আফগান যুদ্ধে উজবেকিস্তানের গুরুত্ব
উজবেকিস্তানের একটি স্থাপনা - ছবি : সংগৃহীত
আফগান যুদ্ধে খাইবার পাসের পর ন্যাটো বাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের বিকল্প পথ হলো উজবেকিস্তান। দেশটি নিজেই উজবেক ইসলামী যোদ্ধাদের বিরাট ঘাঁটি। আফগান যুদ্ধে উজবেক যোদ্ধাদের নেতা জুমা নামান গনি ন্যাটো বাহিনীর হাতে মারা যান। সোভিয়েত আমলে কৃষিজমি কমিউনের নেতৃত্বে যাওয়ায় অনেক চাষির স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং চাষের প্রতি আগ্রহ হারায়। অনেক উজবেক চাকরির জন্য কাজাখিস্তান ও রাশিয়ায় চলে যান। তখন কৃষিপ্রধান ফারগান এলাকায় ইসলামপন্থীরা জড়ো হয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা চিহ্নিত করতে থাকেন।
মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিধায় পরাশক্তিগুলো তার সাথে সম্পর্ক করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। উজবেক প্রশাসনও আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় মধ্য এশিয়া হঠাৎ করে অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অন্যান্য দেশও বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য উজবেকিস্তানের অভিজ্ঞতাকে রপ্ত করে এগিয়ে যেতে চায়। উজবেক সরকার বা তাসখন্দ কিছু দিন আগে ওয়াশিংটনের কৌশলগত সংগঠনে যুক্ত হয়েছে, যেখানে ইসলামাবাদ ও কাবুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আবার মস্কো ও বেইজিংয়ের সাথেও তাসখন্দ ‘ভালো বাণিজ্যিক অংশীদার’ হিসেবে কাজ করছে।
উজবেকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে আবার রাশিয়ার সাথেও সামরিক সম্পর্ক রেখেছে। একই সাথে চীনের বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশ নিয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে উজবেকিস্তানের বিশেষ ভূকৌশলগত কারণে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যেগুলো উজবেকিস্তানকে এ অবস্থায় আনতে সহায়তা করেছে। প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজাইয়েভ নিজের দেশকে বাইরের বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করতে চান, যা আগের প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ করেননি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পাশের কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বাণিজ্য প্রসারের জন্য। উজবেকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আঞ্চলিক শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের এক গুরুত্বপূর্ণ এনার্জি পার্টনার হিসেবেও উজবেকিস্তান পরিচিত। তুর্কমেনিস্তান-চীন পাইপলাইনে উজবেকিস্তান ট্রানজিট হিসেবে কাজ করে। চীন সম্প্রতি বড় বিনিয়োগ করছে বিদ্যুৎ খাতে, যাতে উজবেকিস্তান আঞ্চলিক বিদ্যুৎ হাবে পরিণত হতে পারে। বেকারত্ব দূরীকরণ, দেশের বাইরে না যাওয়া এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ না দেয়ার জন্য রাশিয়া ও চীন প্রচুর বিনিয়োগ করছে, যাতে অধিক হারে চাকরির বাজার সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রও উজবেকিস্তানকে গুরুত্ব দিয়েছে। একজন দক্ষ ও পুরনো কূটনীতিক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর গুরুত্ব বোঝেন; তাই তিনি দেশটির সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ইতঃপূর্বে অবশ্য ২০০৫ সালে আন্দিজানে করিমভবিরোধী বিক্ষোভকারীদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ছিল এবং এ কারণে ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীকে তাসখন্দ ছাড়তে হয়েছিল। জো বাইডেন এসব কিছুকে দক্ষতার সাথে সামাল দিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ উজবেকিস্তানের সাথে আরো একটি কোয়াড গঠন করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। এই কোয়াড এবং রাশিয়া ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য অনেক কিছু সূচিতে রেখেছে। তিনি রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ আগেভাগে করতে চান; কেননা আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করা না গেলে চীন ও রাশিয়ার সাথে পাল্লা দেয়া সহজ হবে না।
নতুন কোয়াড ও চীনের বিআরআই-এ দু’টি বিষয় পাকিস্তানে এসে যেন মিলিত হয়ে গেছে।
এখানে উজবেকিস্তান ও পাকিস্তানের দূরদর্শিতা ও সমীকরণ লক্ষণীয়। দু’টি দেশের মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কও রয়েছে। এসব নজরে থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন ইসলামাবাদকে নতুন কোয়াডে নিয়েছে। ভারত না কোয়াডের সদস্য হতে পেরেছে, না কোয়াড গঠনে বাধা দিতে পেরেছে। রাশিয়াও ইউরেশিয়া পার্টনারশিপকে আরো সম্প্রসারিত করতে পাকিস্তানের সাথে কাজ করতে চায়, যা চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের সাথে মিলে যাবে এবং আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করবে। অনেকেই এ পদক্ষেপকে নামকরণ করেছে ‘সিইপিসি+’ হিসেবে।
এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান আঞ্চলিক ভূ-অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপের কৌশলী নীতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি উভয় দেশ কৌশলগত পার্টনারশিপকে আরো শক্তিশালী করতে একমত হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই কৌশল মধ্য এশিয়ার অন্য সব দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া একসাথে একটি অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা বিশ্বের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।