার কখনো বা রক্তহিম করে, শরীর কাঁপিয়ে, বুক ধরফর করে; যেন দমবন্ধ ভালোবাসা। প্রতিটি জয়েই আনন্দ হয়, তবে কিছু জয়ে উত্তেজনা ছড়ায়; রন্ধ্রে রন্ধ্রে উন্মাদনা ছড়ায়। আর সেই জয়গুলো যদি হয় কোনো দুর্লভ অপরাজেয় দলের সাথে, কোনো পরাশক্তির বিরুদ্ধে! তবে তখন তা ছাড়িয়ে যায় সব কিছুকে। হয়ে উঠে এক মায়াবি গল্প, এককথায় যাকে ‘রূপকথা' বলে।

রূপকথার গল্প শুনেছেন, পড়েছেন, দেখেছেনও হয়তো।
রূপকথার গল্পে কী না হয়? সত্য-মিথের মিশ্রণে কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে অবিশ্বাস্য যা তৈরী হয়, তাকেই তো রূপকথা বলে। ক্রিকেটের ২২ গজেও যেই রূপকথার দেখা মিলেছে হরহামেশাই, অহরহ। বাংলাদেশের ক্রিকেটও পিছিয়ে থাকেনি, এমন অবিশ্বাস্য সব মুহূর্ত বাঙালিদেরও কম আসেনি। নানা সময়ে নানা স্থানে একাধিকবার মঞ্চায়ন হয়েছে এই রূপকথা, যার নায়ক কখনো আশরাফুল, কখনো বা রুবেল, কখনো আবার মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু আজকের গল্পে কে নায়ক, কে নায়ক মিরপুর রূপকথার?

▪এক
জাদুকরের জাদু দেখেছেন? সবাইকে ঘোরে রেখে যিনি বিস্ময়ের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাসি ফোটান দর্শকের মুখে। বাংলার ক্রিকেটেও তেমনি একজন জাদুকর আছেন, যিনি মস্তিষ্কের শক্তিতে বিশ্বকে শাসন করে চলেছেন। ব্যাট আর বলে সমতালে প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে মুগ্ধ করে চলেছেন বিশ্বকে। কালও যেন তারই পুনরাবৃত্তি হলো, একটা উইকেটের জন্য তখন হাহাকার বাঘ শিবিরে, বাঙালির মনে। অধিনায়ক তাই ভরসা নিয়ে বল তুলে দিলেন তার হাতে, বললেন প্রয়োজনটা মেটাতে। অতঃপর জাদুকর জাদু দেখালেন, বাঁ হাতের বিভ্রমে ৬৩ রানের জুটি ভাঙলেন। আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিলেন দলে, যেন বললেন 'ভয় নেই, জয় আমাদেরই হবে'। এমনি করে কত শতবার দলকে আগলে রেখেছেন গত ১৫ বছরে, হিসেব করে পরিসংখ্যান বের করলেও তার কি আদৌ কোন মূল্য হবে? জাদুকরের নাম কিন্তু বলিনি...

▪দুই
ইতিহাস বলে ক্যাঙ্গারুরা পিছু হটে না, তারা পিছু হটতে জানে না। কিন্তু ইতিহাস যে পাল্টে গেল এবার বাঘের দেশে এসে। ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে পড়লে কী আর এতে নিয়ম রীতি মনে থাকে? আসলে তাই হচ্ছে, বল হাতের মোস্তাফিজকে দেখলে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা যেন তেমনি, চোখে দেখতে থাকে সর্ষে ফুল, পা দুটো যেন কেঁপে উঠে। মুস্তাফিজের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ থেকে দ্বিতীয় ম্যাচে ছিল বেশি ঘাবড়ে। আর তৃতীয় ম্যাচে ওদের এমন ভাবে নাচিয়েছে, বলা চলে কাঁপিয়েছে যেন ম্যালকম মার্শাল বল করছে! তাই নয়তো কি, ২ ওভারে ২৩ প্রয়োজন যখন, তখন কতটা বাধ্য হলে ৬ বল থেকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মোটে এক রানে! এমন মোস্তাফিজই তো
সবার চাওয়া, সব সময়ের চাওয়া। প্রিয় মুস্তাফিজ, আপনার ফিরতে হবেনা আগের রূপে, আপনি থাকুন স্বরূপে!

▪তিন
অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল জিম্বাবুয়ে সিরিজে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই যে এভাবে কাউন্টার দেবেন, তা কবে ভেবেছিল কে? সিনিয়র দুই ক্রিকেটার তামিম, মুশফিক অনুপস্থিত, দলের সেরা মারকাটারি ব্যাটসম্যান লিটনও ছিটকে গেছেন, দলে নেই সেরা স্পিনার মিরাজও। এমন দল নিয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে উতরে আসলেও, পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কতটা পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু তিনি যেভাবে দল সাজাচ্ছেন, পরিকল্পনা করছেন, যেভাবে খেলাচ্ছেন তাতে সমালোচকও মুগ্ধ, 'ওয়েল ডান ক্যাপ্টেন' বলতে বাধ্য হয়েছে। আর দলের ধসে এক প্রান্ত আগলে রেখে এই ম্যাচে তার করা অর্ধশতকটা তৃপ্তি না দিলেও, জয়ের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। একটা ধন্যবাদ নেবেন ক্যাপ্টেন মাহমুদউল্লাহ!

▪ চার
তিনি সুন্দর, সৌন্দর্যময়, সবার সেরা। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে শরীর মুচড়ে দৃষ্টিনন্দন যে সেইভগুলো করেন উইকেটের পেছন থেকে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে? বলছিলাম উইকেট কিপার সোহানের কথা। মুশফিকের কিপিং বিতর্ক দীর্ঘ সময়ের। কখনো কখনো অসাধারণ কিছু মুহূর্তের উপহার দিলেও, কখনো সহজ সুযোগ হেলায় হারিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি করেছেন নিজেকে ঘিরে। বিকল্প হিসেবে লিটনে ভরসা রাখা যায়নি, মুশফিকে ফিরতে হয়েছে উইকেটের পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে তার খেলা পরিচালনার সক্ষমতার কারণে। তবে চলতি সিরিজে সোহান যেভাবে উজ্জীবিত করে চলেছেন দলকে, উইকেটের পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে নির্দেশনা দিচ্ছেন বোলারকে, তাতে দর্শক-সমর্থক বা সমালোচক, সবারই মন জুড়েছে।

▪ পাঁচ
বিশ্বের প্রতিটি দলেরই সহ-অধিনায়ক আছে, কিন্তু আমাদের কেন নেই তা নিয়ে কখনো কখনো প্রশ্ন উঠে। যেই দলে একজন সাকিব আল হাসান আছে, সেই দলে সহ-অধিনায়কের কি আদৌ প্রয়োজন আছে? কাল কিছু সময়ের জন্য দলের প্রকৃত অধিনায়ক কে, তাই যেন বোঝা যাচ্ছিল না। দলকে কাল যেভাবে উজ্জীবিত রেখেছেন, সাহস জুগিয়েছেন, বা উইকেটের চরিত্র বোলারদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, মনে হচ্ছিল সাকিবই যেন দলের আন অফিশিয়াল ক্যাপ্টেন। তবে ম্যাচ মাহমুদউল্লাহ বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন তিনিই নাকি সাকিবকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে মাহমুদউল্লাহর সিদ্ধান্তটা যে সময়ের সেরা ছিল, তা কি বলার আক্ষেপ রাখে?

একদম ফাইনালের মতো ম্যাচ ছিল। কী ছিল না ম্যাচে : শেষ ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা, নো বল, ফ্রি হিট, বলে বলে ছক্কার প্রয়োজন, সবই ছিলো। রহস্যময় উত্তেজনাপূর্ণ একটা উপভোগ্য ম্যাচ ছিলো। আর জয়ের আনন্দ তাকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছে। কতটা উপভোগ্য করেছে, তা সাকিবের বাচ্চাসুলভ উদযাপন দেখেই বুঝা যাবে। তাছাড়া সমস্ত উদযাপনও যেন এই ম্যাচের জন্যই জমা ছিল। আগের দুই ম্যাচ জিতেও খুব একটা উল্লাস হয়নি, মাঠে বা সাজঘরে। তবে এবার হয়েছে, উল্লাসে মেতেছে প্লেয়ার, কোচ, ম্যানেজমেন্ট সবে। আর একসাথে সমস্বরে গেয়েছে গান, আমরা করব জয়...

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us