সাকিব আল হাসান : বহির্বিশ্বে বাংলার পরিচয়
সাকিব আল হাসান - ছবি : সংগৃহীত
সাকিব আল হাসান। ২২ গজের ভূলোকে বিমোহিত- বিমুগ্ধতা ছড়ানো এক নাম। কখনো ম্যাচ সেরা, কখনো সিরিজ সেরা, কখনো আসর সেরা, আবার কখনো বা বিশ্বসেরার তকমায় অপার সব কীর্তিগাঁথায় সাফল্যের শেখরে সমাসীন এক নাম। বাংলার ক্রিকেটের এক মহাস্তম্ভ তিনি, ভূমিকাটা ঐতিহাসিক চীনের প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য-দুর্বার। দক্ষিণবঙ্গে উদিত অসংখ্য তারার ভিড়ে তিনি এক সূর্য্যসম, যার শুভ্র রশ্মি ৫৭ হাজার বর্গমাইলের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়েছে দূর দিগন্তে; বিশ্বজুড়ে!
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথিকৃৎ-পথ প্রদর্শক তিনি। বাঘের গর্জনে বিশ্ব কাঁপাতে পথচলা তার দিগন্তজুড়ে! বাঁহাতের কারুকাজে বিস্মিত বিশ্বকে পরিচয় দিয়েছেন আমি বাংলার, আমি বাঘেদের একজন। শত মাইল দূরত্বেও নিদ্রাহীন বাঙালির বাঁধন হারা উল্লাস আর বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ তিনি, একবার-দু'বার নয়, বার বার; অসংখ্য-অগণিত বার। বঙ্গদেশের অর্জনের গর্জন তিনি, প্রতিবাদের হুংকার। তিনি লাল সবুজের অহংকার।
কিন্তু আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে, কে ভেবেছিল চুপচাপ স্বভাবের এ লিকলিকে ছেলেটাই বিশ্বের বুকে বাংলার পরিচয় হবে? হ্যাঁ, সম্ভাবনা নিয়েই এসেছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ভাবা হয়েছিল, তাই বলে যে বাংলার ক্রিকেটের মহানায়ক হয়ে যাবে, তা কে জানত? যদি বোঝা যেত, এই হ্যাংলা-পাতলা বাচ্চা ছেলেটিই বাংলার হাজারো দিনের বিনিদ্র রাত্রির অপেক্ষার প্রহর ঘোচাবে, আক্ষেপের আঁধার দূর করে তার হাতেই সোনালি ভোরের উদয়ন হবে, আফসোসের জ্বালা মুছে সুখানুভবের তৃপ্তি দেবে, তবে কি আর প্রস্তুতি ম্যাচের পারফর্ম দেখেই তাকে মূল্যায়ন করে ফেলে?
সময়টা তখন ২০০৬। পরবর্তী বিশ্বকাপে ভালো করার প্রস্তুতিতে বিভোর বাংলাদেশ দল। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ দল জিম্বাবুয়ে সফরে। ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দলে তখন তিন নতুন মুখ, সাকিব, মুশফিক আর ফরহাদ রেজা। তাদের মাঝে ফরহাদ রেজার অভিষেকটা হয়ে গেছিল তৃতীয় ম্যাচেই। কিন্তু দলে রফিক, রাজ্জাক, কপালির মতো তুখোড় স্পিনার ছিল বলে আর পাইলট থাকায় সাকিব ও মুশফিকের সুযোগ হচ্ছিল না দলে। কিন্তু এরই মাঝে বাংলাদেশ দল ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরে যাওয়ায় তরুণদের দেখে নেয়ার তত্ত্বে শেষ ম্যাচে লাল-সবুজের জার্সিটা গায়ে উঠে দুজনের। তারই সাথে হারারের মাঠে সূচনা হয় এক নতুন দিনের, বাংলার ক্রিকেট আকাশে দেখা মেলে নতুন সূর্যের।
সেদিন রাজ্জাক, রফিক, রাজিনদের সাথে হাত ঘুরিয়ে তুলে নেন ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে, ৩.৯০ ইকোনমিতে ১টি উইকেট। এল্টন চিগাম্বুরাকে সাজঘরের পথ দেখান বাঁ হাতের মায়াবি বিভ্রমে বোকা বানিয়ে স্ট্যাম্প ছত্রখান করে। যাহোক, জিম্বাবুয়ের ১৯৮ রানের দেয়া টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শাহরিয়ার নাফিসের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ দল তখন জয়ের পথে, ইতমধ্যে রাজিন আর আফতাব বিদায় নিলে চার নাম্বারে দেশের পক্ষে প্রথমবার ব্যাট হাতে নামেন আজকের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, অপরাজিত থেকে যখন ম্যাচ জয় করে ফেরেন ততক্ষণে ৪৯ বলে করে নিয়েছেন ৩০ রান।
সেই যে শুরু... অতঃপর আজ। এরই মাঝে হাজারো দিন ফুরিয়েছে, মাসের পর মাস পেরিয়েছে, হারিয়েছে এক এক করে ১৫টি বছর। এরই মাঝে দেশকে দিয়েছেন অনেক কিছু, এনে দিয়েছেন অসংখ্য জয়ের সুখানুভব। কখনো ব্যর্থও হয়েছেন, তবে তার থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। ব্যর্থ হয়ে দমে যাননি, ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লড়াই করে ছুটে চলেছেন অগ্রপানে। যার ফলাফল এসেছিল ২২ জানুয়ারি ২০০৯ সালে। যেদিন দূর হয়েছিল সব হাহাকার, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিলো উঁচু শিরে। যার সবটাই সাকিবকে ঘিরে। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় সে যে বিশ্ব সেরার সিংহাসনে সমাসীন!
এরপর থেকে যেন ব্যাটে-বলে সমতালের সেরার আসনটা একেবারে নিজের সম্পত্তি করে ফেলেছেন সাকিব। এমনকি এই আসনে গড়ে ফেলেছেন ইতিহাসও। ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, জ্যাক ক্যালিস বা গ্যারি সোবার্সের সাথে যেই সাকিবের তুলনা হয় অহরহ, সেই সাকিব তাদেরও ছাপিয় গেছেন একটা দৌড়ে, এমনকি রজার ফেদেরার কিংবা সেরেনা উইলিয়ামসের মতো তারকারাও ওই দৌড়ে তার পেছনে। হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সাকিব আল হাসান টানা ৩২৪ সপ্তাহ ওয়ানডে ক্রিকেট র্যাকিংয়ের শীর্ষে থেকে পেছনে ফেলেছেন সেরেনার ৩১৬ সপ্তাহ শীর্ষে থাকার কীর্তি।
একজন সাকিব আল হাসানকে নিয়ে লিখতে গেলে হাজারো পৃষ্ঠার প্রয়োজন হবে। দিনের পর দিন সময় ফুরোবে। তাতেই কি সাকিব আল হাসানকে ফুটিয়ে তোলা যাবে? তাঁর মূল্যায়ন করা হবে? কিভাবে হবে বলুন, সাকিব তো শুধু বাংলার ক্রিকেট নয়, সমস্ত খেলাতেই বাংলার আদর্শ, বাংলার প্রেরণা। তাঁর হাসিতে গোটা দেশ হেসে উঠে, যার চোখেতে পুরো জাতি স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে বিশ্বজয়ের। প্রিয় সাকিব, হবে নাকি এবার, বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরার?
* আজ ৬ আগস্ট, আজকের এই দিনেই ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে প্রথমবার লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন সাকিব আল হাসান।